ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্মল প্রকৃতি বিরান হচ্ছে ক্রাশার মেশিনে পরিবেশ নষ্ট

পাথর শিকারিদের থাবায় সৌন্দর্য হারাচ্ছে জাফলং

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১১ আগস্ট ২০১৫

পাথর শিকারিদের থাবায় সৌন্দর্য হারাচ্ছে জাফলং

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ পাথর শিকারিদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের জাফলং পর্যটন স্পট পিয়াইন নদীর বল্লাঘাট। বছরের পর বছর সরকারের উদাসীনতা আর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখানকার নির্মল প্রকৃতি বিরান হয়ে যাচ্ছে। অরক্ষিত পিয়াইন নদীতে গত ১২ বছরে সাঁতার দিতে ও গোসল করতে নেমে ৩৭ পর্যটকের সলিল সমাধি হয়েছে। বাংলাদেশে জাফলং একটি অতি পরিচিত স্থান। সিলেট নামের সঙ্গে জাফলংয়ের নাম জড়িয়ে আছে আদিকাল থেকে। প্রতিদিন সৌন্দর্যপিপাসুরা আগ্রহ নিয়ে এখানে ছুটে এসে নানা ভোগান্তির সম্মুখীন হন। বল্লাঘাট এলাকায় মাটি খুঁড়ে পাথর উত্তোলন ও পাথর ক্রাশার মেশিনের কারণে পরিবেশ এখন হুমকির সম্মুখীন। মাটি কেটে পাথর উত্তোলন বন্ধ, নিরাপত্তা দূরত্বে ক্রাশার মেশিন সরিয়ে নেয়া, জাফলং এলাকার ধ্বংস হয়ে যাওয়া সবুজ বনাঞ্চল পুনর্স্থাপন করা হলে জাফলং বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিগণিত হবে। জাফলংকে রক্ষা করতে এখনই সরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের জাফলং। প্রাকৃতিক সম্পদ আর সুন্দরের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল। উঁচু-নিচু পাহাড় টিলার গা ঘেঁষে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অবস্থান। অসংখ্য ঝর্ণা ধারা শোভাম-িত মেঘালয়ের আকাশছোঁয়া পাহাড়ের পাদদেশে সবুজের সমারোহ। তাই জাফলং বরাবরই পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। জাফলংয়ের কাছাকাছি তামাবিল স্থলবন্দর। অযতœ অবহেলায় জাফলংয়ের প্রাকৃতিক সুন্দর হারিয়ে যেতে বসেছে। গত ২৫-৩০ বছরে জাফলংয়ের প্রধান আকর্ষণ বল্লাঘাট এলাকা বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসা সৌন্দর্যপিপাসুদের এখন এখানে এসে কষ্ট ভরা বুক নিয়ে ফিরে যেতে হয়। জাফলংয়ের সৌন্দর্যরে অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে স্বচ্ছ জলের পিয়াইন নদী। তবে ক্রমেই যেন এক ‘আকর্ষণীয় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে পিয়াইন নদী। গত ১২ বছরে পিয়াইন নদীর বুকে লাশ হয়েছেন ৩৭ জন পর্যটক। নদীতে সাঁতার কাটতে, নৌকা চড়তে কিংবা গোসল করতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন তারা। সর্বশেষ গত ২২ জুলাই জিরো পয়েন্টে সাঁতার কাটতে গিয়ে ঢাকার কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগ ঘোষ ও আবদুল্লাহ অন্তরের সলিল সমাধি ঘটে। অরক্ষিত পিয়াইন নদীতে গত ২৫/৩০ বছরে পিয়াইন নদীতে কত পর্যটক মৃত্যুবরণ করেছেন, তার সঠিক কোন হিসেব কারও কাছে নেই। বিভিন্নভাবে সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়, গত ১২ বছরে পিয়াইন নদীতে লাশ হয়েছেন ৩৭ পর্যটক। প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমি সিলেট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই অঞ্চলে সারা বছরই বেড়াতে আসেন পর্যটকরা। বিভিন্ন ছুটিতে বা উৎসবে এখানকার পর্যটন স্পটগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন পর্যটকরা। তবে পর্যটকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চললেও সিলেটের প্রায় পর্যটন স্পটই অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। এসব স্থানে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা বা সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নেই কোন উদ্যোগ। ফলে প্রতিবছরই সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। সম্প্রতি সিলেটে টুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম শুরু হলেও সিলেটের মাত্র তিনটি পর্যটন স্পটে রয়েছে তাদের কার্যক্রম। তাও নেই কোন অবকাঠামোগত সুবিধা, পর্যটকদের তুলনায় পুলিশের সংখ্যাও একেবারে অপ্রতুল। ঝুঁকিপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের সচেতন ও সাবধান করে দিতেও নেই কোন উদ্যোগ। তবে পর্যটন পুলিশ, সিলেটের সমন্বয়ক এএসপি একেএম গণিউজ্জামন লস্কর বলেন, সিলেটে আগত পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সাবধান করতে উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। এ জন্য ব্যানার, সাইনবোর্ড ও লিফলেট তৈরি করছেন। যা পর্যটন স্পটগুলোতে সাঁটানো ও বিলি করা হবে। তিনি বলেন, সিলেটে আমাদের কার্যক্রম নতুন শুরু হয়েছে। তেমন অবকাঠামো নেই। লোকবলও কম। গণিউজ্জামান জানান, সিলেটের জাফলং, বিছনাকান্দি ও লালাখালে ৪৭ পুলিশ সদস্য পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন। শীঘ্রই রাতারগুলে টুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম শুরু হবে। জানা যায়, ২০০৭ সালে দেশে জরুরী অবস্থা জারির পর সিলেটের পর্যটন স্পটসমূহ পরিচর্যার জন্য সিলেটের পর্যটন শিল্পের উদ্যোক্তা ডাঃ জাকারিয়া আহমদকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। নিজেদের অসাবধনতা ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে এসে মৃত্যুর কোলে ঠাঁই নিতে হচ্ছে অনেককে। গত বছর জাফলংয়ে সাঁতার কাটতে গিয়ে পাঁচ পর্যটকের মৃত্যুর পর পিয়াইন নদীতে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ করে জেলা প্রশাসন। পুলিশ ও বিজিবির টহলও জোরদার করা হয় জাফলংয়ে। কিন্তু এসব উদ্যোগ যথাযথ না হওয়ায় কোন কাজে আসেনি। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত অপরূপ সৌন্দর্যে মোড়ানো জাফলংয়ে এখন সারা বছর পর্যটকদের আগমন ঘটে থাকে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এবং দুই ঈদের মৌসুমে হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে জাফলংয়ে। পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলরাশিতে মাখামাখি করেন দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। কিন্তু পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সেখানে নেই বললেই চলে। মাইকিং করে পর্যটকদের সাবধান করার মধ্য দিয়েই দায় সেরে নেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালেহ উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা পর্যটকদের সতর্ক করার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করি। মাইকিং করা হয়। সাইনবোর্ড লাগানো হয়। যারা সাঁতার জানেন না, তাদের বেশি পানিতে নামতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু অনেকেই সতর্কবাণী আমলে নেন না। তিনি জানান, নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। যে ভাবে জাফলং সৌন্দর্য হারাচ্ছে ॥ সিলেটের ৫টি পাথর কোয়ারির মধ্যে জাফলং অন্যতম। বল্লাঘাট বলে খ্যাত জাফলংয়ের এই এলাকাটি সীমান্তের জিরো পয়েন্টের কাছে অবস্থিত। পিয়াইন নদীর এপারে বল্লাঘাট আর ওপারে খাসিয়া পুঞ্জির অবস্থান। শীত মৌসুমে এক সময় নদীতে হাঁটুজল থাকত। নদীজুড়ে ছোট-বড় পাথর। স্বচ্ছ জলরাশির মধ্যে পাথরের ছড়াছড়ি। চোখজুড়ানো দৃশ্য। নদীর এপারে উঁচু-নিচু টিলা আর বন-জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে খাসিয়াদের ঘরবাড়ি। সারি সারি সুপারি গাছ। তাতে জড়িয়ে থাকা পানের গাছ। যা এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য ছিল বাড়তি আকর্ষণ। স্বাধীনতা-পরবর্তীতে জাফলং বল্লাঘাট পিয়াইন নদী থেকে পাথর উত্তোলন বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ’৮০ সালের পর ব্যাপক হারে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পাথর আহরণের কারণে পিয়াইন নদীর বুক ক্রমশ পাথরশূন্য হতে থাকে। প্রতিদিন ৫-৭শ’ ট্রাক পাথর সরবরাহ হয় জাফলং কোয়ারি থেকে। একদিকে মজুদ কমে যাওয়া অপরদিকে পাথরের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ১৫-১৬ বছর যাবত পাথর উত্তোলনের নামে জাফলং এলাকায় চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। পিয়াইন নদীর কোয়ারি এলাকায় এলোপাতাড়ি গর্ত করে ৫০ থেকে ১শ’ ফুট মাটির নিচ থেকে পাথর উত্তোলনের কাজ চলছে বছরের পর বছর ধরে। যা সম্পূর্ণ বেআইনী ও অবৈধ। স্থানীয়ভাবে বোমা মেশিন হিসেবে পরিচিত একধরনের মেশিন দ্বারা নদীর বুক থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে নদী যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে পরিবেশ। ছোট-বড় অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে পিয়াইনের বুক। বদলে গেছে পর্যটন স্পট বল্লাঘাটের চিত্র। কোয়ারিতে পাথরের মজুদ ফুরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাথর শিকারিদের দৃষ্টি পড়ে নদী তীরবর্তী এলাকার ওপর। যেখানে উঁচু-নিচু টিলা আর খাসিয়াদের অবস্থান ছিল, সেখান থেকে মাটি কেটে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। প্রায় দেড় যুগের ধ্বংস খেলায় বিশাল এলাকার টিলাভূমি সমতল হয়ে যায়। আর সেখানে স্থাপন হয় শত শত ক্রাশার মেশিন। রাত-দিন পাথরবোঝাই ট্রাকের আসা-যাওয়া, সে সঙ্গে শত শত ক্রাশার মেশিনে পাথর ভাঙ্গার শব্দ এলাকার বাতাস ভারি হয়ে আছে। জাফলং কোয়ারি এখন মূলত পাথরশূন্য। মাটি কেটে পাথর উত্তোলন ছাড়া এখানে পাথর পাওয়ার আর কোন ব্যবস্থা নেই এবং এই ব্যবস্থাতে শুধু এলাকার পরিবেশই ক্রমশ বিপর্যস্ত হচ্ছে না জাফলংয়ের অপার সৌন্দর্য বিরান হয়ে যাচ্ছে। পাথর আমদানি ॥ জাফলং পাথর কোয়ারির কয়েক কিলোমিটারের দূরত্বে তামাবিল স্থলবন্দর। সীমান্তের এই পথ দিয়ে কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি হয়ে থাকে। সম্প্রতি ভারত থেকে কয়লা, চুনাপাথরের সঙ্গে বোল্ডার পাথর আমদানি করা হচ্ছে। আমদানিকৃত পাথরের মূল্য তুলনামূলকভাবে জাফলং মাটি কেটে উত্তোলিত পাথরের চেয়ে কম। প্রয়োজনীয় পাথর ভারত থেকে আমদানি করে জাফলংকে ধ্বংসের হাত রক্ষা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। জাফলং এলাকায় বিপুল পরিমাণ ভূমি রয়েছে বন বিভাগের। বন বিভাগের সড়কের পাশের ভূমি দখল করে ক্রাশার মেশিন বসিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। তামাবিল পয়েন্ট থেকে জাফলং পর্যন্ত ৩-৪ কিলোমিটার এলাকায় পাথর ব্যবসা বন্ধ করে জাফলং এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। জৈন্তাপুর উপজেলা সদরে রয়েছে রাজবাড়ি। রানী জৈন্তেশ্বরী যেখানে বসে বিচারকাজ পরিচালনা করতেন। ইতিহাসের প্রয়োজনেও সেই স্থানগুলোকে সংরক্ষণ করা দরকার। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রাজবাড়ির ঐতিহাসিক নিদর্শন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকরা এসে ঐতিহাসিক এই নিদর্শনগুলোর দুরবস্থা দেখে হতাশ হয়ে ফিরে যান। জৈন্তা থেকে জাফলং যাওয়ার পথে শ্রীপুর পাথর কোয়ারি। একসময় এখানে নিয়মিত সিনেমার শূটিং হয়েছে। পর্যটকদের নজরকাড়া এই এলাকায় যাওয়ার রাস্তাটির এমন বেহাল অবস্থা যেখানে ইচ্ছা থাকলেও যাওয়ার উপায় নেই। খাসিয়া মেঘালয় পাহাড়ের গা ঘেঁষে জৈন্তাপুর উপজেলার এই এলাকায় রয়েছে সুন্দর সবুজের সমারোহ। পর্যটকদের সুবিধা ও প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন। তাহলে জাফলং বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন এলাকায় পরিণত হবে। আর এ ব্যাপারে এখনই এগিয়ে আসা দরকার।
×