ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইউরোপের মুকুট জিতে পর্তুগালের ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ১২ জুলাই ২০১৬

ইউরোপের মুকুট জিতে পর্তুগালের ইতিহাস

জাহিদুল আলম জয় ॥ এক যুগ আগে লিসবনে কান্নার সাগরে ভেসে গিয়েছিল পর্তুগাল। প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরার মুকুট জয়ের কাছাকাছি এসেও ব্যর্থ হয়েছিল লুইস ফিগোর দল। নিজেদের মাঠে ফাইনালে পর্তুগীজরা ১-০ গোলে হেরেছিল গ্রীসের কাছে। ২০০৪ সালের ৪ জুলাই তখনকার ক্ষুদে জাদুকর ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিল সবাইকে। ১২ বছর পর আবারও ইউরোপ সেরার মঞ্চের ফাইনালে উঠে আসে পর্তুগাল। এবার নেতা রোনাল্ডোর নেতৃত্বে অসাধ্য সাধন করার মিশন। কিন্তু প্যারিসের সেইন্ট-ডেনিসে স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনাল মহারণের শুরুতেই বড় ধাক্কা খায় পর্তুগাল। ম্যাচের ১৪ মিনিটে আঘাত পান অধিনায়ক রোনাল্ডো। অনেক চেষ্টা করেও আর মাঠে ফিরতে পারেননি। যে কারণে ২৫ মিনিটে রোনাল্ডোর পরিবর্তে মাঠে নামানো হয় রিকার্ডো কারেসমাকে। এক যুগ আগে ছোট্ট রোনাল্ডো কেঁদেছিলেন ফাইনালে হারের পর। পরশু রাতেও কান্না সঙ্গী করে উঠে যেতে হয় তাকে। এ সময় ফরাসী কোচ দিদিয়ের দেশমের মতো মুচকি হেসেছিলেন অনেকেই। তাদের ভাবখানা ছিল এমন, হেসেখেলে চ্যাম্পিয়ন হবে ফ্রান্স! আর আরেকবার কাঁদতে হবে রোনাল্ডোকে! কিন্তু বিধাতা যে চিত্রনাট্য সাজিয়ে রেখেছিলেন অন্যভাবে। রোনাল্ডো উঠে গেলে কি হবে, এরপর দলের সেরা তারকার জন্যই পর্তুগীজরা হয়ে উঠেন অদম্য। দলের সবাই যেন হয়ে উঠেন রোনাল্ডো। তাই তো শক্তিশালী ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পর্তুগাল। রবিবার মধ্যরাতে তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনালে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে গোল পায়নি কোন দলই। ফলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। ১০৯ মিনিটে বদলি হিসেবে নামা এডারের চোখ ধাঁধানো গোলে ইতিহাস গড়া শিরোপা নিশ্চিত হয় ইউরোপের ব্রাজিল খ্যাত পর্তুগীজদের। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো ইউরোর ফাইনাল খেলেছিল পর্তুগাল। কিন্তু ঘরের মাঠে সেবার হারের বেদনায় নীল হতে হয়েছিল ফিগো, রোনাল্ডোদের। এবার সেই একই হতাশা বরণ করতে হয়েছে ফ্রান্সকে। প্যারিস আক্রমণের আট মাস পর ১৩০ মানুষের মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার দারুণ সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে গ্রিজম্যান, এভরা, পোগবাদের। কোচ দেশমের হাত ধরে বড় কোন টুর্নামেন্টে চতুর্থ শিরোপার লক্ষ্যেই নিজেদের পরিচিত মাঠে ময়দানী যুদ্ধে নেমেছিল স্বাগতিকরা। ১৯৮৪ ইউরো ও ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের পর ঘরের মাঠে এটা তাদের জন্য তৃতীয় শিরোপার হাতছানি ছিল। