ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শামসুর রাহমানের কবিতা ॥ মিথের আশ্রয় বীরেন মুখার্জী

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

শামসুর রাহমানের কবিতা ॥ মিথের আশ্রয় বীরেন মুখার্জী

বিংশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ শামসুর রাহমান। তিনি বাংলা কবিতার শুদ্ধতম ধারার গর্বিত উত্তরাধিকার। বাংলা কবিতার পথ-পরিক্রমায় তিরিশের আধুনিকতা পেরিয়ে চল্লিশের অভিনবত্বে স্নাত হয়েছেন এবং পঞ্চাশের দশকে সমকালীন বৈশ্বিক বাতাবরণে নিজেকে নির্মাণ করেছেন একজন স্বতন্ত্র কবি হিসেবে। এছাড়া আধুনিক বাংলা কবিতার দিগন্তপ্রসারী বাস্তবতায় যে নিরীক্ষাধর্মী প্রবণতা আজও চলমান তা তিরিশ পরবর্তী সময়ে শামসুর রাহমানের মাধ্যমেই শুরু হয়েছে। তিনি চারিত জীবনাভিজ্ঞান, প্রযতœ-পরিশীলিত ভাবনা এবং শব্দের নানামুখী আল্পনায় সৃষ্টি করেছেন কবিতা সম্ভার। তার কবিতা প্রগতিশীল চেতনাকে যেমন সমর্থন করে, তেমনি অস্থির রাজনীতি, নৈতিকতার অবক্ষয় ও পরিবর্তিত বাস্তবতায় জীবনমুখী হতে শিক্ষা দেয়। তিরিশের পর কাব্য-প্রকরণ তার হাতেই ফুল-ফসলে প্লাবিত হয়েছে। আত্মকেন্দ্রিকতার খোলস ছেড়ে কবিতার সামষ্টিক চেতনা যখন গুণমুগ্ধ পাঠককে টানেÑ তখন কবি হয়ে ওঠে নাগরিক কবির জাতক। কবি শামসুর রাহমান ধার করা আলোয় আলোকিত নয়। হাজার বছরের বাংলা কবিতাকে ভিত্তিভূমকে কবিতার ভিত্তি জেনে অগ্রজ ধ্যানী কবির ঋণ স্বীকারে সমুজ্জ্বল। তার কাব্যভাষা কতটা নিজস্ব পৃথক সে বিশ্লেষণে না গিয়েও বলা যায়, শামসুর রাহমানের কবিতায় দৃশ্যকাব্য বেগবান হয়েছে ব্যঞ্জনাঋদ্ধ উপমা-প্রতীকের ব্যবহারে। কবিতা শরীরে বাকপ্রতিমা সংযুক্তি বা ইন্দ্রিয়গম্য চিত্রকল্প বিনির্মাণে তিনি বহুমুখিনতার পরিচয়ে অগ্রগামী। পুরাণ প্রসঙ্গ শিল্পিত সুষমায় জড়িয়ে আছে তার কবিতার পরতে পরতে। শামসুর রাহমানের কবিতার সন্ধানী পাঠশেষে কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিথের সহাবস্থান শনাক্ত করা যায়। ‘মিথ’ ও ‘পুরাণ’-এর উপকরণগত মিল পরিলক্ষিত হওয়ায় সাহিত্য আলোচকরা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শব্দ দুটিকে সমার্থক হিসেবেই গ্রহণ করেন। কবিতায় মিথ-পুরাণের ভাঙাগড়ায় সমান্তরাল দুটি অনুষঙ্গের উল্লম্ফন ঘটে থাকে। যার একটির চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস এবং অন্যটি ধর্মীয় আবেগমুক্ত ইতিহাস, সমাজচেতনা বিষয়ক প্রপঞ্চ। শামসুর রাহমান কবিতার প্রয়োজনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিথ-পুরাণের ভাঙাগড়ার ফলে হয়ে ওঠেন দ্বিতীয়টির জাতক। যা তার নিজস্ব কালকে প্রতিবিম্বিত করে সমাজগঠনে অগ্রবর্তী এবং তার চিন্তা সর্বাংশে প্রতিফলিত রাষ্ট্র, সমাজ ছুঁয়ে ব্যক্তিমানসের অনুধ্যানে। ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ (১৯৭৭) কাব্যগ্রন্থের ‘নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি’ কবিতায় কবির অবস্থান আহত দেবী আফ্রোদিতির সমান্তরালে। ডায়োমিডিসের আঘাতে প্যারিসকে উদ্ধার করতে গিয়ে দেবী আফ্রোদিতি আহত হয়েছিলেন, কবি কল্পনার মিথস্ক্রিয়ায় নিজেকে আহত আফ্রোদিতির সঙ্গে তুলনা করে লিখেন- হে নিশীথ, আজ আমি কিছুই করতে পারবো না। আমার মগজে ফণীমনসার বন বেড়ে ওঠে,- দেখি আমি পড়ে আছি যুদ্ধবিধ্বস্ত পথে কী একাকী; ভীষণ আহত