ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী

প্রকাশিত: ০০:০৯, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী

ড. মুকিদ চৌধুরী ॥ দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর ২০তম প্রয়াণ দিবস ২৩ ফেব্রুয়ারি। এই দিনে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে (সকাল ১১টা ৪০ মিনিট) তিনি তাঁর প্রিয় সংগঠন ‘হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ’-এর উদ্যোগে আয়োজিত হবিগঞ্জ মুক্ত স্কাউট ভবনে ‘মহান একুশ স্মরণ’ সভায় বক্তৃতারত অবস্থায় হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুকে জীবনরে শাশ্বত সত্য জেনে গ্রহণ করেন। তিনি কখনোই সাহিত্য-কর্ম বা লেখালেখি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। তাই তাঁর লেখকজীবন কলমপেশা লেখকের মতো ধারাবাহিক নয়। তাঁর প্রায় সকল সৃষ্টিকর্মই মনের আনন্দ বা ক্ষোভ প্রকাশের ফসল। সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, প্রবাসী জীবনযাপন এবং বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশে তাড়িত করে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর সাহিত্যিক-জীবনের স্ফূর্তি ঘটে ইংল্যান্ডে; প্রবাসে। পাকিস্তানে অবস্থানকালে পাকিস্তানি ও বাঙালিদের মধ্যে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং ধর্মের নামে পাপাচার তাঁকে ক্ষুব্ধ করে, ফলে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর চাকুরি ছেড়ে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীতে কর্মরত অবস্থা থেকেই পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। নানা উৎস থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানের কথা খুঁটে খুঁটে সংগ্রহ করে ধর্ম ও দর্শনভিত্তিক একাধিক গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন―‘নাম মোছা যায় না’ (১৯৬৩), ‘বাইবেলে সত্য নবী মুহাম্মদ (সা.)’ (১৯৬৮), ‘ধর্মের নির্যাস’ (১৯৬৫), ‘ইসলাম ও সমাজতন্ত্র’ (১৯৬৯), ‘পথ’ (১৯৬৩-১৯৯১)। ‘পথ’ গ্রন্থ পাঠে বোঝা যায়, মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ছিল, কিন্তু আজ তাদের করুণ অবস্থা। এক গভীর আক্ষেপ থেকেই শুরু হয় এই গ্রন্থটি। নিঃসন্দেহে বলা যায়, দুরূহ, উচ্চ ও গভীর ভাবনা এসব গ্রন্থের বিষয়বস্তু হলেও যুক্তি ও বস্তুনিষ্ঠ ভঙ্গিতে লেখক যা উপস্থাপন করেছেন তা যেকোনও গবেষকের কাছে আদর্শরূপে বিবেচিত হওয়ার মতো। যুক্তি, বিচারপ্রণালী, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দীপ্ত ভাবনার পরিচায়ক। ভাষা ও রচনানীতি অনেক উন্নত ও প্রাণবন্ত। গুণী এই কথাসাহিত্যিককে নিয়ে বাংলা একাডেমীর প্রাক্তন মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আব্দুর রউফ চৌধুরী ছিলেন পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন লেখক। খ্যাতির মোহে নয়, বরং জনমনে অগ্রসর চেতনা সৃষ্টি ও মুক্তিযোদ্ধের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা ছিল তাঁর সাহিত্য সাধনার মূল প্রেরণা ও লক্ষ্য। যেহেতু তিনি সবসময় একটি আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন; ফলে তাঁর সৃষ্ট সমগ্র সাহিত্যকর্মেও এর প্রতিফলন ঘটেছে।’ বাংলা একাডেমীর বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘একজন মনীষী, যিনি তাঁর মনন, মেধা এবং সামাজিক জীবনে সকল আবিলতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, তাঁর মাধুর্য এবং তাঁর গরিমাকে আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করছি।’ ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা, যৌক্তিকতার বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী লিখেছেন ‘যে কথা বলা যায় না’ ও ‘প্রফেট মোহাম্মদ’। ‘প্রফেট মোহাম্মদ’ অবশ্য ‘নতুন দিগন্ত’ উপন্যাসের ‘নথিপত্র’। যদিও তা স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ হতে পারত। গ্রন্থটি রস সঞ্চারী ও মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে রচিত। এর বিষয়, বির্তক উপস্থাপনের কৌশল, ভাবের গভীরতা, প্রামাণ্য তথ্যের নির্দেশ ও যুক্তি খণ্ডন প্রণালী এবং বস্তনিষ্ঠতা বিস্ময়কর। এখানে উদ্দেশ্য ও বিষয়-বাহন তথা মাধ্যমরূপে ভাষারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শৈল্পিক উৎকর্ষ বোধ ও আশ্চর্য মনাকর্ষক। দ্রোহী এই কথাসাহিত্যিক পারিপার্শ্বিক জীবনে অমানুষিক নির্যাতন ও নিপীড়ন তাঁর মন-মানসকে বিচলিত ও বিগলিত করে তোলে। একে উৎখাত করার জন্য তিনি সমাজতন্ত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নতুন সাফল্য অর্জন করার কথা প্রকাশ করেন। তাঁর বিশ্বাস, সমাজতন্ত্রই পারে সমাজের সর্বহারা শ্রমজীবী মুখ থুবড়ে পড়ে-থাকা কোটি মানুষের মুক্তির পথকে অবারিত করে তাদের জীবনমান উন্নত করতে। সমাজতন্ত্রই পারে মেহনতী মানুষকে অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে। তাই তিনি রচনা করেন পাঁচ খণ্ডে ‘বিপ্লব ও বিপ্লবীদের কথা’ বিশাল গ্রন্থটি, এর ‘কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস’ ও ‘ফরাসী বিপ্লব’ দুটো খণ্ড অঙ্কুর প্রকাশনী প্রকাশ করে। আগামীতেও প্রকাশ করবে ‘লেনিন-স্ট্যালিন ও রাশিয়া’; ‘মাও সেতুঙ ও চীন’; ‘বাংলাদেশ ও সমাজতন্ত্র’। দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী ১৯৪৬-১৯৭১ সালে ঘটে-যাওয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ছিলেন সচেতন। তিনি প্রত্যক্ষ করেন বাঙালি জীবনের প্রতিটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পর্যায়, তার বিকাশ, প্রতিক্রিয়া এবং পরিণতি। ১৯৪৬-এর ভারতবর্ষ বিভাজনের আন্দোলন, ১৯৪৮-এর বাংলাভাষা আন্দোলন, ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সূচিত বাঙালির সাংস্কৃতিক নবজাগরণের সূত্র ধরে ১৯৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ―এসব তাঁর কলমে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সমান্তরাল ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রচনা করলেন প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ও কবিতা। ‘স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা’ (কথাপ্রকাশ) গ্রন্থটি তিনটি পর্বে বিভক্ত―‘স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন’ (১৯৪৭-৫৪), ‘স্বাধিকার আন্দোলন’ (১৯৫৫-৭০) ও স্বাধীনতার আন্দোলন’ (১৯৭১)। আলোচনায় ও গবেষণায় স্থান পায়―পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের গণহত্যা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের ইতিহাস। যাঁরা বাংলাদেশ আন্দোলনের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণসমূহ এবং আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়কে অনুপুঙ্খভাবে জানতে চান তাদের জন্য বইটি উপযোগী। ‘মহান একুশে’ (নাসাস) গ্রন্থে বহুভাষার জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটির রাষ্ট্রভাষা কী হবে তার ওপর রাজনৈতিক নেতাদের নানা বক্তব্য বিবৃতি এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রের তাত্ত্বিকদের নানা তর্ক-তদন্ত বিধৃত বক্তব্য লেখক উপস্থাপন করেছেন। একাত্তরের বাংলাদেশে পাকিস্তানি দুঃশাসনের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে লেখকের মানস