ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মায়ের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

বঙ্গমাতার দূরদর্শিতাই বাংলার স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিল

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৯ আগস্ট ২০১৬

বঙ্গমাতার দূরদর্শিতাই বাংলার স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গিনী হিসেবে নেপথ্যে থেকে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা স্মরণ করে বলেছেন, এই মহীয়সী নারীর দূরদর্শিতা বাংলার স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের তৎকালীন অনেক নেতার আপত্তি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সর্বক্ষণিক এই ছায়াসঙ্গী বেগম মুজিবই তাঁকে (বঙ্গবন্ধু) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে পাক সামরিক বাহিনী সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসতে নিষেধ করে স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিলেন। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বৈঠকে বসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসত না। স্মৃতিচারণে তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, লড়াই-সংগ্রামে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু কখনও মাকে (ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। একটা মানুষের চরিত্র কতটা দৃঢ় থাকলে যে কোন অবস্থা মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারে। বঙ্গমাতা দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সবসময় বঙ্গবন্ধুকে সাহস, শক্তি, প্রেরণা দিয়েছেন, কখনও বঙ্গবন্ধুকে পেছন থেকে টেনে ধরেননি। তিনি বলেন, জীবনে যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তা আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) করেছেন। প্রতিটি কাজ যে তিনি করেছেন, আমার মা কিন্তু ছায়ার মতো তাঁকে সাহায্য করে গেছেন। কখনও এ ব্যাপারে অভিযোগ-অনুযোগ তিনি করেননি। যত কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনই বলেননি যে, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার কর বা সংসারের খরচ দাও। কোনদিন জীবনের কোন প্রয়োজনে বাবাকে কখনও বিরক্ত করেননি। বরং আব্বা যে পদক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি। সোমবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৬তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সেই ছোটবেলা থেকে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে তাঁর মায়ের দীর্ঘ সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্র বয়স থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। তখন সংসার, মামলা ও সংগঠন চালানোয় ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন তিনি। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তৃতা করেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান সেলিনা হোসেন। বক্তব্য রাখেন নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেবেকা মোমেন এমপি এবং জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক মমতাজ বেগম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম এনডিসি। অনুষ্ঠানে বেগম মুজিবের জীবনভিত্তিক একটি প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মা একটি টাকাও খরচ করতেন না, জমিয়ে রাখতেন। পরে সেসব টাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক কার্যক্রম, আন্দোলন-সংগ্রাম আর মানুষের কল্যাণে সেসব অর্থ কাজে লাগিয়েছেন। আমার মা নেপথ্য থেকে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময় ছাত্রলীগকে তিনি নিজের হাতে গড়ে তুলতেন। ছাত্রলীগকে সবসময় পরামর্শ দেয়া, তাদের যা কিছু দরকার তিনিই দেখতেন। সংগঠন চালানোর প্রয়োজনে গহনা থেকে শুরু করে ঘরের ফ্রিজ পর্যন্ত বিক্রি করেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। শেখ হাসিনা বলেন, আগস্ট মাস, শোকের মাস। আর এ মাসেই আমার ছোট ভাই শেখ রাসেলও জন্মগ্রহণ করেছিল। আবার এ মাসেই আমার পরিবারের সদস্যদের ঘাতকরা গুলি করে হত্যা করে। মায়ের স্মৃতিচারণ করে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বড় সন্তান শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মা অভাব-অনটন কখনও বুঝতে দিতেন না। যেদিন ঘরে অন্য খাবার থাকত না, সেদিন সামান্য চাল-ডালের খিচুরি রেঁধে আচার দিয়ে খেতে দিতেন আমাদের। আমাদের বুঝতে না দিয়ে তখন মা বলতেন, আসো আজকে আমরা গরিব খিচুরি খাব। ঘরে খাবার না থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অকাতরে সাহায্য করতেন তিনি। দলের কাজকর্ম, আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন মেটাতে নিজের সম্পদ দিয়ে সাহায্য করতেন মা। মা-বাবা কখনও আমাদের অভাব বুঝতে দেননি। কৌশলে সেসব অভাব মেটাতেন আর আমাদের ভিন্নভাবে বোঝাতেন। আবেগজড়িত কন্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজের জন্য কখনও কিছু চাননি বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। সারাজীবন দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। এ দেশকে তিনি গভীরভাবে ভালবাসতেন। আব্বার সঙ্গে থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন, এদেশের মানুষ ভাল থাকবে, সুখে-শান্তিতে বাস করবে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবার পাশে থেকে সে স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করেছেন। তিনি বলেন, মানুষ মন্ত্রিত্বের জন্য দল ছাড়েন আর বাবা দলের জন্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখনও আমার মা এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে কোন অনুযোগ করেননি। বরং তাঁর সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন। তিনি