ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

একটি পরাজিত ম্যাচের পোস্টমর্টেম

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৫ নভেম্বর ২০১৫

একটি পরাজিত ম্যাচের পোস্টমর্টেম

জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ সিরিজের শেষ ম্যাচে হেরে গেল বাংলাদেশ। আগে পাঁচ ম্যাচের মধ্যে ৩টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ আর ২টি টি-২০’র ম্যাচ। এ সিরিজে কোন টেস্ট ম্যাচ ছিল না। টেস্ট ও টি২০ ম্যাচের চেয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে বরাবরই ভাল খেলে বাংলাদেশ। এ সিরিজের ৩টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সবগুলোয় জিতলেও এবং প্রথম টি-২০ ম্যাচে জয় পেতে বাংলাদেশ দলকে খানিকটা ঘাম ঝরাতেই হয়েছে। জয়গুলো ঠিক হেসে-খেলে আসেনি। বিশেষ করে প্রথম টি-২০ ম্যাচে জিততে অধিনায়ক মাশরাফিকে একটু হলেও বেগ পেতে হয়েছে সেটা ম্যাচের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। সবাই ভেবেছিল আগের ৪টি ম্যাচের মতো শেষ ম্যাচেও জিতে জয়ের ষোলকলা পূর্ণ করবে বাংলাদেশ। কিন্তু ক্রিকেটে বেটার পারফর্মেন্স ছাড়া যে ম্যাচে জেতা যায় না সেটাই আবারও প্রমাণ করলেন জিম্বাবুইয়ের মাদজিভা। বলা যায়, একটি হারা ম্যাচকে কীভাবে বের করে নিতে হয় সেটাই তিনি দেখিয়ে দিলেন। মাদজিভার আলোচনায় পরে আসছি। এ কথা অনেকেই মানবেন, এ ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংসের পরই হেরে গেছে। ১৩৬ রানের মামুলি টার্গেট ছুড়ে দিয়ে আজকাল কোন টি-২০ ম্যাচে জেতার কথা ভাবাই যায় না। সে যত দুর্বল দলই হোক। আজকের দিনে ক্রিকেট, বিশেষ করে টি-২০ ক্রিকেট এতটাই ফার্স্ট হয়ে গেছে যে দু’শোর বেশি রান করেও জেতার কথা ভাবা যায় না। সেখানে ১৩৫ রানে বাংলাদেশের ইনিংস গুটিয়ে যাওয়া তাও আবার ৯ উইকেট হারিয়ে! এত স্বল্প পুঁজি নিয়ে জেতার কথা ভাবাই যায় না। তবে ভাগ্য যদি জিতিয়ে দেয় সেটা অন্য কথা। তারপরও বাংলাদেশের বোলারদের নৈপুণ্যে, বিশেষ করে মুস্তাফিজ-আল আমিনদের অসাধারণ বোলিং পাফর্মেন্সে বাংলাদেশ এ ম্যাচে কেবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ফিরে আসেনি, এক সময় জয়ের স্বপ্নও দেখতে শুরু করে। বিশেষ করে ম্যাচের শেষ দিকে জিম্বাবুইয়ে অনেকটাই চাপের মধ্যেই পড়ে যায়। এক সময়ে তাদের জয় পাওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দেয়। টানাপড়েনটা জিম্বাবুইয়েকে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে আসে যে ম্যাচ জয়ের জন্য শেষ দুই ওভারে তাদের দরকার ছিল ২৪ রান। যেটা অসম্ভব নয়, তবে দুরূহই বলা যায়! টার্গেট ছাড়া এক ওভারে ৩৬ রান নেয়াও সম্ভব। কিন্তু টার্গেটের ওভারে ৬ রান করাও কষ্টকর। আমি অনেকবার এ কথাটা বলেছি, ফুটবল ১১ জনের খেলা হলেও ক্রিকেট কিন্তু তা নয়। ক্রিকেটে একজন ঘুরে দাঁড়াতে পারলে একটি ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়া অসম্ভব নয়। একজনই একটা ম্যাচ জিতিয়ে বা হারিয়ে দিতে পারে। এ ম্যাচেও সেটাই হয়েছে। যে ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যে (এনামুল ম্যাচ সর্বোচ্চ ৫১ বলে ৪৭ ছাড়া) ব্যাট করতে পারেনি। যদিও জিম্বাবুইয়ের অবস্থাও ছিল আরও ভয়াবহ। তারা ৮.