ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দায়িত্বহীনতায় গোধূলি এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুতি

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দায়িত্বহীনতায় গোধূলি এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুতি

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বহীনতায় চট্টগ্রামে বুধবার বিকেলে ঢাকামুখী মহানগর গোধূলী এক্সপ্রেস ট্রেনের চারটি কোচের লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। এমন ধারণা করছেন ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী পূর্বাঞ্চলীয় রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পাহাড়তলী স্টেশনের আউটার সিগন্যালের আগে থাকা আপ লাইন থেকে ডাউন লাইনের ক্রসিং দীর্ঘ ১০ বছরেও রক্ষণাবেক্ষণ না করা। প্রায় ২০ ফুট দীর্ঘ ক্রস লাইনের সিøপার পচে যাওয়ায় এ দুর্ঘটনা। পাহাড়তলী স্টেশন থেকে ক্রসিং পয়েন্টের সুইচ দেয়ার পর ট্রেনের ১৮ কোচ পার হওয়ার আগেই ওভারস্পীড দেন চালক। এতেই ট্রেনের ৪ কোচ লাইনচ্যুত। ১১ ঘণ্টা পর বুধবার গভীর রাত থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে আপ লাইনে। ডাউন লাইন ব্লক ছিল আরও ১৩ ঘণ্ট.া। সর্বশেষ আপ ডাউন দুটি লাইন সচল হয়েছে বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায়। এদিকে, এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। চীফ অপারেটিং সুপারিন্টেনডেন্টকে (সিওপিএস) প্রধান করে ৫ সদস্যের ও ডিভিশনাল ট্রাফিক অফিসার(ডিটিও) ফিরোজ ইফতেখারকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আগামী সাত কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার কথা রয়েছে। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর রেল কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন, রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি ও ক্রসিংয়ে ওভারস্পীডের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এই ঘটনায় ১০ যাত্রী আহত হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়তলী থেকে অনির্ধারিত যাত্রা বিরতির পর ট্রেন ছেড়ে গেলেও মাত্র তিন মিনিটের ব্যবধানে পাহাড়তলী স্টেশনের আউটার সিগন্যালের আগেই ট্রেনটি আকস্মিক ওভারস্পীডের কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। প্রধান প্রকৌশলীর দফতরের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ ঘটনা ঘটেছে। আপ থেকে ডাউন লাইনের প্রায় ২০ ফুট লম্বা লাইনের ক্রসিং ট্র্যাক সংস্কার দীর্ঘ ২০ বছরেও হাত দেয়া হয়নি। সরেজমিনে দেখা গেছে, কাঠের শতাধিক সিøপার পচে নষ্ট হয়ে গেছে। পাথর ছিল না এই ক্রসিং লাইনে। ফলে সহকারী স্টেশন মাস্টার (এএসএম) কন্ট্রোল ট্রেন পাসিংয়ের পয়েন্ট আউট দেয়ায় মহানগর গোধূলীর ১৮ কোচের মধ্যে বারোটি পার হওয়ার পর পয়েন্ট হিল বিকট শব্দে ভেঙ্গে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। ফলে গার্ডব্রেকসহ তিনটি কোচ ক্রসিং পয়েন্টের কাছেই ও একটি কোচ ছিটকে প্রায় ৫০ ফুট দূরে থাকা ৯ নং কালভার্টের ওপর পড়ে। এতে কালভার্টেও ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, ঢাকাগামী মহানগর গোধূলী এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম স্টেশন ছাড়ে বুধবার বিকেল তিনটায়। বিকেল তিনটা ১০ মিনিটে পাহাড়তলী স্টেশনে পৌঁছে অনির্ধারিত যাত্র বিরতি করে ৮মিনিট। বিকেল তিনটা ১৮ মিনিটে কন্ট্রেল রুম থেকে পাসিং সিগন্যাল দেয়ার পর ছেড়ে যায়। কিন্তু ৩ মিনিট পরই আপ লাইন থেকে ডাউন লাইনে যাবার সময় ক্রসিং পয়েন্টে ওভারস্পীড দেয়ায় দুর্ঘটনা ঘটে। ফলে ট্রেনের গার্ডব্রেকসহ পেছনের দিকের দুটি যাত্রীবাহী এসি বার্থ কোচ ও একটি খাবারের কোচ পড়ে যায়। ক্রসিং থেকে ডাউন লাইনে ওঠার আগেই