ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকারী সন্দেহে আটক চারজনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ;###;ব্যবহৃত মোটরসাইকেল উদ্ধার

বিদেশী গোয়েন্দারা জড়িত ॥ চট্টগ্রামে এসপি পত্নীসহ টার্গেট কিলিং সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৭ জুন ২০১৬

বিদেশী গোয়েন্দারা জড়িত ॥ চট্টগ্রামে এসপি পত্নীসহ টার্গেট কিলিং সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুর চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ঘটনায় আটক সন্দেহজনক ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সোমবার রাতে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের প্রথম মালিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে তিনি যার কাছে মোটরসাইকেলটি বিক্রি করেছেন তার সন্ধান চলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার। আটককৃতরা হলেন ওয়েলপার্ক ইভেন্টের দারোয়ান, পাশের এক দোকানদার ও দুই পথচারী। এদিকে চট্টগ্রামে এসপি পতœীসহ দেশের সাম্প্রতিক হত্যাকা- নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, দেশে ধারাবাহিক হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের’ অংশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসব হত্যাকা-ের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করেন। তিনি মনে করেন, বিএনপি ও জামায়াত-শিবির এর জন্য দায়ী। তাদের সঙ্গে বিদেশী শক্তির যোগসাজশ রয়েছে বলে ইঙ্গিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে বাইরের একটি গোয়েন্দা সংস্থা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এগুলো নিয়ে নয়া প্রচেষ্টা শুরু করেছে। তবে কোন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে তারা সন্দেহ করছেন এই প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশিত খবরাখবর উল্লেখ করে বলেন, ইসরাইলের একটি গোয়েন্দা সংস্থা দেশের বিরোধী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলছে। সম্প্রতি বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে ইসরাইলী নাগরিক মেন্দি সাফাদির ‘বৈঠকে’র খবর ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এটা আপনারাও শুনেছেন, দেখেছেন। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোসাদ সম্পৃক্ততার যে ইঙ্গিত করেন সেটি তীব্র ভাষায় উড়িয়ে দিয়েছেন ইসরাইলের এক মুখপাত্র। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘বাজেকথা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এমানুয়েল নাহসান। এর আগে সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার দাবি করেন, ইতোমধ্যে তারা অনেক তথ্য পেয়েছেন এবং অনেকদূর এগিয়েছেনও। তিনি দাবি করেন, সবচেয়ে বেশি সন্দেহ জেএমবি জঙ্গীদের প্রতি। অন্য অপশনগুলোও তদন্তে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে, হত্যাকা-ে ব্যবহৃত সন্দেহে একটি মোটরসাইকেল নগরীর একটি গ্যারেজের পাশ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পাঁচলাইশ পুলিশ। অপরদিকে, পুলিশের একাধিক তদন্ত দল অপর একটি মাইক্রোবাসের সন্ধান চালাচ্ছে। মাইক্রোবাসটি হত্যাকা-স্থলের অদূরে অপেক্ষমাণ ছিল বলে পুলিশ বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছে। নিহত মাহমুদা খানম মিতুকে রবিবার রাতেই ঢাকায় দাফন করা হয়েছে। এছাড়া রবিবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে সন্দেহজনক তিনসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা হয় সেটিকে জিডি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে সোমবার বাবুল আক্তারের দায়েরকৃত একটি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যাকা-ের ঘটনায় সোমবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্পটে