ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও ওষুধের সঙ্কট

বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা ॥ পানিবন্দী সাড়ে ৩ লাখ মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৯ জুলাই ২০১৬

বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা ॥ পানিবন্দী সাড়ে ৩ লাখ মানুষ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলমান বন্যা দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দুই সপ্তাহ ধরে চলা বন্যায় বাড়তে বাড়তে পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখে পৌঁছে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকার আয়তন ও পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি বৃহস্পতিবারও অব্যাহত থাকে। বন্যার পানিতে ডুবে গাইবান্ধা ও জামালপুরে ১ জন করে এবং বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে জামালপুরে ১ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সেই সঙ্গে ভাঙ্গনের মুখে পড়ে বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। ভাঙ্গনের শিকার হয়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে সহস্রাধিক পরিবারের ভিটেমাটি। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের সঙ্কট বেড়েই চলেছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া জমিতে থাকা ফসলাদি ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন কৃষকরা। বন্যাকবলিত সব এলাকার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনানুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। তীব্র স্রোতে শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দুই পারে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ৫ শতাধিক যান পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে যাত্রীরা। পর্যবেক্ষণাধীন ৯০টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে বৃহস্পতিবার ৫৮টির পানি বৃদ্ধি পায়। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের সব প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৭টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যসমূহে ভারিবর্ষণ ও বন্যা অব্যাহত থাকে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। আগামী দু’দিন দেশে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বন্যাকবলিত এলাকা ও বন্যার্ত মানুষ ॥ বন্যাকবলিত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ জামালপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, সুনামগঞ্জ, পঞ্চগড়, ফরিদপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ। ফরিদপুরের ১১টি ইউনিয়নের ১৫ হাজার পরিবার, লালমনিরহাটের ২৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার পরিবার, সিরাজগঞ্জের ৩১টি ইউনিয়নের সাড়ে ৭ হাজার পরিবার, বগুড়ার ৮৭টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার পরিবার, মুন্সীগঞ্জে কয়েক হাজার পরিবার, নীলফামারীর ১৫ হাজার পরিবার, জামালপুর জেলার ৪০টি ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ মানুষ, গাইবান্ধার ২২টি ইউনিয়নের ৭০টি গ্রামের ২০ হাজার পরিবারের ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ, কুড়িগ্রামের ৫৬টি ইউনিয়নের ৭১৯টি গ্রামের সোয়া ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার গাইবান্ধার নতুন ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাস ॥ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী রিপন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা ও কুশিয়ারা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদ-নদী সংলগ্ন গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ জেলাসমূহের নিম্নাঞ্চলে এবং গঙ্গা-পদ্মা নদী সংলগ্ন রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলাসমূহের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ধরলা নদী কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চলে ও সুরমা নদীর পানি কমে সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে ঢাকার আশপাশের বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা প্রভৃতি নদ-নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। নিজস্ব সংবাদদাতা গাইবান্ধা থেকে জানান, গাইবান্ধা জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি হয়েছে। মাছ ধরতে গিয়ে সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা সদর ইউনিয়নের বাঁশহাটা গ্রামের নুরুন্নবী মিয়া (৩৫) বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। ফুলছড়ি উপজেলার ৯ কিমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ওই এলাকার পশ্চিম পাড়ের প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে থেকে জানান, কুড়িগ্রামে ১১তম দিনে বানভাসীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সোয়া ৬ লাখে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানিবন্দী মানুষের ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে। বিপুলসংখ্যক বানভাসী মানুষের জন্য সরকারী ত্রাণ অপ্রতুল। দুর্গম চরের মানুষ বন্যা ও বৃষ্টির মধ্যে অমানবিক জীবনযাপন করছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর খাদ্য ও পানিবাহিত রোগ। বৃহস্পতিবার বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে নারু দাস (১৫) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত পানিতে ডুবে সলিল সমাধি হয়েছে ৩ জনের। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলায় বন্যাকবলিত দেড় লাখ পরিবারের মধ্যে সোয়া ৬ লাখ মানুষ বন্যায় ভাসছে। ৭৭টি গবাদিপশু মারা গেছে। নিজস্ব সংবাদদাতা জামালপুর থেকে জানান, জামালপুরের বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে দীর্ঘ ২৮ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে যমুনার পানি। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ১৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা পর্যন্ত বিপদসীমার ১১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি ঢুকছে নতুন নতুন এলাকায়। জেলার সাত উপজেলার মধ্যে ৬টি উপজেলাই এখন বন্যাকবলিত। ৪০টি ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাবার, গো-খাদ্যের সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। বন্যার কারণে জেলার ২৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা শিক্ষা অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান। বন্যার পানিতে ডুবে ইসলামপুর উপজেলার মুখশিমলা গামারিয়া গ্রামের ছবেদ আলীর ছেলে সোলায়মান (৯) মারা গেছে। স্টাফ রিপোর্টার নীলফামারী থেকে জানান, তিস্তা নদীর গতিপথ পাল্টে যাওয়ায় উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চরখড়িবাড়ি, পূর্বখড়িবাড়ি মৌজার ১৬ গ্রামের ভেতর দিয়ে তিস্তা নদীর পানি এখনও প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ওই সব গ্রামের ১৫ হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি, হাটবাজার, স্কুল বানের পানিতে তলিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে ১ হাজার ৩৫০ পরিবার। স্টাফ রিপোর্টার মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, মুন্সীগঞ্জে বৃহস্পতিবার নিম্নাঞ্চলের আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। পদ্মা তীরের বাড়িঘর জলমগ্ন ছাড়াও বহু ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। চর এলাকায় বানভাসী মানুষের কষ্ট বেশি। অনেক শিক্ষালয় জলমগ্ন হয়েছে। মাওয়ার কাছে জসলদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং জসলদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া থেকে জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দির বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যাকবলিত ৩ উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ১২৬টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বিশুদ্ধ পানি, খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বেড়ে চলেছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। স্টাফ রিপোর্টার সিরাজগঞ্জ থেকে জানান, সিরাজগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে জেলায় নতুন করে আরও ৭টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বন্যায় ৭৩০০ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। এর মধ্যে আউশ, পাট, বোনা আমন, সবজি, বীজতলা, রোপা আমন ও কলা রয়েছে। বন্যায় ১৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠার কারণে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা লালমনিরহাট থেকে জানান, লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খাবারের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তিস্তা নদীগর্ভে ৭শ’ ৯০টি পরিবারের বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। জেলায় ১৬ লাখ টাকা, ৭০০ টন চাল ও দুই হাজার ৭৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২৬টি ইউনিয়নে ৪৯ হাজার ৬১০টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা ফরিদপুর থেকে জানান, তিনটি উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। ওই ১১টি ইউনিয়নে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জেলার তিনটি উপজেলার ৩২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
×