ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গৃহকর্মী আহাদ গ্রেফতার, স্বীকারোক্তি

সাবেক সেনা কর্মকর্তা হত্যারহস্য উদ্ঘাটন

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১১ নভেম্বর ২০১৬

সাবেক সেনা কর্মকর্তা হত্যারহস্য উদ্ঘাটন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্র্রিগেডিয়ার জেনারেল ওয়াজি আহমেদ চৌধুরী হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে র‌্যাব। গৃহকর্মী আব্দুল আহাদ গ্রেফতারের পর হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। গুলশানের একটি নিজস্ব ফ্ল্যাটের কারপার্কিংয়ের জায়গায় নিহতের ছেলের মোটরসাইকেল রাখাকে কেন্দ্র করে মারামারির সূত্রধরে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটায় আহাদ। হত্যার পর টাকা ও মালামাল নিলেও পরবর্তীতে ধরা পড়ার ভয়ে মালামাল ফেলে টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল গ্রেফতারকৃত আসামি। হত্যাকা-ের সময় আহাদের সঙ্গে আরও কেউ ছিল কিনা, সে বিষয়ে তদন্ত ও আহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বুধবার রাত বারোটার দিকে রাজধানীর পল্লবী থানা এলাকা থেকে আব্দুল আহাদকে (৩৫) গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র‌্যাব-৪ এর একটি দল। আহাদের পিতার নাম জমির আলী (মৃত)। বাড়ি সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানাধীন নদার মালপাড়া গ্রামে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাওরানবাজারে বিএসইসি (বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল অধিদফতর) ভবনের ১০ তলায় র‌্যাবের নতুন মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ অধিনায়ক পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক লুৎফুল কবির জানান, গ্রেফতারকৃত মোঃ আব্দুল আহাদ নিহত সেনা কর্মকর্তার মহাখালী ডিওএইচএসের ৪ নম্বর সড়কের ১৪৮ নম্বর বাড়িতে মাসিক ৬ হাজার টাকা বেতনে কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করত। নিহত সেনা কর্মকর্তা সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওয়াজি আহমেদ চৌধুরী (৭৬) নিজ বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বসবাস করতেন। তিনি আরও জানান, গত ৪ অক্টোবর ঘটনার আগের দিন নিহতের ছেলে ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরী আব্দুল আহাদকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যার পর পরই গুলশানে থাকা তাদের একটি নিজস্ব ফ্ল্যাটে যান। ফ্ল্যাটের কারপার্কিংয়ের জায়গায় ফুয়াদ তার মোটরসাইকেলটি তারই মামার গাড়ির সঙ্গে তালাবদ্ধ করে রাখেন। এ নিয়ে ওই বাড়ির ম্যানেজার ও নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে ফুয়াদের বাগ্বিত-া হয়। একপর্যায়ে ম্যানেজার লাঠি দিয়ে ফুয়াদকে মারপিট করে। মারপিটের সময় কেয়ারটেকার আব্দুল আহাদ এগিয়ে না আসায় ফুয়াদ তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়। ফুয়াদ ক্ষিপ্ত হয়ে আব্দুল আহাদকে মারপিট করে। আহাদ বাসায় ফিরে সেনা কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানায়। ফুয়াদও বিষয়টি তার পিতাকে বিস্তারিত জানায়। এতে সেনা কর্মকর্তা আহাদের ওপর খানিকটা রাগ করেন। আহাদ বাসায় আর কাজ করবে না বলে জানিয়ে দেয়। তার মাসিক বেতনের টাকা দাবি করেন। দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত আহাদের এমন কথায় সেনা কর্মকর্তা রাগের বশবর্তী হয়ে আহাদকে চলে যেতে বলেন। তাকে বেতন দেয়া হবে না বলে রাগের মাথায় বলে ফেলেন। এর জের ধরে আহাদের সঙ্গে সেনাকর্মকর্তার বাগ্বিত-া হয়। ওই রাত সাড়ে নয়টার দিকে সেনা কর্মকর্তা আহাদকে ডেকে পানি চান। আহাদ পানি দেয়ার সময় আবার বেতনের টাকা দাবি করেন। আরও ক্ষিপ্ত হয়ে সেনা কর্মকর্তা টাকা দেবেন না বলে জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আহাদ তার রুমে থাকা মোটা রঁশি দিয়ে ফাঁস