ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘সোনার বাংলা’ এক্সপ্রেসের উদ্বোধন

বুলেট ট্রেন ও পাতাল রেল দূরে নয় ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৬ জুন ২০১৬

বুলেট ট্রেন ও পাতাল রেল দূরে নয় ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্গম এলাকাসহ দেশের সব জেলাতেই রেলের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও উচ্চগতির বুলেট ট্রেন ও পাতাল রেল চালুর আশার কথা শুনিয়ে বলেছেন, ‘জাপানের বুলেট ট্রেনের প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল। যতবার জাপানে গিয়েছি, সেখানে বুলেট ট্রেনে উঠতাম। সেদিন বেশি দূরে নয়, ইনশাআল্লাহ আমরা দেশেই এ উচ্চগতির বুলেট ট্রেন চালু করতে সক্ষম হব। পাতাল ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাই চলার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আগামীতে পাতাল রেলও করতে পারব। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পাতাল ও বুলেট ট্রেন চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করবে সরকার। শনিবার দুপুরে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে নতুন বিরতিহীন ট্রেন ‘সোনার বাংলা এক্সপ্রেস’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা-রাজশাহী রুটে সিল্কসিটি সার্ভিসের বিকল্প হিসেবে নতুন ব্রডগেজ ট্রেন সার্ভিসও উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধন বাংলাদেশের যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক নবতর অধ্যায়ের সংযোজন। নতুন ট্রেনে করে বাড়ি গিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের মজাটাই আলাদা হবে। প্রধানমন্ত্রী এদিন যান চলাচলের সুবিধার জন্য খিলগাঁও ফ্লাইওভারে স্থানীয় সরকার বিভাগের তৈরি খিলগাঁও ফ্লাইওভারের লুপ খুলে দেয়ার ঘোষণা দেন এবং কমলাপুর থেকে ফেরার পথে প্রগতি সরণি-বনশ্রী সংযোগ সড়কে নেমে প্রধানমন্ত্রী হাতিরঝিল প্রকল্পের সাউথ ইউ-লুপের ফলক উন্মোচন করেন এবং মোনাজাতে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর প্রেসক্রিপশনে দেশের রেল সার্ভিসকে প্রায় বন্ধই করে দিতে বিভিন্ন রুট থেকে রেললাইন পর্যন্ত সরিয়ে ফেলে। সে অবস্থা থেকে ১৯৯৬ সালে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার রেল পুনর্গঠনে উদ্যোগী হয়। রেলপথ এবং নদ-নদী বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক এবং দাতাগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব স্বার্থে এ যোগাযোগের সহজ এবং সাশ্রয়ী মাধ্যম দুটিও বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দেয়। তারা বঙ্গবন্ধু সেতুতেও রেললাইন স্থাপনে রাজি ছিল না। কিন্তু আমি তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। তিনি বলেন, দাতারা অর্থ সহায়তা দেবে, কিন্তু আমাদের ভাল-মন্দ আমাদেরই বুঝতে হবে। তারা কিন্তু বুঝবে না। এ প্রসঙ্গে নিজস্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকায় এখন বিশ্বব্যাংক বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশ দিয়ে একটি পৃথক রেলসেতু নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই দেশটা উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাক। রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য জীবন দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে রেলওয়ের যারা শহীদ হয়েছেন তাদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণেরও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য সারাদেশে রেললাইন চালু করা, যেন দুর্গম এলাকায় রেল যেতে পারে। কোন কাজই কঠিন না। বরিশালবাসী রেললাইন দেখে নাই, ওখানেও আমরা রেললাইন করব। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী যারা তারা যেন রেলের সুবিধা পেতে পারে সেজন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জন্য কাজ করে এবং কিসে দেশের কল্যাণ এবং কিসে উন্নয়নÑ তা ভাল করে জানে। উন্নয়নের মধ্য দিয়েই ২০৪১ সালে আমরা উচ্চ আয়ের দেশ হব। আমাদের এ অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না। ভারতীয় ঋণ সহায়তার অধিকাংশ রেলের উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতার নিদর্শন হিসেবে ভারত সরকার ২০১০ সালে বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। এ ঋণ চুক্তির আওতায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার এবং ভারত সরকার ৭৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ১৪টি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এছাড়া ভারত সরকার আরও ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্বিতীয় ঋণ মঞ্জুর করেছে। এ অর্থের দ্বারা আরও তিনটি নতুন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর এ পর্যন্ত ৬২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলওয়ের ৫৫টি নতুন প্রকল্প এবং ৪২ হাজার ৬০১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৫টি সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন করেছে। সরকার রেলের বন্ধ শাখা লাইন চালু, ডাবল লাইন নির্মাণ ও নতুন রেললাইন নির্মাণের পাশাপাশি রেলওয়ের জনবল ও রোলিং স্টক সঙ্কট দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ পর্যন্ত ৯৮টি নতুন ট্রেন চালু এবং ২৬টি ট্রেনের সার্ভিস বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশকে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলেন শেখ হাসিনা। প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকারের সময়ে নতুন ২০টি মিটার গেজ এবং ২৬টি ব্রড গেজ লোকোমোটিভ, ১২০টি ব্রড গেজ যাত্রীবাহী গাড়ি, ১৬৫টি ব্রড গেজ ও ৮১টি মিটার গেজ ট্যাঙ্ক ওয়াগন, ২৭০টি মিটার গেজ ফ্লাট ওয়াগন এবং ২০ সেট মিটার গেজ ডেমু সংগ্রহ করা হয়েছে। পরে প্রধানমন্ত্রী ‘সোনার বাংলা এক্সপ্রেস’ সার্ভিসের কোচগুলো ঘুরে দেখেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফিরোজ সালাউদ্দিন এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র আনিসুল হক ও মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, সেনাবাহিনী প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রীংলা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধন হওয়া ‘সোনার বাংলা এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি আজ রবিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করবে। শনিবার ছাড়া এটি নিয়মিত চলাচল করবে। ট্রেনটি সকাল ৭টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে দুপুর পৌনে ১টার দিকে চট্টগ্রাম পৌঁছবে। আবার চট্টগ্রাম থেকে বিকেল ৫টায় ছেড়ে রাত পৌনে ১১টায় ঢাকায় পৌঁছবে। নতুন এই ট্রেনটি শুধু ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশনে থামবে। এ ট্রেনটিতে ১৬টি নতুন বগি থাকবে। এর মধ্যে চারটি এসি চেয়ারের (স্নিগ্ধা) প্রতিটিতে ৫৫ করে ২২০ আসন, সাতটি শোভন চেয়ারের বগিতে ৪২০ আসন, দুটি এসি বাথে ৩৩ করে ৬৬ আসন এবং দুটি খাবার গাড়ির সঙ্গে সংযুক্ত ৪০টি আসন রয়েছে। প্রতিটি বগি ইন্দোনেশিয়ার তৈরি। ৫ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে ট্রেনটি গন্তব্যে পৌঁছবে। সোনার বাংলা এক্সপ্রেসে খাবার সরবরাহের দায়িত্বে থাকবে পর্যটন কর্পোরেশন। ট্রেনের ভাড়ার সঙ্গে খাবারের দাম সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চলাচলকারী দ্বিতীয় বিরতিহীন ট্রেন। ভারত ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ সহায়তায় নির্মিত ১৬ বগির এই সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সরাসরি চলাচল করার পথে কেবল বিমানবন্দর রেল স্টেশনে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি করবে। উল্লেখ্য, এর আগে ১৯৮৮ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের প্রথম আন্তঃনগর বিরতিহীন ট্রেন সুবর্ণ এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করে। ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস হস্তান্তর করলেন প্রধানমন্ত্রী ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সমস্যা দূর করতে ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে অনুদান হিসেবে ১০টি নতুন বাস হস্তান্তর করেছেন। রবিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারী বাসভবন গণভবনে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষদের কাছে বাসের চাবি হস্তান্তর করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুলবাস দান করার জন্য ধনী ব্যক্তিদের প্রতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইফাদ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইফাদ অটোস লিমিটেড এবং ভারতের অশোক লেল্যান্ড কোম্পানি বাসগুলো দান করেছে। নতুন বাস পাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ রংপুর সরকারী কলেজ, দিনাজপুর সরকারী কলেজ, সরকারী বঙ্গবন্ধু কলেজ, গোপালগঞ্জ সরকারী বঙ্গবন্ধু কলেজ, সাভার ক্যান্টনমেন্টে প্রয়াস বিশেষায়িত স্কুল, নেত্রকোনা সরকারী কলেজ, রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজ, ঢাকার সরকারী বাংলা কলেজ, ঢাকা, কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজ, যশোর সরকারী এমএম কলেজ এবং কক্সবাজার সরকারী কলেজ। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সমস্যার সমাধানে যদি ধনী ব্যক্তিরা এগিয়ে আসেন, যেসব স্কুল ও কলেজের বাস নেই তাদের বাস সরবরাহ করা হয়Ñ তাহলে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সমস্যার সমাধান হবে। এ জন্যই আমি ধনী ব্যক্তিদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস দান করার আহ্বান জানিয়েছি। প্রয়াস বিশেষায়িত স্কুলে বাস দানের জন্য বাছাই করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তার সরকারের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস দান করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইফাদ অটোস লিমিটেডকে ধন্যবাদ জানান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এর আগে ইফাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ টিপু আনুষ্ঠানিকভাবে বাসের ডামি চাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন। প্রতিটি বাসে ৩৬টি আসন রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, ইফাদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির আহমেদ, ইফাদ অটোস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন আহমেদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসেন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অনুষ্ঠানে ইফাদ গ্রুপ চেয়ারম্যান প্রয়াস বিশেষায়িত স্কুলের জন্য আরেকটি বাস দানের ঘোষণা দেন।
×