ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মওদুদকে বাড়ি ছাড়তেই হচ্ছে ॥ নাম জারির রায় আপীলে বাতিল

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩ আগস্ট ২০১৬

মওদুদকে বাড়ি ছাড়তেই হচ্ছে ॥ নাম জারির রায় আপীলে বাতিল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তিন দশক ধরে যে বাড়িতে বসবাস করে আসছেন, সেই বাড়ি তার ভাই মনজুর আহমদের নামে মিউটেশন (নামজারি) ও ডিক্রি জারি করতে হাইকোর্টের দেয়া রায় আপীল বিভাগে বাতিল হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে মওদুদের বিরুদ্ধে সরকারী বাড়ি আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলাও আর টিকছে না। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের ফলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা মওদুদ আহমদকে গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ১৫৯ নম্বর প্লটের ওই বাড়ি হারাতে হচ্ছে। অন্যদিকে ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমিন ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনের সম্পদের হিসাব সংক্রান্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের দেয়া নোটিসের কার্যক্রম মঙ্গলবার স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। ফলে আপাতত সম্পদের হিসাব দিতে হচ্ছে না ডেসটিনির এমডি ও চেয়ারম্যানকে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এর ফলে বাড়িটি মওদুদ আহমদের ভাইয়ের নামে নামজারি করতে হবে না এবং ভাইয়ের নামে দখল করা বাড়িটি মওদুদকে ছাড়তে হবে। মনজুর আহমদের নামে নামজারি করতে হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিলে রাজউকের করা আপীল মঞ্জুর করেছে আদালত। তবে দুদকের মামলাটির অভিযোগ আমলে নেয়া বৈধ বলে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে মওদুদ ও তার ভাই মনজুরের করা আপীল মঞ্জুর করায় মামলাটি বাতিল হয়ে গেছে। ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল বলেছেন মওদুদের ওই বাড়িটি রাজউক এখন নিজেদের তত্ত্বাবধানে নেবে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকে ও রাষ্ট্রপক্ষের করা তিনটি আপীল মঞ্জুর করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপীলবেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় দেয়। পাশাপাশি ওই বাড়ি নিয়ে দুদকের মামলায় অভিযোগ আমলে নেয়াকে বৈধতা দিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে মওদুদ ও তার ভাইয়ের করা লিভ টু আপীলও সর্বোচ্চ আদালত নিষ্পত্তি করে দিয়েছে। ফলে মামলাটি বাতিল হয়ে গেছে। আপীল বিভাগে রাজউক ও রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। আর মওদুদের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও মাহবুব উদ্দিন খোকন। মওদুদ নিজেও শুনানিতে অংশ নেন। রায়ের পর টুটুল সাংবাদিকদের বলেন, মওদুদের ভাইয়ের নামে ওই প্লটের বায়না চুক্তিতে তারিখ দেখানো হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ১০ অগাস্ট। কিন্তু ওই বাড়ির মালিক অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজ মারা যান ১৯৮৫ সালের ৩০ মার্চ। অর্থাৎ বায়নানামাটি ছিল ‘ভুয়া’। ১৯৭২ সাল থেকে মওদুদ আহমদ গুলশানের এই বাড়িতে বসবাস করে আসছেন বলে দুদকের তথ্য। এক বিঘা ১৩ কাঠা জমির ওপর ওই বাড়ি অবৈধভাবে দখল ও আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর গুলশান থানায় মওদুদ ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে এই মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক হারুনুর রশীদ। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৪ সালের ২৬ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দিলে ওই বছর ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক তা আমলে নেন। অভিযোগে বলা হয়, গুলশানের যে বাড়িটিতে মওদুদ আহমদ ও তার পরিবার থাকছেন, তার প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানী নাগরিক মোঃ এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে এই বাড়ির মালিকানা এহসান পান। ১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। ওই বছরই মওদুদ ওই বাড়ির দখল নেন। এরপর ১৯৭৩ সালের ২ আগস্ট তারিখে তিনি ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে একটি ‘ভুয়া’ আমমোক্তারনামা তৈরি করান এবং নিজেকে তার ভাড়াটিয়া হিসেবে দেখিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। কবি জসীম উদ্্দীনের জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মপক্ষ সমর্থন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দুদকের মামলায় বলা হয়, জিয়া সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মওদুদ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে গুলশানের ওই বাড়ি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করেন। এর ধারাবাহিকতায় মাত্র ১০০ টাকা মূল্য দেখিয়ে ১৯৮০ সালে প্লটটি তিনি বরাদ্দ নেন। পরে তিনি একটি বায়নানামা ‘হাজির করেন’, যেখানে দেখানো হয়, ওই বাড়ির মালিক ইনজে মারিয়া প্লাজ জনৈক মহসিন দরবারকে আমমোক্তার বানিয়েছেন এবং সেই মহসিন দরবার ১৯৮৫ সালে বাড়িটি মওদুদের সহোদর মনজুর আহমদের নামে বায়না করে দিয়েছেন। মওদুদ ওই অভিযোগ আমলে নেয়ার আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে গতবছর ২৩ জুন হাইকোর্ট তা খারিজ করে দেয়। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে মওদুদ আপীলের আবেদন করলে আপীল বিভাগ তা মঞ্জুর করে। মঙ্গলবার আপীল বিভাগ তার নিষ্পত্তি করে দেয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন মওদুদ ও তার ভাই। রায়ের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘মওদুদ আহমদের ভাইকে উচ্ছেদের জন্য সরকার মামলা করেনি। মওদুদ আহমদের ভাই নিজেই মামলা করেছিলেন।’ হাইকোর্ট মওদুদের ভাই মনজুর আহমদের নামে নামজারি করতে নির্দেশ দেয়ার পর নিজে অস্ট্রিয়া গিয়েছিলেন বলে এ্যাটর্নি জেনারেল জানান।‘সেখানে গিয়ে বাড়ির মালিক অস্ট্রীয় নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যু সনদ নিয়ে আসি। আমরা আপীল বিভাগে দেখাতে সক্ষম হয়েছি যে, মওদুদ আহমদের ভাই যে তারিখে চুক্তিনামা করেছিলেন, তার আগেই মারিয়া মারা গেছেন।’ অন্যদিকে ব্যারিস্টার মওদুদ রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাত বছর পর প্রতিহিংসাবশত সরকার আপীল করেছে। ১৯৮১ সাল থেকে আমরা এই বাড়িটিতে বসবাস করছি। এটি ক্রয় করা বাড়ি, সরকারের বাড়ি নয়। আপীল বিভাগের রায় দেখে আমরা অবশ্যই রিভিউ করব। নোটিসের কার্যক্রম স্থগিত ॥ ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমিন ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনের সম্পদের হিসাব সংক্রান্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের দেয়া নোটিসের কার্যক্রম মঙ্গলবার স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। ফলে আপাতত সম্পদের হিসাব দিতে হচ্ছে না ডেসটিনির এমডি ও চেয়ারম্যানকে। একইসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিধিমালার ১৭ (২) (৪) ধারা কেন বেআইনী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত। দুদকের নোটিস চ্যালেঞ্জ করে ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডির করা রিটের শুনানি শেষে মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ রহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি বিশ্বদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালতে ডেসটিনির পক্ষে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি শুনানি করেন। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ও অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল নাজিবুর রহমান।
×