বলেন, বাবা জীবনে বড় বড় ঝুঁকি নিয়েছেন, আর সব সময় মা প্রেরণা দিয়েছেন। বাবা অধিকাংশ সময় জেলে থাকতেন আর আন্দোলন-সংগ্রামে নেতাকর্মী ও ছাত্রদের পরামর্শ-নির্দেশনা দিতেন মা। রাজনৈতিকভাবে অনেক সচেতন ছিলেন তিনি। বঙ্গমাতাই বোধ হয় সবচেয়ে আগে জানতেন, এই দেশ একদিন স্বাধীন হবে। বাবা মন্ত্রী-এমপি হলেও এজন্য তিনি (বেগম মুজিব) কোনদিন করাচিতে যাননি, যেতেও চাননি। এমনকি ভুট্টো ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবার কাছে এলে মা তার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেননি। মা বলেছিলেন, ওদের সঙ্গে থাকব না, দেখা করব কেন? এভাবেই স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে আটকাবস্থা থেকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায় পাক সামরিক সরকার। পাঁচ মাস পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কোন হদিস ছিল না, আমরা জানতেও পারিনি তিনি বেঁচে আছেন কি না। এরপরে কোর্টেই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার সুযোগ হয়। তখন পাকিস্তান সরকার আম্মাকে ভয় দেখান, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি না নিলে তিনি বিধবা হবেন। মা সোজা বলে দিলেন, কোন প্যারোলে মুক্তি হবে না। নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে কোন মুক্তি হবে না। তিনি বলেন, আমি মায়ের সিদ্ধান্তের কথা কোর্টে যখন বঙ্গবন্ধুকে জানালাম তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখেছি আমাকে বলতে, তুমি কেমন মেয়ে-বাবার মুক্তি চাও না? আম্মাকে বলেছে-ভাবি আপনি কিন্তু বিধবা হবেন। আমার মা তখন কঠিনস্বরেই বলেছেন, প্যারোলে মুক্তি নিলে মামলার আর ৩৪ আসামির কী হবে? এরপর বঙ্গবন্ধু প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। একটা সময় ছয় দফা না আট দফা হবে তা নিয়ে মতবিরোধে ‘অনেক’ আওয়ামী লীগ নেতাও আট দফার পক্ষে চলে গিয়েছিলেন বলে জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ছয় দফা থেকে একচুলও এদিক ওদিক যাবে না এইটেই ছিল তাঁর সিদ্ধান্ত-এটা আব্বা বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের নেতারা উঠে পড়ে লাগলেন। আট দফা খুবই ভাল, আট দফা মানতে হবে। তখন তাঁর মায়ের ছয় দফার পক্ষের অবস্থানের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, মা বলেছিলেন, শুধু এটুকুই বুঝি ছয় দফাই হচ্ছে বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ। এটা উনি (বঙ্গবন্ধু) বলে গেছেন। এইটেই মানি। এর বাইরে কিছু মানি না। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার সময় সেখান থেকে দলের জন্য কীভাবে তাঁর মা নির্দেশনা নিয়ে আসতেন তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মায়ের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। আমরা মাঝে মাঝে বলতাম তুমি তো মিনি টেপ রেকর্ডার। আমাদের শিখিয়ে নিয়ে যেতেন কারাগারে, সেখানে গিয়ে কি করতে হবে সেটাও জানিয়ে দিতেন। বাইরের সমস্ত রিপোর্ট আব্বাকে দেয়া এবং আব্বার নির্দেশটা নিয়ে আসা। এরপর সেটা ছাত্রদের জানানো। সেøাগান থেকে শুরু করে বলতে গেলে সবকিছুই কিন্তু বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে নির্দেশ দিয়ে দিতেন। সেইভাবেই কিন্তু মা ছাত্রলীগকে কাজে লাগাতেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমার আব্বা যখন মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ ছিলেন, করাচীতে যেতেন, আমার মা কিন্তু জীবনে একদিনও করাচীতে যাননি। কোনদিন যেতে চাননি। তিনি বলেন, রাজনীতিতে তাঁর (বেগম মুজিব) যে দূরদর্শিতা, সেটাই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছে। কারণ সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু প্যারোলে যেতেন তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। সাতই মার্চের ভাষণেও মায়ের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কোন কোন নেতা বললেন এখনই বলে দিতে হবে আজ থেকে স্বাধীন। কেউ বললেন এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। কেউ কেউ এসে বলেছেন এটাই করতে হবে, না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অমুক হবে, তমুক হবে...। এরকম বস্তা বস্তা কাগজ আর পরামর্শ। শেখ হাসিনা বলেন, কোন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেতে হলে বঙ্গবন্ধুকে ‘নিজের ঘরে কিছুক্ষণ নিজের মতো’ থাকতে পরামর্শ দিতেন তাঁর মা। ৭ মার্চের ভাষণ দিতে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে একাকী নিয়ে গিয়ে আমার মা বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘সারাজীবন তুমি সংগ্রাম করেছ, জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছ, তুমিই জান এদেশের মানুষ কি চায়, সেটা তোমার থেকে কেউ বেশি জানে না। সারাদেশ থেকে লাখ লাখ লোক এসেছে। কাজেই তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সে কথাই বলবে। কারও কথা তোমার শুনতে হবে না।’ ঠিক তাই হয়েছিল এই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। হাতে কোন কাগজও ছিল না। কিছুই ছিল না। নিজের মন থেকেই পৃথিবীর অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। সভাপতির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, একজন মানুষের প্রেরণায় নারীর যে কি ভূমিকা তা বঙ্গমাতাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। কারণ বঙ্গবন্ধু সারাজীবন জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। অর্ধেক জীবনই জেলে কাটিয়েছেন। সে সময় দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখা, ছাত্রলীগকে অর্থ প্রদানসহ সব কিছু বঙ্গমাতাই করেছেন। তাঁর প্রেরণায় জাতির জনক আমাদের স্বাধীনতা এনে দিতে পেরেছিলেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×