ওভারস্পীড দেয়ায় ক্রসিং পয়েন্টের পয়েন্ট হিল ভেঙ্গে কয়েক টুকরা হয়ে যায়। ফলে দুটি কোচের সংযোগস্থল খুলে প্রায় ৫০ ফুট দূরে ছিটকে আরও একটি এসি চেয়ার কোচ আপ লাইনের ওপর পড়ে যায়। এতে আপ এবং ডাউন উভয় লাইন ব্লক হয়ে যায়। পরে চারটা ৩৫ মিনিটে পাঁচটি কোচ রেখে ১২ কোচ নিয়ে ট্রেনটি পুনরায় ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এরপর পাহাড়তলী থেকে ‘এ’ ক্লাস রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও উদ্ধার অভিযান চালাতে পারেনি। রিলিফ ট্রেনটি ফৌজদারহাট স্টেশনে ফিরে যায়। এর আগে বুধবার সকালে চট্টগ্রামের সিজিপিওয়াই থেকে ছেড়ে আসা কন্টেনারবাহী রিলিফ ট্রেন ফৌজদারহাট স্টেশন এলাকায় আপ লাইনের ওপর ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে যায়। এর পর থেকে ঐ এলাকায় আপ লাইন বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। প্রায় তিন ঘণ্টা পর পাহাড়তলী ও লাকসাম থেকে আসা দুটি রিলিফ ট্রেন এসে উদ্ধার কাজ শুরু করে। প্রায় ১১ ঘণ্টা চেষ্টার পর চারটি কোচ ডাউন লাইন মেরামতের কোচগুলো লাইনে ওঠানো সম্ভব হয়। কিন্তু একটি কোচের দুটি বগি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় ডাউন লাইন ক্লিয়ার হয়েছে। ঘটনার পর পর পরিদর্শনে আসেন চীফ সিগন্যালিং এ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার (সিএসটিই), ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম), ডিভিশনাল ট্রাফিক অফিসার (ডিটিও), ডিভিশনাল কমার্শিয়াল অফিসার (ডিসিও), ডিভিশনাল ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (ডিইই)। রাত আটটার পর ঢাকা থেকে ছুটে আসেন পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার, চীফ ইঞ্জিনিয়ার, চীফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারসহ কয়েক কর্মকর্তা। ঈদের কারণে এসব কর্মকর্তা ঢাকায় থাকলেও দুর্ঘটনার কারণে ছুটে এসেছেন। এছাড়াও ঘটনাস্থলে র‌্যাব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ জিআরপি ও আরএনবি সদস্যরা উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছেন। বুধবার বিকেল পাঁচটার পর থেকে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। রাত আটটার দিকে পাহাড়তলী ও লাকসামের দুটি রিলিফ ট্রেন আসার পর পুরোদমে উদ্ধার কাজ শুরু হয়। একে একে চারটি কোচ তুলতে রাত প্রায় পৌনে দুটা বেজেছে। ২৪ ঘণ্টা পর ডাউন লাইন ক্লিয়ার হয়েছে বৃহস্পতিবার বিকেল চারটা নাগাদ। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও সিলেটগামী অনেক ট্রেনের বিলম্বের কারণে যাত্রী ভোগান্তি চরমে পৌঁছে। তবুও রেল কর্তৃপক্ষ কোন ট্রেনের যাত্রা বাতিল করেনি। এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন রুটের ট্রেন চলাচল যেমন বন্ধ ছিল প্রায় আপ লাইনে প্রায় ১২ ঘণ্টা তেমনি বিভিন্ন রুট থেকে চট্টগ্রামেও কোন ট্রেন প্রবেশ করতে পারেনি। তবে ডাউন লাইন এরপর আর ৪/৫ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে বুধবার রাতে রেলের জিএমসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে এক বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘটনার কারণ উদঘাটনে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান হলেন ডিটিও ফিরোজ ইফতেখার। কমিটি আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করবে। এ ব্যাপারে রেলের পূর্বাঞ্চলীয় ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার জনকণ্ঠকে জানান, রেলের জিএমসহ উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ঘটনার কারণ তদন্তে মোট ৯ সদস্যের দুটি কমিটি গঠিত হয়েছে। আপ লাইন বুধবার রাত একটা ৪০ মিনিটের সময় আর ডাউন লাইন বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় চলাচল উপযোগী হয়েছে।
×