আমি, নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি। (নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি/বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে) স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুর সামনে কবি শামসুর রাহমান গ্রিক সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির আহতাবস্থার বাস্তবতা কবিতায় উল্লেখ করে মূলত নিজ অক্ষমতার কথা ব্যক্ত করেছেন। এ কবিতায় তার ব্যক্তিক অনুভূতি সামষ্টিক রূপ পরিগ্রহে স্ফুট। মিথের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের স্বরূপলক্ষণটি এ কবিতায় পুরোমাত্রায় উপস্থিত না হলেও কল্পনা ও মিথের মিথস্ক্রিয়ায় কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে একটি জাতির আশা আকাক্সক্ষার পূর্ণরূপ। লৌকিক সত্যাসত্য, নিসর্গের নির্মলতা, বাংলার প্রকৃতি জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠেছে শামসুর রাহমানের কবিতা। একদিকে তিনি যেমন ঐতিহ্য সচেতন অপরদিকে বিশ্বমানবতার জয়গানে মুখর। যে কারণে তার কবিতায় বিশ্বচরাচরের নানাবিধ প্রপঞ্চের সহাবস্থানে এসে দাঁড়ায় মিথ ও পুরাণের প্রতিকল্প। শামসুর রাহমানের কবিতার অলি-গলিতে প্রবেশ করতে হলে প্রতীকের হাত ধরে প্রবেশ করতে হয়। তবে রূপক-উপমা-প্রতীকের পরিসরে তিনি মিথকে কবিতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিবেশন করেছেন। তার এই প্রতীকায়িত কাব্য-প্রকরণে পুরাণের নান্দনিক ব্যবহার লক্ষণীয়। পুরাণ ব্যবহারের মাধ্যমে একাধারে ব্যক্তিজীবন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কট-সমস্যার কথাও অবলীলায় উপস্থাপন করেছেন। যেমন- রাত্রির পীড়নে উড়ে উন্মথিত আমি নক্ষত্রের ঝড়ের মতো শব্দপুঞ্জ থেকে ছিঁড়ে আনি কবিতার অবিশ্বাস্য শরীর সৌন্দর্যের মতো রহস্য-ঢাকা, নগ্ন আর উন্মীলিত। আমার সেই নির্মাণে মাননীয় পক্বকেশ পণ্ডিত হন্তদন্ত হয়ে খোঁজেন গ্রীক পুরাণের উল্লেখ, (কাব্যতত্ত্ব/ প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে) শামসুর রাহমানের ‘ইকারুসের আকাশ’ (১৯৮২) কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা পুরাণের ভিন্নতা নিয়ে উপস্থাপিত। এ কাব্যেও কবিকে অসম্ভব কাব্যময়তা এবং নির্মাণ শৈলীতে মিথ-পুরাণের শ্রমসাধ্য কারিগর হিসেবে দেখা যায়। ডেডেলাসের পুত্র ইকারুস আত্ম-আবিষ্কারের নেশায় এবং তারুণ্যে স্পর্ধায় মোমের পাখা নিয়ে উঁচুতে উড়তে গিয়ে প্রখর সূর্যতাপে পাখা গলে গিয়ে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল। ইকারুসের নির্মম পরিণতি শামসুর রাহমান সত্তায় অনুভব করে লিখেছেন- জেনেও নিয়েছি বেছে অসম্ভব উত্তপ্ত বলয় পাখা মেলবার, যদি আমি এড়িয়ে ঝুঁকির আঁচ নিরাপদ নিচে উড়ে উড়ে গন্তব্যে যেতাম পৌঁছে তবে কি পেতাম এই অমরত্বময় শিহরণ? (ইকারুসের আকাশ/ইকারুসের আকাশ) কবিতায় প্রকৃতি তন্ময়তা, অতীতচারণ, অসহায়ত্ব, পারিপার্শ্বিক নির্মমতা ও সর্বময়ী সমবেদনা একীভূত হয়ে কবিতার বহিরঙ্গ পরিপাটি থাকলেও, অন্তরঙ্গ স্তরে প্রতিষ্ঠিত বোধ ভেঙে নবতর বোধের আলোকে তৈরি হয় অপূর্বভাবিত বাস্তবতার রুঢ় ব্যঞ্জনা। এই নির্মিত একমাত্র কাব্য দীক্ষিত কবির পক্ষেই সম্ভব। বাংলার লোকপুরাণ সংশ্লিষ্ট উপকরণ নিয়ে সৃষ্ট চিত্রকল্প মিথ ও রিয়্যালিটির দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তার কবিতায় প্রতিভাস হতে দেখি। পুরাণভাষ্যের প্রতœপ্রতিমার উৎস থেকে আহরিত আধুনিক ব্যত্যয় তার কবিতাকে নির্দিষ্ট পথের সন্ধান