ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

খাদের কিনারে ইইউ

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ২২ জুন ২০১৬

খাদের কিনারে ইইউ

২০১৬ সালকে অনেক বিশ্লেষকই দেখছেন পরিবর্তন ও অস্থিরতার বছর হিসেবে। এই অস্থিরতা শুধু উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যে সীমিত থাকছে না। এমনকি এটি শুধু এশিয়ায় বা আফ্রিকাতেই ছড়াবে তা-ও নয়, এর বড় শিকার হতে পারে খোদ ইউরোপ। যাদের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ ও গোয়েন্দা মদদ দেয়ার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সরকারের পতন ঘটিয়ে অস্থিরতাকে উসকে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তারাই এখন সেই অস্থিরতার শিকারে পরিণত হচ্ছে। ইউরোপের গত অর্ধশতাব্দীর সবচেয়ে বড় অর্জন কী? এই প্রশ্নের জবাব হবে, একটি অভিন্ন ইউরোপ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রযাত্রা। এই অগ্রযাত্রার দুটি প্রধান ক্ষেত্র হলো শেনজেন চুক্তির মাধ্যমে এই অঞ্চলের নাগরিকদের মুক্ত চলাচল এবং পণ্যের অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি। একই সঙ্গে নিশ্চিত করা হয়েছে ইউরোপের এক দেশের নাগরিকদের অন্য দেশে যাওয়া বা থাকার অধিকার। এর বাইরে দ্বিতীয় লক্ষ্যটি ছিল একটি অভিন্ন মুদ্রাঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুরো অঞ্চলে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক বিকাশ। এই দুটি লক্ষ্য বা অর্জনই এখন হুমকির মুখে। একক মুদ্রা, সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীনভাবে ভ্রমণ, সীমানাবিহীন বাণিজ্য, সম্মিলিত নিরাপত্তা নীতিতে সাফল্যের কারণে বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি আদর্শ। অভ্যন্তরীণ বিরোধ ঠেকাতেও সংস্থাটি এতকাল যথেষ্ট সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। তবে সংঘবদ্ধ ইউরোপ ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ ইদানীং চাঙ্গা হচ্ছে। তাই ইইউ-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পৃথক পৃথক ব্যাখ্যা দিতেও দেখা যায়। ইউরোপের ২৮টি দেশ নিয়ে গঠিত হলেও বর্তমানে সংস্থাটি মূলত চালাচ্ছে ফ্রান্স ও জার্মানি। গ্রিস সঙ্কট, ইউক্রেনে অস্ত্রবিরতি আলোচনা ইত্যাদিতে ফ্রঁাঁসোয়া ওলাঁদ আর এ্যাঙ্গেলা মার্কেলের কাজে এর স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অন্যদিকে অবৈধ অভিবাসীদের ঠেকাতে ফ্রান্স, ইতালি, হাঙ্গেরী ইত্যাদি দেশের পৃথক প্রতিরোধক সীমানা স্থাপনের মাধ্যমে ইইউ সদস্যদের সংঘবদ্ধ রোডম্যাপ সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। কিন্তু একেবারে শুরুর দিকে নজর দিলে, ইইউ-এর নিগূঢ় উদ্দেশ্যই ছিল একক ইউরোপ ভাবনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে বিরোধ ভুলে শান্তির ভিত্তি রচনাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ২০০৯ সালে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর এই ফেডারেল ইউরোপ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ব্যাপারে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠতে থাকে। সর্বশেষ সিরীয় শরণার্থীদের ইউরোপমুখী প্রবাহ শুরু হওয়ার পর সঙ্কট তীব্র হয়েছে। উত্তর ইউরোপ ও দক্ষিণ ইউরোপের মধ্যে মতের ব্যবধান এখন প্রবল হয়েছে। উত্তর মনে করছে দক্ষিণের অদক্ষতা ও অক্ষমতা তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, দক্ষিণের অভিযোগ উত্তরের বিরুদ্ধে তাদের বাজার একচেটিয়াভাবে দখল করা এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার সময় অনুদারতা প্রদর্শন ও কঠিন সব শর্ত আরোপ করার। এই টানাপড়েন উত্তর দক্ষিণ নির্বিশেষে সব দেশে জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সমর্থন বাড়িয়েছে। যাকে ইউরোপের সংহতির প্রতি আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই পথ ধরে ইইউ থেকে গ্রিসের বিদায় নেয়ার সম্ভাবনা একপর্যায়ে অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। ২০০৪ সালে ইইউতে যোগ দেয়া ১০ নতুন সদস্যের মধ্যে পোল্যান্ড একটি। এর পরের বছর সাংবিধানিক চুক্তির পরিকল্পনা থাকলেও দুই আদি সদস্য রাষ্ট্র ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের বিরোধিতায় তা ভেস্তে যায়। এরপর লিসবনে সংস্কার চুক্তিতে অনেক ভাবনা পুনরায় চলে এলেও হতাশা বাড়তে থাকে। এর মূলে ছিল দেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান ইইউ-এর অভিবাসন ও চাকরি নিয়ে উৎকণ্ঠা। এর ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলো, যারা সাশ্রয়ী শ্রম ও কম দ্রব্যমূল্যের জন্য সুপরিচিত ছিল, তারা পূর্বের নতুন সদস্যদের পেছনে পড়তে শুরু“করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানান্তরের জন্য পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি এবং গ্রীস থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চলে যেতে শুরু“করে। এ ক্ষেত্রে পূর্বমুখী ইইউ-এর বিস্তারই যে ইউরোপীয় চাকরির বাজারের একমাত্র কারণ, সেটা বলা যাবে না। কারণ, এখনও বেকারত্বকে ইইউ-এর অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২৩ জুন যুক্তরাজ্যে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এ গণভোটে যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা রায় দেবেন, তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক জোট ইইউতে থাকবেন কি থাকবেন না। এদিকে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত সংবাদপত্র দি সান পত্রিকা তার পাঠকদের ইইউ ত্যাগ করার পক্ষে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। দি সানের মালিক মিডিয়া মোগল খ্যাত রুপার্ট মার্ডক। দি টাইমস পত্রিকা এবং ইন্টারনেটভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউগভ পরিচালিত যৌথ জরিপের ফলে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্যেও ইইউয়ে থাকার পক্ষের চেয়ে ইইউ ত্যাগ করার পক্ষটি ৭ পয়েন্টে এগিয়ে আছে। এ গণভোটের রায়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। ইউরোপের রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি অনেক বিষয়ের ওপর প্রভাব পড়বে। যদি যুক্তরাজ্যের মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে রায় দেন, তাহলে বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাজ্যকে নতুন করে সবকিছু শুরু“করতে হবে। গত ১৩ জুন সোমবার প্রকাশিত জরিপের ফলে দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তা থেকেও অভিবাসন সমস্যা বড় করে দেখছেন ইইউবিরোধীরা। তাদের প্রচারে অভিবাসন সঙ্কটকে ফোকাস করা হচ্ছে। দি টাইমস-ইউগভের জরিপে উঠে এসেছে, এখন পর্যন্ত ইইউ ত্যাগের পক্ষে যুক্তরাজ্যের ৪৭ শতাংশ নাগরিক। আর থাকার পক্ষে ৩৯ শতাংশ। সিদ্ধান্তহীন ভোটারের সংখ্যা ১১ শতাংশ। আর ৪ শতাংশ ভোটার বলেছেন, তারা গণভোটে অংশ নেবেন না। গত সপ্তাহে দি টাইমস-ইউগভ আরেকটি জরিপে ফল প্রকাশ করে। তাতে ইইউতে থাকার পক্ষের ভোটারা ১ শতাংশ এগিয়ে ছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে সেই ব্যবধান কমিয়ে ইইউ ছাড়ার পক্ষটি ৭ পয়েন্টে এগিয়ে গেছে। গণভোটের সময় যতই এগিয়ে আসছে, ইইউবিরোধীরা ততই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। রুপার্ট মার্ডকের দি সানে পাঠকের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, তারা যেন ২৮ সদস্যবিশিষ্ট ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেন। পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে সবাইকে ভোট দিতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। স্বেচ্ছাচারী ব্রাসেলস থেকে আমরা অবশ্যই নিজেদের মুক্ত করব।’ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন থেকে শুরু করে লেবার লিডার জেরিমি করভিন, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রীরা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে শুরু করে প্রায় সব বিশ্ব নেতা, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা ইইউতে থাকার পক্ষে মতামত দিয়েছেন । ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের বর্তমান গবর্নরের ভাষায় ইইউ ত্যাগের অর্থ হচ্ছে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক মন্দা বা রিসেশন। আর এটা হলে অর্ধ মিলিয়ন মানুষ শুধু চাকরিই হারাবেন না, পাউন্ডের মূল্যও আনুমানিক ৩.৬% কমে আসবে।‘ অন্যদিকে ইইউ ত্যাগের পক্ষের ক্যাম্পেইনারদের মধ্যে অনেকেই উগ্র ডানপন্থী এবং বিভক্তি সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ রয়েছেন নাইজেল ফারাজের তার মধ্যে একজন। তিনি ব্রিটেনের এথনিক এবং মুসলিম কমিউনিটি সম্পর্কে প্রায়ই বাজে মন্তব্য করে থাকেন। গণভোটের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছেড়ে আসার পক্ষে জনমত ততই বাড়ছে বলে বিভিন্ন জরিপে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। ভাল ব্যবধানে এগিয়ে আছে ইইউ বিরোধীরা। তবে এসব জরিপে সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের বিবেচনায় নেয়া হয়নি। গত ১৪ জুন পদত্যাগ করেছেন তুরস্কে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত হ্যান্সজোয়ের্গ হ্যাবের নিজ দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার সম্পর্কের অচলাবস্থা আবারও ফুটে উঠল। ব্রিটিশ লেবার এমপি জো কক্সকে হত্যার ঘটনায় অন্যদিকে মোড় নিতে পারে বলে ধারণা পোষণ করেছেন বিশ্ব নেতারা গত ১৬ জুন বৃহস্পতিবার দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন জো কক্স। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে বিরোধীদল লেবার পার্টির ব্যাটলি এ্যান্ড স্পেন আসনের এমপি ছিলেন তিনি। জো কক্স ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। বৃহস্পতিবার ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের ব্রিস্টলে একটি লাইব্রেরির কাছে গুলিবর্ষণ ও ছুরিকাঘাতে তার মৃত্যু হয়। জো কক্সকে গুলি করে হত্যার আগে ‘পুট ব্রিটেইন ফার্স্ট’ বলে চিৎকার করেছিলেন হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া থমাস মায়ার। তাও আবার একবার নয়, তিনবার চিৎকার করেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলোতে এ খবর প্রকাশের পর কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ব্রিটেন ফার্স্টের দিকে আঙ্গুল ওঠে। অবশ্য অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে ব্রিটেন ফার্স্ট বলছে, এ হত্যাকাণ্ডে তাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
×