একাধিক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, কোতোয়ালী মোড়, নিউমার্কেট মোড়, ষোলশহর, চকবাজার, বহদ্দারহাট ও আগ্রাবাদ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের কক্সবাজার এলাকায়ও অনুরূপ মানববন্ধন হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ মানুষ রীতিমতো ফুঁসে উঠেছে। সরকারী দলের অঙ্গ সংগঠনসমূহও মানববন্ধন ও মিছিল করেছে। মানববন্ধন অনুষ্ঠানের সমাবেশগুলোতে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুর হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। এদিকে, উদ্ধারকৃত সিসি ক্যামেরার ফুটেজে যে তিনজনকে মোটর সাইকেলযোগে দেখা গেছে তা অস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। ফলে এদের নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সিএমপির দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, তারা হত্যাকা-ের ক্লু উদঘাটনে আশাবাদী। ডিবির পাশাপাশি পিবিআই, সিআইডি ও থানা পুলিশ বিভিন্ন স্থানে সন্দেহজনকদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে। যেহেতু সিসি ফুটেজে হত্যাকা-ে অংশ নেয়াদের কারও চেহারা স্পষ্ট নয়, সেক্ষেত্রে সোর্স নিয়োগ করে ঘটনা উদঘটানের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এদিকে, বিভিন্ন সূত্রে এ ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত তা এখনও স্পষ্টভাবে ধারণা দিতে পারছে না। খোদ পুলিশও রয়েছে সন্দেহের আবর্তে। তবে হত্যাকা-ের ধরন দেখে পুলিশের ধারণা, এটা জঙ্গীদের কাজ। এদিকে, আরেকটি রহস্যজনক তথ্য বেরিয়ে এসেছে, সেটি হচ্ছে বাবুল আক্তারের পুত্র মাহির প্রথম শ্রেণীতে পড়ে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে। ঘটনার পূর্বদিন রাতে বাবুল আক্তারের স্ত্রীর মোবাইলে এসএমএস আসে অজ্ঞাতনামা একটি মোবাইল ফোন থেকে। সেখানে মেসেজ ছিল এসেম্বলি অনুষ্ঠানের কারণে রবিবার একঘণ্টা আগে মাহিরকে স্কুলে পাঠাতে হবে। এ কারণে রবিবার সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে মা মিতু মাহিরকে নিয়ে হেঁটে বাসে উঠিয়ে দেয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায় ঐ ধরনের কোন মেসেজ তারা মাহিরের মার মোবাইলে দেননি এবং ঐ ধরনের কোন কর্মসূচিও স্কুলের ছিল না। সঙ্গত কারণে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মিতুকে হত্যা করার জন্য সন্ত্রাসীরা তাকে সুবিধাজনক সময়ে ঘর থেকে বের হতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি বিষয়টি প্রতিবেশীদের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। বাবুল আক্তারের বাসায় পুলিশের যে দুই রানার থাকেন তারা ওই সময়ে এসে না পৌঁছায় মিতু নিজেই মাহিরকে নিয়ে বের হয়েছিলেন। বের হওয়ার পর এক শ’ গজের মধ্যেই হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়। সর্বশেষ যে তথ্যটি জানা গেছে, সেটি হচ্ছে মোটরসাইকেলযোগে এসেছিল দুই দুর্বৃত্ত। আরেকজন আগে থেকেই ছিল পার্শ¦বর্তী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গলিতে। সিসি ফুটেজে দেখা যায় ঘটনার আগে সে বার বার গলির মুখ থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসা-যাওয়া করছে আর মোবাইলযোগে কথা বলছে। হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার পর ওই যুবক মোটরসাইকেলে গোলপাহাড় এলাকামুখী হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। গোলপাহাড় মোড় এলাকার আগে যে একটি মন্দির রয়েছে সে মন্দিরের সিসি ক্যামেরাটিতে রেকর্ডিং হয়েছে সকাল ৯টা থেকে। এর আগ পর্যন্ত এটি বন্ধ ছিল। এছাড়া ঘটনাস্থলের আগে ওয়েল ফুড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের যে সিসি ক্যামেরা রয়েছে তাতে এদের আনাগোনা রেকর্ড হয়নি। ঘটনাস্থলটি ছিল