ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এখানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়...

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৪ অক্টোবর ২০১৬

এখানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়...

সমুদ্র হক ॥ প্রজাপতি রঙিন পাখনা মেলে নাচতে শুরু করেছে। কত রঙের কত বর্ণের যে প্রজাপতি উড়ছে তা গুনে শেষ করা যায় না। প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রজাপতিকে নিয়ে শিল্পী কবি সাহিত্যিকরা লিখেছেন কতই না গান কবিতা। ‘প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গিন পাখা...’। এই গান সুর হয়ে বাজলেই চোখে ভেসে আসে প্রজাপতিগুলো উড়ে আসছে। প্রকৃতিকে রূপ আর রসে ভরে দিতে ফুলের বনে ঝাউ বনে নদী তীরে উড়ে উড়ে ধ্রুপদী নাচ শুরু করে দেয়। এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে প্রজাপতির অপার মধুময়তা। নানা রঙের নানা নক্সার প্রজাপতিকে দেখে মনে হবে বিধাতা রং তুলি দিয়ে ওদের পাখা এঁকে দিয়েছেন। প্রতিটি পাখা যেন একেকটি ছবি। যে ছবি দেখে কবি সাহিত্যিকরা খুঁজে পান সাহিত্যের ভাষা। কবিতা আসে মানব হৃদয়ে। শিল্পী খুঁজে পায় সুর। প্রকৃতিপ্রেমী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে প্রজাপতির পাখার দিকে। টেক্সটাইল শিল্পীরা খুঁজে পায় কাপড়ের নক্সা। প্রজাপতিগুলো ফুলে ফুলে নাচের তালে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে নববধূ রূপে। সৌন্দর্যের এমনই ছোঁয়ায় যেন চোখ ফেরানো যায় না। প্রজাপতি হঠাৎ করেই রঙ ছড়ানো শুরু করল কেন! এরও উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। প্রজাপতির পরাগায়নের সময় শরতের শেষ ভাগে শুরু হয়ে চলে বৈশাখের মধ্যভাগ পর্যন্ত। এই সময়ে প্রজাপতি আপন রঙে আরও রঙিন হয়ে রাঙিয়ে তোলে ভুবন। মাতিয়ে তোলে সুরের ছন্দ। নেচে নেচে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে উড়ে চলে। এই নৃত্য যেন থামতেই চায় না। ওরা চায় প্রকৃতিও ওদের সঙ্গে নেচে উঠুক। জীব-বৈচিত্র্যের প্রজাপতি লেপিডোপেট্রা বর্গের এক ধরনের মথ জাতীয় পতঙ্গ। বৈজ্ঞানিক নাম ‘ট্রয়ডিস’। শরীর উজ্জ্বল রঙের। দেখতে অনিন্দ্য সুন্দর। দৃষ্টিনন্দন। ছেলেবেলায় প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়ায়নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি! এত সুন্দর যে পতঙ্গ বিশ্বে প্রথম তার দেখা মেলে ৩ হাজার বছর আগে মিসরের থিবসে এলাকায়। তারপর বিশ্বের মানুষের দৃষ্টিতে আসে। পরে দেখা যায় বিশ্বের প্রতিটি দেশেই প্রজাপতির অস্তিত্ব আছে। এরা উড়ে বেড়ায় বনে। অনেক পরে এরা মানুষের চোখের সামনে উড়ে বেড়াতে শুরু করে। ভয়ও করে। এদের ভয়ের কারণ রঙিন পাখা। প্রজাপতিকে ধরে এনে শিশু-কিশোররা খেলে। কখনও কাঁচের গ্লাসে বন্দী করে রাখে। অনেক সময় মানুষের নিষ্ঠুরতার মধ্যেও পড়ে তারা। দেহ থেকে পাখা বিচ্ছিন্ন করে মেরে ফেলা হয় প্রজাপতিকে। বিজ্ঞানীরা প্রজাপতির ইংরেজী নাম নির্ণয় করেন বাটার চান ও বাটার ফ্লেজ শব্দের সমন্বয়ে বাটারফ্লাই। গোটা বিশ্বে প্রজাপতির ৬শ’ থেকে ২০ হাজার প্রজাতি আছে। এর মধ্যে ২শ’ ৬০ প্রজাতির প্রজাপতি আছে বাংলাদেশে। এত বেশি প্রজাতির প্রজাপতি বিশ্বের আর কোন দেশে নেই। সবচেয়ে বড় প্রজাপতির দেখা মেলে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এইসব দেশের বনে বড় প্রজাপতিগুলো সরু লিকলিকে হওয়ায় অনেক সময় ছোট পাখি বলে ভ্রম হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রজাপতির পাখার দৈর্ঘ পাওয়া যায় ১১ ইঞ্চি (২৮ সেন্টিমিটার)। এই প্রজাপতিকে সংগ্রহ করতে হয় তীর ছুঁড়ে। বড় এই প্রজাপতির নাম দেয়া হয় বার্ড উইং। প্রজাপতির উড়ে যাওয়া বৈচিত্র্যময়। ওড়ার সময় দুই পাখনা তালে তালে নাচিয়ে কখনও উপরে কখনও নিচে কখনও সমান্তরাল হয়ে উড়ে যায়। মনে হবে ক্লাসিক্যাল ফ্লাইং। প্রজাপতি দ্রুত লয়ে উড়লে ঘণ্টায় গতিবেগ হয় ৪০ কিলোমিটার। স্বাভাবিক উড়লে প্রতি ঘণ্টায় অতিক্রম করতে পারে ২৫ কিলোমিটার। বিশ্বে ইকো ট্যুরিজম গড়ে উঠেছে প্রজাপতিকে ঘিরে। ফুল ও বৃক্ষের সঙ্গে প্রজাপতির রয়েছে অত্যন্ত নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক। সবচেয়ে মজার বিষয় একেক প্রজাতির প্রজাপতি একেক ধরনের বৃক্ষ পছন্দ করে। প্রজাপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সকল ধরনের বৃক্ষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রজাপতির মাধ্যমে ফুল ও বৃক্ষের পরাগায়ন ঘটে। প্রজাপতিকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে ফুল। ফুলের সঙ্গেই যেন প্রজাপতির সখ্য বেশি। ফুল ছাড়া প্রজাপতি বেমানান। মানুষের হৃদয়ানন্দে প্রজাপতির ভূমিকা কম নয়। কারও মন যত বিষণœতায় ভরা থাক চোখের সামনে প্রজাপতির নাচন দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যকার রোমান্টিকতার দুয়ার খুলে যায়। প্রজাপতিকে কেউ আবার রোমান্টিকতার ছন্দ মনে করে। মানব মনের যত রোমান্টিসিজম আছে তার সকল অনুসঙ্গই খুঁজে পাওয়া যায় প্রজাপতির ওড়ার ছন্দে। প্রজাপতি যেন এক হৃদয় থেকে আরেক হৃদয়ে উড়ে যাওয়ার প্রতীক। সুর হয়ে বাজে ‘এখানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়......’।
×