ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষ প্রদর্শনী জাতীয় জাদুঘরে

পোড়ামাটির ফলকে সমৃদ্ধ ইতিহাস, সমকালীন ভাবনা

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৬ জুলাই ২০১৬

পোড়ামাটির ফলকে সমৃদ্ধ ইতিহাস, সমকালীন ভাবনা

মোরসালিন মিজান ॥ বাংলার নরম কাদামাটি। চিরচেনা। বহু, বহুকাল আগে এই মাটির স্বভাব আয়ত্ত করেছিলেন কুমাররা। নিজের মনের মতো করে একে গড়ে নিয়েছিলেন। শ্রম, ঘাম ও মেধার মিলিত প্রয়াস একদিকে নিত্যদিনের প্রয়োজন মিটিয়েছে। অন্যদিকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে মৃৎশিল্পের ইতিহাসকে। প্রাচীনতম পোড়ামাটির শিল্প নিয়ে এখনও গর্ব করে বঙ্গদেশ। কতশত বছরের ইতিহাস যে হাসছে-খেলছে পোড়ামাটির ফলকে! আর বর্তমানে শিল্পটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাডেমিক চর্চা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মৃৎশিল্প বিভাগ। স্বতন্ত্র বিভাগের শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন নিরীক্ষায় মনোযোগী হয়েছেন। জাতীয় জাদুঘরে শুক্রবার শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি মৃৎশিল্পের সেই অতীত ও বর্তমানকে এক সূত্রে গেঁথেছে। গাঁথার একটি চেষ্টা বলা যায়। জনজীবন ও শিল্পকলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পোড়ামাটি শিল্প। এই শিল্পের নানা উপকরণ নিয়েই প্রদর্শনী। মূল উদ্যোগটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প বিভাগের। নতুন চালু হওয়া বিভাগের শিক্ষার্থীরা পোড়ামাটির কাজ নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। মোট শিল্পী ৩২ জন। শিল্পকর্ম সংখ্যা ৭২। তাদের সঙ্গে চমৎকারভাবে যুক্ত হয়েছে জাতীয় জাদুঘর। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অমূল্য সংগ্রহ থেকে পোড়ামাটির ১০০ নিদর্শন রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে। গ্যালারির অধিকাংশ জায়গাজুড়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকর্ম। মৃৎশিল্প বিভাগের কাজ দেখে সত্যি চোখ জুড়িয়ে যায়। হরেক রকমের নীরিক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের কাজের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য এই যে, শিল্পকর্মগুলো আকারে বিপুল। বিশাল। এ ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা অনেক। শিক্ষার্থীরা তবু চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছেন। তারা যে সফল, নানাভাবে ভাষায় তা প্রকাশিত। শিল্পীরা লোকজ ভাবধারা ও নিজস্ব কৃষ্টিকে যেমন গভীর ভালবাসায় আঁকড়ে ধরেছেন তেমনি চলেছেন আধুনিকতার সঙ্গে। বেশকিছু শিল্পকর্ম কৃষিপ্রধান বাংলাদেশকে উর্ধে তুলে ধরে। এই অঞ্চলের মাটির গুণ, উর্বরা শক্তি ও শস্যভা-ার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। শহুরে জীবনের সঙ্গে সুজলাসুফলা বাংলার পরিচয় করিয়ে দিতে শিল্পীদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। এ লক্ষ্যেই হয়ত ধান থেকে শুরু করে ঝিঙ্গা-করলার মতো সবজিও তাদের ভাবনায় স্থান পায়। হয়ে ওঠে একেকটি অনন্য সাধারণ ভাস্কর্য। প্রদর্শনীতে আছে নানা রকমের অবয়ব। পার্থ কুমার হাজরা মাটি পুড়িয়ে যে ভাস্কর্য গড়েছেন তাতে অনিন্দ্য সুন্দর রমণী দৃশ্যমান হন। নূর জাহান খাতুন বাঙালীর শৌর্যবীর্যকে, শক্তি-সাহসকে তুলে ধরতে প্রয়াসী। তার পোড়ামাটির বাঘ যেন সে কথাই বলে। প্রদর্শনীতে যথারীতি আছে ঐতিহ্যবাহী মৃৎপাত্র ও দৃষ্টিনন্দন পটারি। ফ্রি স্ট্যান্ডিং শিল্পকর্মগুলো দর্শনার্থীদের উচ্চতাকেও ছুঁয়ে দেয়। ছাড়িয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা জরুরী যে, পোড়ামাটির মিনিয়েচার শিল্পকর্ম গড়ার ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীরা চমক দেখিয়েছন। চমৎকার উদাহরণ হতে পারে নূরুল মমিনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পটারিটি। এটি হুইলে করা। আঙুলের নিপুণ স্পর্শে আকার ও আকৃতি পেয়েছে। আঙটির যে বৃত্ত তার ভেতর পুরোটা গড়ন দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করা যায় না! এভাবে শিক্ষার্থীদের নান্দনিকতার বোধ দক্ষতা ও সমকালীন চর্চা সম্পর্কে ধারণা দেয় প্রদর্শনী। একইসঙ্গে তাদের গন্তব্য সম্পর্কে আশাবাদী করে তুলে। প্রদর্শনী কক্ষের মাঝখানে জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা নিদর্শন। এখানে যে বিস্ময় তা তো চিরকালের! ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শতকের মৃৎশিল্পের নিদর্শন যত দেখা যায়, ততই যেন ক্ষুধা বাড়ে! পশু- পাখি, লতাপাতা, ফুল, লিপি সবই ইতিহাসের গভীরে নিয়ে যায়। ফেলে আসা দিনগুলো সম্পর্কে কৌতূহলী করে। চোখ জুড়ানো প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বরেণ্য শিল্পী রনবীর সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বলেন মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা শরীফ আনোয়ার। প্রদর্শনী চলবে আগামী ২৬ জুলাই পর্যন্ত।
×