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন দেশম। স্টাডে দ্য ফ্রান্সেই একমাত্র বিশ্বকাপ জিতেছিল ফরাসীরা। কিন্তু এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। অদম্য পর্তুগীজদের কাছে হেরে বেদনায় নীল হতে হয়েছে ফরাসীদের। এই জয়ের ফলে ফ্রান্সের কাছে টানা ১০ ম্যাচে হারের বৃত্ত থেকেও বের হয়ে এসেছে পর্তুগীজরা। ১৯৮৪ ইউরো সেমিফাইনাল, ইউরো ২০০০ ও ২০০৬ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে পরাজিত হয়ে বিদায় নিয়েছিল পর্তুগাল। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এবারের ইউরোতে পুরো টুর্নামেন্টে ৯০ মিনিটে মাত্র একটি ম্যাচে জয় পেয়েছে পর্তুগাল। সেমিফাইনালে ওয়েলসের বিপক্ষে ২-০ গোলে জয় পেয়েছিল রোনাল্ডোরা। বাদ বাকি ম্যাচগুলো হয় ড্র নয়ত, অতিরিক্ত সময়ে জিতেছে পর্তুগাল। ২০০৪ সালের ফাইনালের সময় রোনাল্ডোর বয়স ছিল ১৯ বছর। ওই বয়সে ফাইনালে হারের পর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি তখনকার ক্ষুদে বিস্ময়। এবারের ফাইনালেও ইনজুুরি আক্রান্ত হয়ে স্ট্রেচারে করে বাইরে যাওয়ার সময় তার চোখের পানি দেখেছে পুরো স্টেডিয়াম। তাকে যখন বাইরে বের করে নেয়া হচ্ছিল স্টেডিয়ামের পুরো সমর্থকরাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। দ্বিতীয়ার্ধের শেষের দিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে মাঠে ফিরে এসে টাচলাইনে দাঁড়িয়ে কোচ সান্টোসের পাশাপাশি পুরো দলকে উৎসাহিত করেন। ম্যাচের প্রথমার্ধে প্রাধান্য বিস্তার করে খেলেও গোলের দেখা পায়নি ফ্রান্স। পর্তুগীজ গোলরক্ষক রুই প্যাট্টিসিও অসাধারণ সেভ করে দলকে রক্ষা করেন। বিরতির পর পর্তুগালও পাল্টা আক্রমণ শাণাতে থাকে। ফলে খেলা উপভোগ্য হয়ে উঠে। অতিথিদের বেশ কয়েকটি সুযোগ নস্যাৎ করে দেন স্বাগতিক গোলরক্ষক ও অধিনায়ক হুগো লরিস। ম্যাচের ৭৮ মিনিটে রেনাটো সানচেসের পরিবর্তে মাঠে নামেন এডার। এরপর নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষ হয়। মাঠে গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা। ১০৯ মিনিটে এডার প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে দূরপাল্লার শটে ফরাসী গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে পর্তুগালকে এগিয়ে নেন। এ সময় পর্তুগীজ সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। বাকি সময়ে ফ্রান্স ম্যাচে ফেরার প্রাণান্ত চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। ফলে প্রথমবারের মতো ইউরো শিরোপা জয়ের তৃপ্তি নিয়ে মাঠ ছাড়ে পর্তুগাল। নীলকে বলা হয়ে থাকে বেদনার রং। ফাইনালে হারের পর বেদনার এই রঙে যেন ছেয়ে যায় গোটা প্যারিস। কেননা ফ্রান্সের টিম জার্সি নীল রঙের। সঙ্গত কারণেই স্টেডিয়ামে নীল জার্সি পরিহিত দর্শকদের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ফাইনালে হারের পর কান্নার সাগরে ভেসে যান স্বাগতিক ফুটবলার ও সমর্থকরা। এ যেন নীল কষ্ট আর কান্নার মিলনমেলা! অন্যদিকে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম শিরোপা জিতে পর্তুগীজরা ভাসছে উৎসব-আনন্দে।
×