৪ ওভারে ৩৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে অনেকটাই চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। তাই বলে তারা মনোবল হারায়নি। আর মনোবল হারায়নি বলে ম্যাচ জিতে মাঠ ছাড়তে পেরেছে। যে কথা বলছিলাম সেটাতে ফিরে আসি। একজন ক্রিকেটারের ম্যাচ জেতানোর নজির ক্রিকেটে ভূরিভূরি আছে। ব্যাটিং বা বোলিংয়ে অসাধারণ পারফর্ম করে জিতে ব্যাট উঁচিয়ে ড্রেসিং রুমে ফেরার অনেক নজিরের সঙ্গে আরও একটি নাম যোগ হলো। আর সেটা হচ্ছেÑ জিম্বাবুইয়ের নেভিল মাদজিভা। কী করেছেন নেভিল মাদজিভা সেটা এখন আর কারও অজানা নয়। একটি হেরে যেতে বসা ম্যাচকে জিতিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ঘুচিয়েছেন জিম্বাবুইয়ের বন্ধ্যত্ব। এর আগে জিম্বাবুইয়ে বাংলাদেশের কাছে সব রকম ক্রিকেটে সব মিলিয়ে টানা ১৩ ম্যাচে হেরেছে। আর তাই বুঝি তাদের ‘আনলাকি থার্টিন’কে ঘুচিয়ে জয়ের ধারায় ফিরিয়ে আনলেন মাদজিভা। জিম্বাবুইয়েকে পাইয়ে দিলেন এক অবিশ্বাস্য জয়। জিম্বাবুইয়ের সে জয় রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। শেষ ২ ওভারে জিম্বাবুইয়ের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ২৪ রানের। যদিও হাতে ছিল ৪টি উইকেট। তারপরও ২ ওভারে ২৪ রান খুব একটা সহজ ছিল না। সেই কঠিন কাজটাকেই সহজ করে দিলেন মাদজিভা। শেষ ওভারের আগের ওভারে বল করতে আসেন নাসির। এর আগে ২ ওভার বল করে তিনি ২১ রান দিয়েছিলেন। তবে এ ওভারে বিধি বোধহয় তার ওপর সদয় ছিলেন না। বল করতে এসেই তিনি হারাধনের ৪টি ছেলের একটি মেরে দিলেন। প্রথম বলে ৪০ (জিম্বাবুইয়ের পক্ষে সর্বোচ্চ) রান করা সেট ব্যাটসম্যান ওয়ালারকে ড্রেসিং রুমে পাঠিয়ে দিয়ে একটা অসাধারণ শুরু করেছিলেন। এর পরের গল্প শুধুই মাদজিভার। নাসিরের অসাধারণ শুরুটাকে পান্তা পান্তা করে দিলেন। যেখানে নাসিরের ম্যাচের নায়ক হবার কথা ছিল তাকে বানিয়ে দিলেন ভিলেন। নায়ক যেমন সিনেমার শেষ দৃশ্যে ভিলেনকে দুমাদুম মারে তেমনি নাসিরের প্রত্যেকটা বলকে তুলাধুনা করলেন মাদজিভা। প্রথম বলে নাসির ৪০ রান করা ওয়ালারকে আউট করে উইকেট সাফল্য পেলেও দ্বিতীয় বলে ছক্কা হাঁকালেন মাদজিভা। তৃতীয় বলে লং অফে ঠেলে দিয়ে নিলেন ডাবলস। চতুর্থ পয়েন্ট ও থার্ডম্যানের মাঝ দিয়ে গড়িয়ে বল সোজা বাউন্ডারি পার। এরপর এ ওভারের শেষ দুই বল বাকি আর জয়ের জন্য প্রয়োজন ৬ রান। কোন রিস্ক নিলেন না মাদজিভা। নেয়ার কোন সুযোগও ছিল না। সিদ্ধান্তটা তিনি আগেই নিয়ে ফেলেছিলেন। হয় এস্পার নয় ওস্পার। ৫ম বলে ক্রিজ ছেড়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। সজোরে বল আকাশে তুলে দিলেন মাদজিভা। বল মাঠের ওপারে গেল কিনা দেখার প্রয়োজনও মনে করলেন না। দৌড় দিলেন উইকেট তোলার জন্য। এমন একটি ম্যাচের উইকেট সংগ্রহে রাখার সাধ তার জাগতেই পারে। ৭ বল বাকি থাকতে জিম্বাবুইয়ে পেয়ে গেল ৩ উইকেটের এক স্মরণীয় জয়। ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’র পুরস্কার যে মাদজিভার হাতে শোভা পাবে সেটা আর বলার অপেক্ষাই রাখে না। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের পরাজিত শেষ ম্যাচের চালচিত্র। যদিও এই ম্যাচের বিবরণ দেয়া আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। এ খবর পাঠক আগেই জেনে গ্যাছেন। সুতরাং চর্বিত চর্বণে যাওয়া এ লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ দলের এই ব্যাটিং দৈন্য তথা এভাবে একটি ম্যাচ হারার নেপথ্য কারণ কী সেটাই খুঁজে বের করা। ২০১৫ সাল বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল বছর সে কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। এ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রাপ্তি সবচেয়ে বেশি। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ওয়ান-ডে স্টাটার্স পাওয়ার পর এত সাফল্য আর কোন বছরে পায়নি। এ বছরটায় বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে। গত এক বছর ধরে আমরা যে বাংলাদেশকে দেখছি এ যেন সে বাংলাদেশ নয়। নবেম্বর টু নবেম্বরের চিত্র দেখলে দেখা যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট পালকের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সাফল্য আর সাফল্য। যে বাংলাদেশ গত এক বছরে এই জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করেছে, নিউজিল্যান্ডকে নাস্তানাবুদ করে বিশ্বকাপ খেলতে গেছে। বিশ্বকাপে ক্রিকেটের জনক স্কটল্যান্ড ও আফগানিস্তানকে হারিয়ে কোয়ার্টারে ভারতকে চাপে ফেলেছিল সেটা কারও অজানা নয়। বিশ্বকাপের পরে দেশের মাটিতে পাকিস্তান, ভারত ও দ. আফ্রিকাকে সিরিজ হারিয়েছে। সেই দলকে জিম্বাবুইয়ের সঙ্গে জিততে বেগ পেতে হয়েছে। এ যেন এক অন্য বাংলাদেশ। এখন এ বাংলাদেশ আমাদের খুব অচেনা। এক সময় বাংলাদেশ এক ম্যাচ জিতলে দশ ম্যাচ হারতো। আর এখন! এখন বাংলাদেশ দশ ম্যাচ জিতে এক ম্যাচ হারে। এখন আর বাংলাদেশ কাউকে ভয় পায় না। জিম্বাবুইয়ের সঙ্গে এখনকার সেই বাংলাদেশের ১৩৫ রানে ইনিংস শেষ করার কথা নয়। এটা বাংলাদেশের ব্যাটিং দৈন্যর চিত্রই ফুটিয়ে তোলে। এক আধটা ম্যাচে ভাল করা ছাড়া গোটা সিরিজে বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান আহামরি ব্যাটিং নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। কোন একটা ম্যাচে একজন ভাল করলেও তার সে ভাল করার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছেন না। তার মানে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশ টি-২০ ম্যাচের ফরমেটটা এখনও বোধহয় ভাল করে রপ্ত করে উঠতে পারেনি। টি-২০ ম্যাচে যে স্ট্যামিনার প্রয়োজন বোধকরি আমাদের ছেলেদের সেটা পুরোটা নেই। এ ফরমেটটা নিয়ে আরও কাজ হওয়া দরকার বলে অনেকে মনে করেন। বিশ্বকাপের সময়ে বা তার পরে যে রকম টিম কম্বিনেশন ছিল সেটা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। একটা দলের জয়ের নেপথ্য রূপকার হচ্ছে, টিম কম্বিনেশন। দলের বোলাররা বরাবরের মতো এ ম্যাচেও ভাল করেছেন। বাংলাদেশ যে ম্যাচগুলো জিতেছে তার বেশিরভাগ ম্যাচের নেপথ্যনায়ক বোলাররাই। বিশেষ করে মুস্তাফিজ, আল আমিন, মাশরাফি। একজনের নাম বললে বলতে হয় মুস্তাফিজের কথা। এ ম্যাচেও তার বোলিং নৈপুণ্য অসাধারণ। তিনি ৪ ওভার বল করে ১২ রান দিয়ে ১টি উইকেট নেন। অধিনায়ক মাশরাফি, আল আমিন, আরাফাত সানিরাও এ ম্যাচে ভাল বল করেছিলেন। কিন্তু ডুবিয়েছেন নাসির। এ ম্যাচটি নিয়ে নাসিরকে অনেকদিন আফসোস করতে হবে। অনেকে বলবেন আরে ভাই, একটা ম্যাচ হেরেছে তাতে কী হয়েছে! ৪টিতে তো জিতেছে। এর আগে টানা ১৩ ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। একটা ম্যাচে হেরেছে তাতে কী হয়েছে! একটা ম্যাচ হারা বড় কথা নয়। কথা হচ্ছে, দলের পারফর্মেন্স নিয়ে। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল তাদের বাংলাদেশ সফর কিন্তু চূড়ান্তভাবে বাতিল করেনি। পঞ্চমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন একটি দল বাংলাদেশের কাছে হারবে সেটা তারা চায়নি। বাংলাদেশের বিশ্বকাপের পাফর্মেন্স ও বিশ্বকাপের পরে দেশের মাটিতে পাকিস্তান, ভারত ও দ. আফ্রিকার পরাজয়ে তারাও হারার ভয় পেয়েছিল। ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। আর এই ভয়ের কারণে তারা বাংলাদেশ সফর বাতিল করে। সন্ত্রাস একটা অজুহাত মাত্র। সন্ত্রাসের ভয়ে হলে তাদের ফুটবল দল বাংলাদেশে আসত না। এখন জিম্বাবুইয়ের সিরিজের পর অস্ট্রেলিয়াও জেনে গেছে, বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন আপ আগের সে ফর্মে নেই। তাদের ফর্মে একটু হলেও ভাটা পড়েছে। এ সময় তারা যদি তারা স্থগিত সিরিজটি খেলে ফেলে তাহলে তাদের সিরিজ হারানোর শঙ্কা কম থাকবে বা থাকবেই না। সেটা ভেবে যদি অজিরা আবার তাদের সফর কন্টিনিউ করতে চায় তাহলে আমাদের প্রস্তুতি কী? অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামার আগে দল নিয়ে আরেকবার ভাবা দরকার বলে অনেকে মনে করেন। তার আগে হারা ম্যাচের ভুল-ত্রুটি বের করে সেটা সংশোধন করা দরকার। এখন আর বাংলাদেশ তিনটে হেরে একটা জেতার দল নই। এখনকার বাংলাদেশ সব ম্যাচেই জিতবে, জিততে হবে। কেননা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে কীভাবে ম্যাচ জিততে হয় সেটা জেনে গেছে বাংলাদেশের সূর্যসন্তানরা। এখন দরকার তাদের নিয়মিত পরিচর্যায় রাখা। ফুলের সঙ্গে কাঁটা আর জয়ের উল্টোপিঠে পরাজয় তো থাকবেই। তাকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে, হবে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে। তাহলেই সাফল্যেও পাল্লাটা আরও ভারি হবে। লেখক : ক্রীড়ালেখক, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক [email protected]
×