ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাজী সুফিয়া আখতার

বিবাহ বিচ্ছেদ ও নারীর পারিবারিক সামাজিক অধিকার

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ৭ অক্টোবর ২০১৬

বিবাহ বিচ্ছেদ ও নারীর পারিবারিক সামাজিক অধিকার

এক গবেষণায় সম্প্রতি এ তথ্য উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে গেছে এবং এক্ষেত্রে নারীরা কিছুটা এগিয়ে। এতে অনেকে চিন্তিত। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য এমন সময় প্রকাশিত হলো- যখন ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় ও শোলাকিয়ায় ভিন্ন মাত্রায় জঙ্গী হামলার পরে সকলে পারিবারিক বন্ধনের উপর নতুন করে গুরুত্ব আরোপের কথা বলেছেন। যখন কয়েক মাস বা বছর ধরে পরিবার বিচ্ছিন্ন, নিখোঁজ সন্তানের সন্ধানে অভিভাবকরা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের আনাচে-কানাচে; খোঁজ পেতে প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। পুলিশের কাছে ধরনা দিচ্ছেন বারবার। আগেও দিয়েছেন। এখন দিচ্ছেন খুঁজে পেতে শুধু নয়, ছেলে আবার জঙ্গীর খাতায় নাম লেখাল কি না, শঙ্কিত চিত্তে দুরু দুরু বুকে তা জানতে। যাদের ছেলে-মেয়ে নিখোঁজ তারাই ভাল জানেন অপরিমেয় যত্ন, ভালবাসায় বড় করা উঠতি বয়সী, সম্ভাবনাময় ছেলে-মেয়ের পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অতল গভীর দুঃখ, বুকে চাপ ধরে থাকা কষ্ট। মূল কথায় ফিরে আসি। আর্থ-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক কারণে প্রতিবছর বিভিন্ন স্তরে বা শ্রেণীতে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। প্রতিবছর কোন না কোন সংগঠনের গবেষণায় এই হার বেড়ে যাওয়ার তথ্য জনগণ জানতে পারে। সমাজতাত্ত্বিকগণ, উন্নয়নকর্মী, সমাজ সচেতন মানবিক মানুষ চিন্তিত হন এই ভেবে যে, বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে গেলে সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; সংসার ভেঙে যাওয়া দম্পতিদের ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হবে। এই নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার কোন অবকাশ নেই। শঙ্কিত হওয়ার কারণ বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনায় নারীদের সংখ্যা কেন বেড়ে যাচ্ছে? নারীরা তো চিরকাল প্রেমিক স্বামীর, ভালবাসার স্বামীর নির্যাতন সহ্য করে; শাশুড়ি, ননদ, দেবর-ভাশুর ও সতীনের জ্বালা সয়ে সংসারের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে ভালবাসে। কখনও কখনও বাধ্য হয়। কারণ তাঁর যাওয়ার জায়গা থাকে না। দুঃখের কথা শোনার মানুষ থাকে না। কথায় তো আছে- মেয়েদের আবার বন্ধু কি? বাবা-মা বিয়ে দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেন। নারী ভালভাবেই জানে তিল তিল যত্ন, শ্রম, ভালবাসায় যে স্বপ্নের সংসার সে গড়ে তুলেছে; বিবাহ বিচ্ছেদ হলে তাঁকে ছোট ছোট সন্তানদের হাত ধরে, কোলে-কাঁখে নিয়ে খালি হাতে একাই এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে হবে। তালাকপ্রাপ্ত নারী বাপের বাড়িতেও অনাকাক্সিক্ষত, অবাঞ্ছিত। সম্মানহীন। এমন ঘটনা ছোটবেলা থেকে সে শুনে-দেখে বড় হয়েছে। আর এই সমাজ তো সারাক্ষণ তালাকপ্রাপ্ত নারীর দোষ খুঁজে বেড়ায়। তাঁর দিকে তেরছা চোখে তাকায়। স্বামীর ভাত খেতে পারল না যে স্ত্রীলোক, সে আবার কেমন মেয়েমানুষ! বহু শতাব্দী ধরে তালাক প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র ছেলেদেরই ছিল। পিতৃতান্ত্রিকতার হাজারো নৃশংস ঘটনার নজির বিরাজমান চারপাশের সমাজে সবসময়েই ছড়িয়ে ছিল। সাহিত্যে তো আছেই। ফলে ‘কোথায় যাবে’ এই প্রশ্নে নিজের ভেতরের দ্বিধার চেয়ে অধিক ক্রিয়াশীল ছিল সামাজিক নিষেধের ভয়াবহ পিতৃতান্ত্রিক দেয়াল। এখনও আছে। এই বলয় থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে না পাওয়া বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সচেতন মেয়ে অনেক কাল এই বলে সান্ত¡না মেনে নিয়েছেনÑ ‘সৃষ্টিকর্তা পুরো সময় দেননি/আমাকে মানুষ করে গড়তে/রেখেছেন আধাআধি করে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঁশিওয়ালা)’। সমাজকে বদলাতে না পারলে আধাআধি মানবী কি মুক্তি পায়, না সমাজের মুক্তি ঘটে? কিন্তু সমস্যাটা তো নারীকে পুরুষের সমান করে না গড়ার নয়। পুরুষ নিজেও তো আটকে আছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিগড়ে। প্রয়োজন হলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে সমঅধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা। বর্তমান ব্যবস্থায় পুরোপুরি এই সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কারণ পুঁজিবাদের কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানার দৌরাত্ম্য। উন্নত মানবিক সমাজ ও পারিবারিক পরিম-ল গড়ার লক্ষ্যে দরকার পারিবারিক, সামাজিক সম্পদ এবং সম্পত্তিতে নারীর মালিকানা প্রতিষ্ঠা। যা হয়নি, হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। বর্তমানে, ৪৫ বছর বয়সী বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতি আশানুরূপ না হলেও সন্তোষজনক পর্যায়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে প্রায় সমান। মাধ্যমিকেও তা-ই। তবে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অধিকাংশ স্থানে পথ নিরাপদ নয় বিধায় ঝরে পড়ার বিষয়টি এখন একটু বাড়ছে। সরকারী-বেসরকারী অনেকগুলো ভাল উদ্যোগে এবং কমিউনিটি পিপলদের প্রচেষ্টায় দুবছর আগেও কম ছিল। শুধু উচ্চস্তর বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছেলেরা সংখ্যায় অনেক এগিয়ে। মেয়েদের পরীক্ষার রেজাল্ট ছেলেদের চেয়ে ভাল। সব কর্মক্ষেত্রে কমবেশি মেয়েদের দীপ্ত পদচারণা লক্ষণীয়। স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ছে। পর্বত জয়, খেলাধুলায় মেয়েদের সাফল্যে মন ভরে যায় আনন্দ-উল্লাসে। অগ্রগতির সোপানে দাঁড়িয়ে এ কথা কবুল করতেই হয় যে, অনেক করণীয় এখনও আমরা সঠিকভাবে করতে সক্ষম হয়ে উঠিনি। যে কারণে বাল্যবিয়ের হার হ্রাস, কিশোরীদের আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে সফল হচ্ছি কম। নারীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় যুক্ত। (চলবে)
×