প্রতিক্রিয়ার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে ‘একটি জাতিকে হত্যা’ (নাসাস) গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিদেশি পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশে গণহত্যার যথার্থ কিছু প্রতিবেদনের হুবহু অনুবাদ উপস্থাপন অথবা কোনো প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে আলোচনা-সমালোচনা করা হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে এসব রচনা প্রকাশিত হয় ‘জনকণ্ঠ’ ‘ভোরের কাগজ’, ‘যুগভেরী’ ও ‘খোয়াই’ পত্রিকায়। দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর ‘১৯৭১’ (অঙ্কুর প্রকাশনী) দুই খণ্ডে বিভক্ত গ্রন্থটি বাংলাদেশ বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ―প্রথম খণ্ড (নভেম্বর ১৯৭০-আগস্ট ১৯৭১); দ্বিতীয় খণ্ড (সেপ্টেম্বর ১৯৭১-ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)। লেখক মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস ‘১৯৭১’ গ্রন্থের মাধ্যমে আলোচনা করেছেন তাতে স্বদেশানুরাগ ও ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ বস্তুতন্ময় দৃষ্টি সমন্বিত হয়েছে। তিনি পাঠক-মনে সাহিত্য রস সঞ্চার করতে সমর্থ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্তরগুলোকে, প্রত্যেকটির নির্দিষ্ট বিশিষ্টতাসহ, স্বতন্ত্রভাবে গ্রন্থকার তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে। ‘স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা’, ‘মহান একুশে’, ‘একটি জাতিকে হত্যা’, ‘১৯৭১’ (দুই খণ্ড) গ্রন্থগুলোকে একখণ্ডে বেঁধে দেশ পাবলিকেশন্স প্রকাশ করেছে ‘মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র/বাংলাদেশ ১৯৭১’ গ্রন্থটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কবিতার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই, তেমেনি নেই কবিরও। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কাব্যচর্চায় মনোযোগী হননি এমন কবির সংখ্যা খুবই কম। সবার কবিতা হয়তো-বা কালের বিচারে একইভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি, কিন্তু তাদের প্রসঙ্গ ছিল একটিই ‘মুক্তিযুদ্ধ’। ঠিক তেমনি প্রবাসে বসে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে কবিতা লিখেছেন দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী। বাঙালির জীবনধারা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর সামাজিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে বিচার করেছেন, প্রকাশ করেছেন নিজস্ব ধারায় কবিতা, যা হাতের রেখার মতোই একান্ত মৌলিক। এসব কবিতায় আছে বারুদের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, রক্তের গন্ধ আর মুক্তির গন্ধ। তিনি দেশকে কখনো দেখেছেন দেবী সমতুল্য আবার কখনো অনাহার ক্লীষ্ট, শীর্ণ জননী রূপে। তাঁর গ্রন্থ দুটো হচ্ছে―‘৭১-এর কবিতা’ ও ‘কবিতাগুচ্ছ’। সংগ্রাম-উন্মুখর বিচিত্র জীবনধারার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক তাঁর উপন্যাসটি হচ্ছে ‘নতুন দিগন্ত’ (১৯৬৮-১৯৯৫)। ‘নতুন দিগন্ত’ (পাঠক সমাবেশ) উপন্যাসকে কেন্দ্র করে তাত্ত্বিক ও রসবেত্তাদের শিল্পচিন্তায় ‘সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদ’ দেখা দেয়। স্রোতে-প্রতিস্রোতে আবর্তমান নতুন দিগন্ত উপন্যাসটি যত বড় তার চেয়ে মনে হয় অনেক বৃহৎ। এই ব্যাপ্তি উপন্যাসটির পৃষ্ঠাসংখ্যার চেয়েও বেশি। সুনিবদ্ধ কাহিনী, অগণন চরিত্র, উজ্জীবিত সংলাপ, স্বগত সংলাপ, স্মৃতি, ইতিহাস, বিশ্লেষণ, বর্ণনা―সবকিছু ছাপিয়ে যায় লেখকের জীবনবেদ। দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী বিলেতবাসকালে ডায়েরির মাধ্যমে তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। পরবর্তীকালে সেই মালমশার সাহায্যেই তিনি উপন্যাস খাড়া করেন। তাঁর নিজেরই জবানবন্দি অনুসারে, ‘বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগে সত্যের আলোছায়ায় ব’সে রচিত এই উপন্যাস।’ এরকম একটি উপন্যাস হচ্ছে ‘পরদেশে পরবাসী’ (পাঠক সমাবেশ), এতে আছে কিছু উপাদান যা স্পষ্টত তাঁর ষাটের দশকের দিনলিপির নথিপত্র থেকে নেওয়া; তার সঙ্গে অনিবার্যত মিশেছে উপন্যাসকারের কল্পনা; এছাড়া লেখক জুড়েছেন বেশ কিছু সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক চিন্তাভাবনা। একটি মহৎ শিল্প যেমন বহুগুণের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে থাকে, ঠিক তেমনি এই মানবতাবাদী লেখকের ‘সাম্পান ক্রুস’ (নাসাস) ও ‘অনিকেতন’ (প্রিয়মুখ প্রকাশনী)-ও বহুমাত্রিক শৈল্পিক গুণের সমৃদ্ধ। যেকোনও দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুটো উপন্যাস পাঠ করা হোক না কেন, তা একাধারে উপন্যাস, ইতিহাস, সমালোচনা-সাহিত্য এবং বিশেষভাবে সংস্কারবাদী দর্শনচিন্তা বলে সমাদৃত। এগুলোতে বিভিন্ন সমস্যা-প্রতিবন্ধকতা, প্রবাসী মানুষের আশা-নিরাশা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, আত্মকলহ এবং দোদুল্যমান মনের অবস্থা ফুটে উঠেছে। বিষয়-ভাবনায়, শিল্পরূপ বিচারে এসব উপন্যাস উত্তরাধুনিক উপন্যাসের প্রায় সব শর্তই পূরণ করে। তিনি যেমনি শিল্পী তেমনি দ্রোহীও। মন্ময় সাধনায় যেমন তাঁর কৃতিত্ব আছে তেমনি তিনি তাঁর সৃষ্টিজগতেও সিদ্ধহস্ত। পাশ্চাত্ত্য-সাহিত্যের ঐশ্বর্যভাণ্ডার ছিল তাঁর সামনে উন্মুক্ত। তাঁর ছোটগল্পে তাই শৈলীর অবাধ প্রয়োগ লক্ষ করা যায়; কারণ, তাঁর মন ছিল এক প্রগাঢ় রূপশিল্পীর মন। তাঁর ছোটগল্পে শুধু দৃশ্য-রূপই নয়, উপলব্ধি ও মননের নব-রূপ যেন অবয়ব পরিগ্রহণ করে। ব্যক্তির স্বার্থপরতা বা সুবিধাবাদেরও একটি শিল্পরূপোজ্জ্বল চেহারা তাঁর ছোটগল্প থেকে অনুভূত হয়, যা সবসময়ে জীবন নৈতিকতা-নির্ধারিত পথে চলে না; তাই নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে সর্বাত্মকভাবে এক দ্রোহী মানসিকতাকে অবলম্বন করে তাঁর শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। ‘বিদেশী বৃষ্টি’ (নাসাস)-র প্রায় প্রতিটি গল্পেই চমক, শ্লেষ, আত্ম-উন্মোচন বা নাটকীয় প্রতি-উম্মীলন একটা বিশিষ্টতা অধিকার করে আছে। অনেক ক্ষেত্রে কেবল একটি অবস্থার পরিবর্তন কিংবা আকস্মিক বা নাটকীয় পরিচয়ের মধ্য-দিয়ে সুখের মতো কষ্টকর বিচ্ছেদের একটি স্পর্শকাতর বর্ণনাও গল্পের রূপ নিয়ে উঠেছে। তাঁর ‘গল্পসম্ভার’ (নাসাস) ও ‘গল্পভুবন’ (নাসাস)-এর ছোটগল্পের বর্গীকরণ করলে যে সুষ্ঠু কাঠামো পাওয়া যায় তা হচ্ছে―(ক) দাম্পত্য জীবনের জটিলতা: নীলা, আত্মব্রত, বিকল্প, বন্ধুপতœী। (খ) সামাজিক সমস্যা ও প্রতিবাদ: জিন, নেশা, ভূত ছাড়ানো, জিনা। (গ) মনস্তাত্ত্বিক: রানী, সৃষ্টিতত্ত্ব, পরিচয়, শাদি। (ঘ) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: অপেক্ষা, পিতা, বীরাঙ্গনা, বাহাদুর বাঙালি। (ঙ) বাৎসল্য রস: উপোসী, স্নান, যৌতুক, ট্যাকরা-ট্যুকরি। এছাড়াও রয়েছে দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর গবেষণামূলক গ্রন্থ―‘নজরুল: সৃজনের অনন্দমহল’ (দেশ পাবলিকেশন্স), ‘রবীন্দ্রনাথ: চির নূতনের দিল ডাক’ (দেশ পাবলিকেশন্স), ‘যুগে যুগে বাংলাদেশ’ (নাসাস), ‘বাঙালির উৎস সন্ধানে’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ইত্যাদি। দ্রোহী কথাসাহত্যিকি আব্দুর রউফ চৌধুরী আগামী দিনেও বেঁচে থাকবনে তাঁর সৃজনর্কমের গৌরবে।
×