তৈরি করে এনে সেনা কর্মকর্তাকে ভয় দেখায়। এ সময় সেনা কর্মকর্তা উত্তেজিত হয়ে আহাদের দিকে যান। আহাদ তৈরি করা ফাঁস সেনা কর্মকর্তার গলায় পরিয়ে দিয়ে টান দেয়। সেনা কর্মকর্তা ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করার চেষ্টা করলে আহাদ আরও জোরে ফাঁসের রশি ধরে টান দেয়। টানে সেনা কর্মকর্তা ফ্লোরে পড়ে যান। এতে এক সময় সত্যি সত্যিই সেনা কর্মকর্তার গলায় ফাঁসি লেগে যায়। তখন আহাদ সেনা কর্মকর্তার হাত পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধে। আর পা খাটের পায়ার সঙ্গে বাঁধে। এরপর ঘর তালাবদ্ধ করে দিয়ে ডাইনিং রুমে থাকা বড় দেয়াল টেলিভিশন, টেবিলে থাকা নগদ ৪ হাজার টাকা ও একটি ল্যাপটপ নেয়। ফুয়াদের রুম ছাড়াও বাইরে যাওয়ার সময় বাড়ির কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে চলে যায়। রাত সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে ঘটনাটি ঘটে। আহাদ টেলিভিশন আর ল্যাপটপ নিয়ে বের হয়ে একটি সিএনজি ভাড়া করে। সিএনজিটি কাওরানবাজারের কাছে পৌঁছলে রাস্তায় থাকা টহল পুলিশ সিএনজি থামার জন্য ইশারা দেয়। এতে বিপদ আন্দাজ করতে পেরে সিএনজিতে টেলিভিশন ও ল্যাপটপ রেখেই আহাদ পালিয়ে যায়। সিএনজিচালকও বিপদ বুঝতে পেরে গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো পথে সেও গলিতে ঢুকে পালিয়ে যায়। নিহতের ছোটভাই সামান্য দূরে থাকা মহাখালী ডিওএইচএসের ১৯ নম্বর সড়কের ২৬৮ নম্বর বাড়ির মালিক বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরী জানান, তিনি ১৯৯৬ সালে অবসরে যান। তাদের পিতার নাম আহম্মেদ চৌধুরী (মৃত)। বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানাধীন ফুলবাড়ি গ্রামে। তারা চার ভাই পাঁচ বোন। ভাইদের মধ্যে শুধুই তিনি রইলেন। তিনি জানান, ভাই ১৯৯২ সালে অবসরে গিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে ভাবি আতিয়া আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যু হয়। ভাইয়ের বড় ছেলে নাবিদ আহমেদ চৌধুরী (৪৪) প্রায় এক দশক ধরে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করছে। একমাত্র ছেলে খানিকটা বাক্প্রতিবন্ধী অবিবাহিত ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরীকে (৪০) নিয়ে নিজ বাড়িতেই বসবাস করছিলেন। ভাইয়ের বাড়িতে সিলেটের বিশ্বনাথ থানার বাসিন্দা তাদের পূর্বপরিচিত আব্দুল হক নামে একজন দশ বছর কাজ করে। কাজে খুশি হয়ে ভাই তাকে লন্ডনে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন। আব্দুল হক যাওয়ার সময় ওরই খালাত ভাই আব্দুল আহাদকে ভাইয়ের বাড়িতে কেয়ারটেকার হিসেবে দিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন কাজ করার পর আব্দুল আহাদ একবার ভাইয়ের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। প্রায় দুই মাস আগে আবার আব্দুল আহাদ ভাইয়ের বাড়িতে হাজির হয়। ভাইকে জানায়, তার চাকরি নেই, টাকা পয়সার অভাব। তাই আবার ভাইয়ের বাড়িতে চাকরি করতে চায়। ভাই দয়া করে আবার আব্দুল আহাদকে চাকরিী দিয়েছিলেন। হত্যাকা-ের পেছনে আরও কোন কারণ আছে কিনা, তা তিনি খতিয়ে দেখার দাবি জানান। নিহতের ছেলে অনেকটাই বাক্প্রতিবন্ধী ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরী জানান, গত ৫ অক্টোবর প্র্র্রতিদিনের মতো দুপুর বারোটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ বুঝতে পারি। কারও কোন সাড়া-শব্দ নেই। কয়েকটি লাথি দেয়ার পর দরজা খুলে। সামনেই ডাইনিং টেবিলে থাকা চল্লিশ ইঞ্চি ওয়াল টেলিভিশন নেই। সামনেই আব্বার রুমে তালা দেয়া। মূল দরজায় তালা দেয়া। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি আব্বা রুমের মেঝেতে পড়ে আছেন। হাতুড়ি দিয়ে তালা ভেঙ্গে দেখি আব্বার গলায়, হাতে ও পায়ে রশি দিয়ে বাঁধা। মূল দরজার তালা ভেঙ্গে বেরিয়ে দেখি কলাপসিবল গেট বাইরে থেকে তালা দেয়া। এবার দ্রুত দ্বিতীয় তলায় উঠে কার্নিশ দিয়ে নিচে নেমে আদিবাসী দুই যুবককে সঙ্গে নিয়ে কলাপসিবল গেটের তালা ভেঙ্গে আবার আব্বার রুমে যাই। তাকে উদ্ধার করে দ্রুত ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখন দুপুর প্রায় একটা। চিকিৎসকরা জানান, অন্তত তিন ঘণ্টা আগে আব্বার মৃত্যু হয়েছে। এরপর পুলিশের মাধ্যমে লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। গত ৬ অক্টোবর ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, ওয়াজি আহমেদ চৌধুরীর গলায় রশি পেঁচিয়ে পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে আলামত পাওয়া গেছে। ওই দিনই নিহতের ভাতিজা রেশাদ আহমেদ চৌধুরী বাদী হয়ে রাজধানীর কাফরুল থানায় আব্দুল আহাদের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাত আসামিও রয়েছে। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর গুলশান থানার ওসি বরাবর নিহত ওয়াজি আহমেদ চৌধুরী একটি অভিযোগপত্র লিখেছিলেন। তাতে বলা হয়েছেÑ স্ত্রী মারা যাওয়ার কারণে সন্তান হিসেবে দুই ছেলে গুলশান-২ এর ৩৫ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর প্লটের ৪০৭ নম্বর ফ্ল্যাটটির মালিক। হাসান বিশ্বাস নামের এক ভাড়াটিয়া দীর্ঘ দিন ফ্ল্যাটটিতে ভাড়ায় ছিলেন। তিনি ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর চলে যান। এরপর থেকেই ফ্ল্যাটটি খালি। ফ্ল্যাটটির জন্য দুটি কারপার্কিং রয়েছে। একটি কারপার্কিংয়ের জায়গা ফুয়াদের খালা রাদিয়া আহমেদ ব্যবহার করে আসছেন। সম্প্রতি রাদিয়া গাড়িটি পার্কিংয়ের জায়গায় রেখেই আমেরিকায় চলে যান। অন্যটি ফুয়াদের এক মামা ব্যবহার করে আসছেন। কিছু দিন আগে একজন ভাড়াটিয়া ফ্ল্যাটটি ভাড়া করে অগ্রিম টাকা দিয়ে যান। ভাড়াটিয়ার গাড়ি রাখার জন্য পার্কিংয়ের জায়গা থেকে অন্তত একটি গাড়ি সরিয়ে দিতে বলা হয় ফুয়াদের খালা ও মামাকে। এ নিয়ে মামার সঙ্গে ঝামেলা চলছে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগটি থানা পুলিশ গ্রহণ করেনি বলে নিহত ওয়াজি আহমেদের পরিবারের অভিযোগ। পারিবারিক সূত্রে আরও জানা গেছে, ফ্ল্যাটটির জন্য দুটি কারপার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। দুটি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গার ফাঁকে ফুয়াদ তার মোটরসাইকেলটি রাখেন। এ নিয়ে বাড়ির কেয়ারটেকার ও ম্যানেজার ফুয়াদের ওপর ক্ষিপ্ত। ফুয়াদ ও তার পিতা দীর্ঘ দিন ধরে একটি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা খালি করে দেয়ার জন্য দুই আত্মীয়কে বার বার অনুরোধ করেছেন। তাতে কোন কাজ না হলে ফুয়াদ বিষয়টি আবারও পুলিশকে জানানোর প্রস্তুতি নেন। ইতোপূর্বেও ফুয়াদ পুলিশকে মৌখিক অভিযোগ করেছে। পুলিশ আসার আগেই চালক পার্কিংয়ের জায়গা থেকে গাড়ি সরিয়ে নেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পার্কিংয়ের জায়গা ফাঁকা পায়। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ফুয়াদের অভিযোগ মিথ্যা বলে মনে করে আসছিল পুলিশ। অভিযোগটি সত্যি বলে প্রমাণ করতে গত ৪ অক্টোবর ফুয়াদ কৌশলে তার মোটরসাইকেলটি গাড়ির চাকার সঙ্গে চেইন দিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখেন, যাতে প্রাইভেটকারটি চালক আর সরাতে না পারে। আর পুলিশ এসে অভিযোগের সত্যতা পায়। চেইন দিয়ে তালা দেয়ার সূত্রধরেই ওই দিন মারামারির ঘটনাটি ঘটে। আর তারই জেরে খুন হন ওয়াজি আহমেদ চৌধুরী। মামলার বাদী হত্যাকা-ের পেছনে আরও কোন কারণ বা আরও কেউ জড়িত কিনা, তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্তের দাবি করেছেন। যদিও র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলছেন, ঘটনাচক্রে আব্দুল আহাদের হাতেই হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটেছে। আহাদ পরিকল্পিতভাবে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটায়নি বলে দাবি করেছে। হত্যাকা-ের পেছনে আরও কোন কারণ আছে কিনা, তা জানার চেষ্টা চলছে।
×