দেয়। যেখানে আবহমান বাংলার প্রকৃতির রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ এর সম্মিলিত চেতনা মিলেমিশে থাকে। কবিতা সৃজনের আবেগ পরিহার করে তিনি ব্যক্তিক চেতনাকে সমবায় চেতনায় প্রকাশ করতে সচেষ্ট ছিলেন গোটা কাব্যজীবনে। মানুষের প্রাত্যহিকতা, মোহগ্রস্ত কিংবা সুখী ভাবা সংক্রান্ত মনোজাগতিক জটিলতা ও বিভ্রান্তি তাকে করে তুলেছিল বিপন্ন ও বিব্রত। প্রাথমিক অবস্থার কবিতাগুলোতে শামসুর রাহমানকে তিরিশি ভাবাদর্শে গ্রন্থিত থাকতে দেখি। পরবর্তীতে তিনি বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। পরিহার করেন ভাবালুতা, অতিকথন। অস্তিত্বে হয়ে ওঠেন কবিতার সতর্ক-প্রহরী। শুধু পুরাণ প্রতীতী নয় শামসুর রাহমানের কবিতার বিশাল ক্যানভাসজুড়ে রয়েছে স্বদেশচিন্তা, জাতির প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ও মমত্ববোধ। প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমি যখন কোন রাজনৈতিক সঙ্কটে পতিত তখনই শামসুর রাহমানের সজাগ উপস্থিতি দেখি শব্দের আল্পনায়Ñ কবিতা অবয়বে। জনতার ক্রান্তিকালে সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের আশা আকাক্সক্ষা, আনন্দ বেদনাকে তুলে ধরেন কবিতার পটভূমে। প্রাচীন সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী বাংলাদেশের কেন্দ্রে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক, সর্বমানবিকতার চৈতন্যে সমুজ্জ্বল। আধিপত্যবাদ ও ধর্মান্ধতার কারণে প্রতিক্রিয়াশীল ধারাটিকে পশ্চাৎমুখী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় দেখে তিনি একদিকে যেমন আতঙ্কিত হয়েছেন, অপরদিকে লেখনীর মাধ্যমে গণজাগরণে সক্রিয় স্বাক্ষর রেখেছেন। অন্তরে লালন করেছেন বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতির। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাক্রম অনুসরণে সমকালীন জগজ্জীবন খুঁড়েই পুরাণের সামষ্টিক ধারণা সংগ্রহ করেছেন। জাতির মানবিক বোধ, ব্যক্তি-চেতনার গভীরতা, প্রেমের বৈচিত্র্য বিনির্মাণে মিথ-পুরাণের উপকরণ ব্যবহারে জীবন-জটিলতার গ্রন্থি উন্মোচনে পরিচর্যাশীল। রাত্রির পীড়নে উড়ে উন্মথিত আমি নক্ষত্রের ঝড়ের মতো শব্দপুঞ্জ থেকে ছিঁড়ে আনি কবিতার অবিশ্বাস্য শরীর সৌন্দর্যের মতো রহস্য-ঢাকা, নগ্ন আর উন্মীলিত। আমার সেই নির্মাণে মাননীয় পক্বকেশ পণ্ডিত হন্তদন্ত হয়ে খোঁজেন গ্রীক পুরাণের উল্লেখ, (কাব্যতত্ত্ব, প্রথম গান/ দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে) প্রকৃত কবিদের কবিতার নান্দনিকতা প্রকাশিত হয় প্রতীকের মাধ্যমে। কাব্য-সৌন্দর্য নির্মাণে সতর্ক-প্রয়াসী শামসুর রাহমানের কবিতা ভুবনে প্রতীকের ব্যবহার বিশিষ্টতা নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়। তবে তার এ প্রতীকায়িত কাব্য-প্রকরণে পুরাণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি ‘পুরাণ’ কবিতায় মিথকে বাতিল হিসেবে উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেন, ‘আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন,/ তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পুরাণে।’ তারপরও চলমান বাস্তবতার সঙ্গে আধুনিক জীবনের সামগ্রিকতা তুলে ধরতে গিয়ে পুরাণের কাছে সমর্পিত থেকেছেন। পুরাণ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তি জীবন ও সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কট-সমস্যার কথাও অবলীলায় উপস্থাপন করেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতা পাঠান্তে প্রতীয়মান হয় তিনি উপমহাদেশ খ্যাত ভারতীয় পুরাণের চেয়ে পাশ্চাত্য তথা গ্রিক পুরাণের ব্যবহারে ছিলেন অধিক উৎসাহী। তার নিরালোকে দিব্যরথ গ্রন্থের ‘টেলেমেকাস’ কবিতাটি এ সাক্ষ্য দেয়- ... পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়। এখনও কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে টঙ্কার? এ কবিতায় তিনি গ্রিক পুরাণের সঙ্গে বাংলার জনগণের সংগ্রামকে প্রতীকায়িত করে বাংলার চির পরিচিত নৈসর্গিক চিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি অবরুদ্ধ ও সংক্ষুব্ধ বাংলার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। সমকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে এ কবিতার অবয়বে। একজন প্রকৃত বীর না থাকায় ইথাকা নগরীর ভাগ্যে যে নির্মম পরিণতি ঘটেছিল, বাংলা জননীর পরিণামও একই হবে ভেবে চিন্তান্বিত হয়েছেন কবি। ফলে প্রতীকায়নের মাধ্যমে তিনি সমকালীন বাংলার প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। পিতৃহীন টেলেমেকাস অসহায় হলেও রাজ্য দখলদারের বিরুদ্ধে ছিলেন সংক্ষুব্ধ, আর অন্তরে ছিল তীব্র ঘৃণা। টেলেমেকাসের সঙ্গে তিনি অবরুদ্ধ বাংলার জনগণের সাদৃশ্য এঁকেছিলেন এ কবিতাটিতে। সঙ্গত কারণে ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’ গ্রন্থে ড. হুমায়ুন আজাদ দেশাত্ববোধে জারিত শামসুর রাহমানের এ কবিতাটিকে তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করেছেন। মানব-সমাজের সঙ্গে মিথ বা পুরাণের নিবিড় সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না। পুরাণ প্রকৃতার্থে সমাজ-জাতির সাংস্কৃতিক মৌলিক উপাদান। মানব সভ্যতার বিবর্তনে মিথের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাক্রম অনুসরণ করেই শামসুর রাহমান কবিতায় মিথ বা পুরাণের ব্যবহার করেছেন। সমকালীন জগজ্জীবন থেকেই পুরাণের ধারণা সংগ্রহ করেছেন তিনি। পাশাপাশি জাতির মানবিকবোধ, ব্যক্তি-চেতনার গভীরতা, প্রেমের বিচিত্র রূপ আবিষ্কারেও মিথের সহায়তা গ্রহণ করেছেন। অকৃপণভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিথের সংমিশ্রণে আধুনিক জীবন-জটিলতার গ্রন্থি উন্মোচনে সচেষ্ট থেকেছেন। আবার তিনি ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ (১৯৬৬) কাব্যগ্রন্থের ‘পুরাণ’ কবিতায় মিথকে বাতিল হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন,/তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পুরাণে।’ (পুরাণ, বিধ্বস্ত নীলিমা) তারপরও শামসুর রাহমান শেষাবধি আধুনিক জীবনের সামগ্রিক দিক তুলে ধরতে গিয়ে পুরাণের কাছে হাত পেতেছেন নিঃসঙ্কোচে। শামসুর রাহমান কবিতা পাঠে এটাই প্রতিভাত হয় তিনি গ্রিক মিথের ব্যবহার অধিকমাত্রায় হলেও ‘খা-বদাহন’, ‘জতুগৃহ’, ‘কালকূট’, ‘বাল্মিকী’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’, ‘শিখ-ী’, ‘ঋষ্যশৃঙ্গ’ কবিতায় ভারতীয় পুরাণের ব্যবহার দেখা যায়। ভারতীয় পুরাণের নানা চরিত্র ও ঘটনা শিল্প-সৌকর্যে প্রকাশিত হয়েছে প্রাগুক্ত কবিতাগুলোতে। তবে অনস্বীকার্য যে, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিথ-পুরাণ, বাংলার চিরচেনা প্রকৃতি ছুঁয়ে শামসুর রাহমানের কবিতা নানাভাষ্যে, বহুমাত্রিকতায় বাঙালীর চেতনাকে সঙ্গী করেই পূর্ণতার পথে হেঁটেছে।
×