ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভয়ঙ্কর জঙ্গী, শীর্ষ সন্ত্রাসীর ওপর নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ

আগামী মাস থেকে বিশেষ প্রযুক্তির প্রিজন্স ভ্যানে বন্দী আনানেয়া

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৩ জুলাই ২০১৬

আগামী মাস থেকে বিশেষ প্রযুক্তির প্রিজন্স ভ্যানে বন্দী আনানেয়া

মশিউর রহমান খান ॥ আগস্ট মাস থেকেই ভয়ঙ্কর জঙ্গী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, দুর্ধর্ষ মামলার আসামি বা আলোচিত সকল মামলার আসামিসহ ভিআইপি আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে আনা নেয়ার জন্য বিশেষ প্রযুক্তির প্রিজন্স ভ্যান ব্যবহার করবে কারা কর্তৃপক্ষ। এজন্য ২টি প্রিজন্স ভ্যান চলতি মাসের মধ্যেই কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে কারা সূত্রে জানা গেছে। গত মে মাসে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এসব ভ্যান কেনার জন্য কার্যাদেশ প্রদান করেছে কারা অধিদফতর। দেশে প্রথমবারের মতো ওয়েববেজড ক্যামেরাযুক্ত এসব আধুনিক প্রিজন্স ভ্যান তৈরি করছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় ও সর্বোচ্চ সতর্কতার অংশ হিসেবে কারা কর্তৃপক্ষ প্রিজন্স ভ্যান সঙ্গে সঙ্গেই আগস্ট মাস থেকেই জঙ্গীসহ সকল দুর্ধর্ষ মামলার আসামিদের আনা- নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে বলে কারাসূত্র জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে। একটিতে ৮ থেকে ১০ জন বন্দীকে বহন করা সম্ভব হবে অপরটিতে ৪০ জন বন্দীকে বহন করা যাবে। দুটি ভ্যান কিনতে ব্যয় হবে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া কারাগার থেকে আদালতে নেয়ার পথে বন্দী ছিনতাই রোধ করতে এসব ভ্যান বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। প্রাথমিকভাবে দুটি ভ্যান কেনা হলেও পরবর্তীতে এর কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে সরকারের আরও উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন প্রিজন্স ভ্যান কেনার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। কারাগারের বাইরে চলাচলের রাস্তায় বন্দীকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা প্রদানে সহায়তা করতে ও কারা কর্তৃপক্ষের নজরদারির আওতায় আনতেই এসব ভ্যান কেনা হচ্ছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশের কেনা ভ্যান দিয়েই বন্দীকে আদালতে আনা নেয়া করা হচ্ছে। এসব ভ্যানের অধিকাংশই ভাঙ্গাচোরা আর পুরনো। এদের মধ্যে রাস্তায় কোন কোন গাড়ি ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে থাকতেও দেখা যায়। এই প্রথমবারের মতো কারা অধিদফতর আধুনিক প্রযুক্তির এসব ভ্যান ক্রয় করছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে জঙ্গী আনায়নে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশের অংশ হিসেবে আগস্ট মাস থেকেই এসব ভ্যান কাজে লাগানো হবে বলে জানা গেছে। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, দুটি ভ্যানের প্রতিটিতে ওয়েব বেজড ক্যামেরা লাগানো থাকবে। বন্দীদের বহনকারী ভ্যানটি কোন পথে যাচ্ছে, রাস্তায় কোন স্থানে ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে কি না, আদালতে ভ্যান পৌঁছতে দেরির কারণ জানতে, রাস্তায় পালানোর জন্য কোন বন্দী চেষ্টা করে কি না, কারও সঙ্গে অবৈধ উপায়ে মোবাইল ফোনে কথা বলে কি না কিংবা ভ্যানের ভেতরে বন্দীরা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় কি নাÑ মোটকথা বন্দীকে সার্বিক নজরদারিতে রাখতেই প্রিজন্স ভ্যানে ওয়েববেজড ক্যামেরা লাগানো হচ্ছে। এসব ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ সরাসরি কারা মহাপরিদর্শক ও সংশ্লিষ্ট কারাগারের সার্ভার রুম থেকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে রাস্তা থেকে কোন আসামি ছিনতাই করার পথ বন্ধ হবে। কারা সূত্র জানায়, ছোট আকৃতির একটি ভ্যান জঙ্গী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার বন্দী, ভিআইপি, অসুস্থ, আদালতের বিশেষ নির্দেশপ্রাপ্ত বন্দীদের বহন করতে কাজে লাগানো হবে। এ ভ্যানটি সর্বোচ্চ ১০ জন বন্দী ধারণ করতে পারবে ও একটি মাত্র দরজা থাকবে। এছাড়া অপর ভ্যানটিতে ৪০ জন বন্দীকে রাখা যাবে। এ ভ্যানটিতে ৩ দিক দিয়ে ৩টি দরজা থাকবে। ৩টি আলাদা কম্পার্টমেন্ট থাকবে। জঙ্গী, সন্ত্রাসী ও সাধারণ মামলার আসামিরা মিশতে যেন না পারে সেজন্য পৃথক পৃথক স্থানে রাখতে এ ৩টি ভাগ করা হবে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, রাস্তায় চলাচলে দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়ায় এক সঙ্গে সকল জঙ্গীকে রাখলে ভ্যানে বসেই নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করতে পারে। তা রুখতেই এ বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বহু আগে থেকেই কারা কর্তৃপক্ষের জন্য দুটি ভ্যান কেনার সরকারী মঞ্জুরি থাকলেও অজ্ঞাত কারণে এতদিন তা কেনেনি কারা অধিদফতর। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ও কারাগার সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারী নির্দেশের সঠিক বাস্তবায়ন করতে এসব উদ্যোগের মাধ্যমে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কারা অধিদফতর। নিজ উদ্যোগে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে এসব আধুনিক প্রযুক্তির ভ্যান কেনার প্রস্তাব পাঠায় কারা মহপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন। এর পরপরই সরকার এর প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে ভ্যান কিনতে সম্মত হয়ে অর্থ ও ব্যয় মঞ্জুরি প্রদান করে। এরপরই কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে কারা অধিদফতর। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এসব ভ্যান কারা অধিদফতরকে হস্তান্তর করা হবে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, এসব ভ্যানে দুর্ধর্ষ জঙ্গী ছাড়াও আদালতের নির্দেশে ও ডিভিশনপ্রাপ্ত অসুস্থ আসামিদের আদালতে হাজিরা দিতে এবং এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করতে ব্যবহার করা হবে। বিশেষ করে জঙ্গী শীর্ষ সন্ত্রাসী ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার বন্দীদের আদালত বা অন্য কোন কারাগারে আনানেয়ার সচিত্র দৃশ্য কারাগারে বসেই তা মনিটর করতেই এসব ভ্যানে ওয়েববেজড ক্যামেরা লাগানো হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এসব ভ্যান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি প্রিজন্স ও কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী আনানেয়ার কাজে ব্যবহার করা হবে। বর্তমানে কারাগার থেকে প্রিজন্স ভ্যানে বন্দী আনানেয়ার মূল দায়িত্ব পালন করে পুলিশ। এই প্রথমবারের মতো কারা অধিদফতরকে বিশেষ প্রযুক্তিসম্পন্ন প্রিজন্স ভ্যান কেনার অনুমতি দিয়েছে সরকার। যার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করবে কারা কর্তৃপক্ষ। প্রিজন্স ভ্যানের আসামিদের এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে আনানেয়ার সময় পথিমধ্যে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে হোটেল কিংবা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগের তদন্তে প্রমাণও মিলেছে বলে শোনা গেছে। এর মাধ্যমে যাতায়াতের পথে কারা কর্তৃপক্ষ বন্দীর ওপর সর্বোচ্চ নজরদারি করতে সক্ষম হবে। কারাসূত্র জানায়, কারাগারে আটক বন্দীদের বিভিন্ন সময় আদালত থেকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, অসুস্থ আসামিকে আদালতে হাজিরা দিতে আরামদায়ক যানবাহনের ব্যবস্থা করা হোক। এ ক্ষেত্রে কারাগারের আরামদায়ক ও নিরাপদ কোন নিজস্ব যানবাহন না থাকায় কারা কর্তৃপক্ষকে বাধ্য হয়ে অধিক খরচে এম্বুলেন্স ভাড়া করতে হয়। এছাড়া সবসময় নিরাপদ এম্বুলেন্স না পাওয়া যাওয়ায় অনেক সময় আসামিকে নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির করতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলে বিচার কাজে এর প্রভাব পড়ে। অপর একটি সূত্র জানায়, পুলিশের সাহায্য নিয়ে আদালত থেকে কারাগারে অথবা এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে আসামি স্থানান্তর করতে গেলে সময়মতো পুলিশের এস্কর্ট না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে দেরিতে বা অধিক রাতেও আসামিদের কারাগারে আনানেয়া করতে হয়। এতে করে পুলিশকে রাস্তায় বন্দীদের নিয়ে অনেকটা ঝুঁকিতে থাকতে হয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে বা আদালতের নির্দেশ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে কারা অধিদফতর পুলিশের বাইরে নিজস্ব উদ্যোগে বিশেষ প্রযুক্তির ভ্যান কিনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। সরকার বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এ প্রস্তাব অনুমোদন করে। সূত্র জানায়, এসব ক্যামেরা স্থাপিত প্রিজন ভ্যানের গতিবিধি নজরদারিতে রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, মহাপুলিশ পরিদর্শক, কারা মহাপরিদর্শকের অফিসিয়াল মোবাইল ফোনে কানেক্টিভিটি রাখা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, দুর্ধর্ষ আসামি, দেশের আলোচিত সকল মামলার আসামিসহ বন্দী আনা নেয়ার ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ দ্রুত প্রতিপালনে ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ মামলার আসামিদের বহনের জন্য ওয়েববেজড ক্যামেরা প্রযুক্তিসহ প্রিজন্স ভ্যান কেনা হচ্ছে।
×