ক্যামেরার আয়ত্তের বাইরে। এ অবস্থায় তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও উদ্বিগ্ন পুলিশ কর্মকর্তাদের সকলেই রয়েছেন নানা সন্দেহের আবর্তে। মূলত এ ঘটনা জঙ্গীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে তা অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা হচ্ছে। কেননা, জঙ্গীদের কাছ থেকে বাবুল আক্তার একাধিকবার টেলিফোনে এবং চিঠির মাধ্যমে মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন। ঝিনাইদহে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা ঝিনাইদহ থেকে জানান, পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে শৈলকুপাবাসী। নির্মম এ হত্যাকা-ের প্রতিবাদ ও খুনীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে সোমবার সকালে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার হাটফাজিলপুর বাজারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। শেষে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আলহাজ নূর আলম বিশ্বাসের সভাপতিত্বে সমাবেশ বক্তৃতা করেন ইউপি চেয়ারম্যান হেলাল বিশ্বাস, এমদাদুল হক ও ইদ্রজিত কুমার প্রমুখ। সমাবেশ অবিলম্বে মিতু হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানানো হয়। শৈলকুপা উপজেলার মদনপুর গ্রামেবাড়ি পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের। পিতা আব্দুল ওয়াদুদ, মা শাহিদা বেগম। স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু ঢাকার বনশ্রী এলাকার মোশারফ হোসেনের মেয়ে। গ্রামের পুত্রবধূ মিতু খুনের খবর শুনে হতবাক, শোকাহত গ্রামবাসী। গ্রামের পুত্রবধূর এমন নৃসংশ হত্যাকা- মেনে নিতে পারছেন না কেউ। নানা বয়সের নারী-পুরুষ দু’দিন ধরে শোক জানাতে আসছেন বাড়িতে। বাবুল আক্তারের বাবা আব্দুল ওয়াদুদও পুলিশ অফিসার ছিলেন। অবসরে যাওয়ার পর মাগুরা শহরের কাউন্সিল পাড়ায় বাড়ি করে দীর্ঘ ২০ বছর বসবাস করছেন। গ্রামের বাড়িতে না থাকলেও রয়েছে নাড়ির সম্পর্ক। তাই প্রায়ই শৈলকুপার মদনপুর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া আসা করতেন সবাই। মেরাদিয়া কবরস্থানে মিতুর লাশ দাফন ॥ স্টাফ রিপোর্টার গাফফার খান চৌধুরী জানান, কত মানুষ আসছে, আমার মেয়ে আসে না কেন? গগন বিদারী আর্তনাদে কথাগুলো বলছিলেন পৈশাচিক হত্যাকা-ের শিকার এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুর মা সাহিদা বেগম। চট্টগ্রামে নিহত মিতুদের ঢাকার বাড়িতে মানুষের ঢল নেমেছে। শত শত মানুষ ভিড় করেছেন সেই বাড়িতে। ছোট্ট দুই শিশু সেই ভিড়ের মধ্যেও মাকে খুঁজছে। এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, তাদের মা পরপারে চলে গেছেন। আর আসবেন না। ঘুমের মধ্যে চমকে উঠছে প্রত্যক্ষদর্শী ছেলে মাহিন। নিহত মিতুকে ঢাকার মেরাদিয়া কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সোমবার বিকেলে মেরাদিয়ার ভূঁইয়াপাড়ার মিতুদের বাড়িতে ঢুকতেই শোনা গেল মিতুর মায়ের আর্তনাদ। তার আহাজরিতে সেখানকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আছে। বাড়ির সামনে পুলিশে ঠাসা। রবিবার রাত সাড়ে ১১টায় মেরাদিয়া কবরস্থানে নিহত মিতুকে দাফন করা হয়। পারিবারিক সূত্র জানায়, প্রথমে ঝিনাইদহের শৈলকূপার ফাদিলপুরে দাফন করার সিদ্ধান্ত হলেও পরে সিদ্ধান্ত ঢাকায় দাফন করা হয়। মেরাদিয়ার বাড়িতে দেখা হয় বাবুল আক্তারের সঙ্গে। তিনি খুবই বিমর্ষ ছিলেন। দুই সন্তানের দিকে তাকিয়ে তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি কথা বলতে পার ছিলেন না। মানুষজন দেখে আবেগ যেন আরও বেড়ে যাচ্ছিল তার। স্ত্রী হত্যার বিষয়টি সর্ম্পকে তিনি তেমন কোন মন্তব্য করেননি। বলছিলেন, ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাকা- প্যাটার্নের সঙ্গে তার স্ত্রী হত্যার মিল রয়েছে।
×