ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিন্ডিকেট ॥ ছাত্রলীগের আলাদিনের চেরাগ!

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৮ জুলাই ২০১৫

সিন্ডিকেট ॥ ছাত্রলীগের আলাদিনের চেরাগ!

মুহাম্মদ ইব্রাহীম সুজন ॥ সিন্ডিকেট শব্দটির সঙ্গে ছাত্রলীগের প্রায় প্রতিটি নেতাকর্মীই কমবেশি পরিচিত। আসন্ন ২৮তম কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সংগঠনের তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত সবার মাথাতেই সিন্ডিকেট শব্দটি ঘুরপাক খাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে নেতা হওয়াটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সংগঠনের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে বা যিনি ছাত্রলীগের নেতা হন, তা ঠিক করে দেন সংগঠনকে ঘিরে গড়ে ওঠা অতি জটিল সিন্ডিকেট। যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সংগঠনের প্রাক্তন নেতৃবৃন্দ। সিন্ডিকেটের কবল থেকে সংগঠনকে রক্ষায় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা। তারা মনে করেন, শেখ হাসিনাই পারেন এই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে। অতীতের মতো তিনি নিজে কমিটির নেতা নির্বাচন করে দিলে ছাত্রলীগ শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি সংগঠন নিয়ে অনেকের ব্যবসাবাণিজ্যও বন্ধ হবে। আসন্ন সম্মেলনে সভাপতি পদপ্রত্যাশী একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ছাত্রলীগই আমার শেষ ঠিকানা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ও আদর্শকে ভালবেসে সংগঠনের জন্য কাজ করি। পড়ালেখা করছি দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের হতাশ হতে হয়। এখন নেতা হতে যোগ্যতা লাগে না, ‘সিন্ডিকেট’ যাকে নেতা হিসেবে দেখতে চায় সেই নেতা হবে। সেক্ষেত্রে ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের অঘোষিত দায়িত্ব হচ্ছে ‘বড় ভাই’ ঠিক করে আপ্রাণ তার মনোরঞ্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আর কিছুই দরকার নেই।’ সিন্ডিকেট বিষয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বক্তব্য হচ্ছে, এই সিন্ডিকেটই ছাত্রলীগের আলাদিনের চেরাগ। অর্থাৎ যারা এই চেরাগ হাতে পাবে, তারাই আসবেন পরবর্তী নেতৃত্বে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলনের মাধ্যমে দায়িত্ব পাওয়া নেতৃবৃন্দ সরাসরি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকের যোগ্যতা ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও, এরা কোন না কোনভাবে ‘বড় ভাই’ দ্বারা নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। এ কারণে অনেক যোগ্য ও ত্যাগী নেতাকর্মী নেতা হতে পারেননি। আসন্ন কেন্দ্রীয় সম্মেলনেও এই সিন্ডিকেটের আশঙ্কায় অনেক নেতাকর্মীই হতাশায় ভুগছেন। এ বিষয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ছাত্রলীগে কোন সিন্ডিকেট নেই। এটা সমালোচকদের অপপ্রচার। ছাত্রলীগের একমাত্র সিন্ডিকেট হচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা শেখ হাসিনা ব্যতীত অন্য কারও দ্বারা প্রভাবিত নই।’ সংগঠনের ২৭তম সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংগঠনটি দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের। তবে এবার এখনও কাউকে দায়িত্ব দেয়ার কথা জানা যায়নি। সম্মেলনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ শুরু করেছে। সিন্ডিকেট বিষয়ে আবার পাল্টা বক্তব্যও পাওয়া গেছে। একদল নেতাকর্মী মনে করেন, ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য জানতে সাবেক নেতৃবৃন্দের কাছে যাওয়ার দরকার পড়ে। কিছু নেতৃবৃন্দের সুচিন্তিত মতামত ও দিকনির্দেশনাতেই ছাত্রলীগ পরিচালিত হয়। ছাত্রলীগের সাবেক হওয়া কেউ কেউ এই জায়গাটি নিতে ‘অনুপ্রবেশ’ করার চেষ্টা করছেন। তারাই ‘সিন্ডিকেট’ ইস্যুটি প্রচার করছেন। এটি বন্ধ করা উচিত। ২০০৬ সালে প্রথম সিন্ডিকেটের প্রভাব পড়ে ছাত্রলীগে। সে বছরই প্রথম বয়সসীমা ২৯ নির্ধারিত হয়। সাধারণত যখন নতুন নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ও সাবেক নেতৃবৃন্দ যখন সমঝোতায় আসতে পারে না তখন ভোটগ্রহণ হয়। কিন্তু ভোটগ্রহণ হলে সিন্ডিকেট এটিকে নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। ভোটাররা তাদের নিজেদের পছন্দানুযায়ী ভোট দিতে পারেন না। উপরের নির্দেশেই তাদের ভোট দিতে হয়। এতে ভোটকে ম্যানুপুলেট করে সিন্ডিকেট পছন্দের প্রার্থীকে বের করে নিয়ে আসে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় টাকা নিয়ে ভোট বেঁচাকেনার অভিযোগও পাওয়া যায়। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বাদ পড়েন অনে প্রতিভাবান নেতা। ২০১১ সালের সম্মেলনেও সিন্ডিকেটের কবলে পরে বাদ পড়েন আলোচনায় থাকা অনেক নেতা। বর্তমান কমিটি এ পর্যন্ত ৮৫টি জেলা কমিটি গঠন করেছেন। অভিযোগ রয়েছে এসব কমিটিতে খাগড়াছড়ি ও লালমনিরহাট বাদে প্রায় প্রতিটিতেই সিলেকশনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করা হয়েছে। এবারও সিন্ডিকেট ভোটের মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বের করে নিয়ে আসবে। কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সময় এলেই তৎপর হয় এ সিন্ডিকেট। আর এর মাধ্যমে বাদ পড়ে যান সংগঠনের দুঃসময়ে রাজপথে থাকা ত্যাগী ও উৎসর্গীপ্রাণ নেতাকর্মীরা। গত ২৮ এবং ৩০ মে অনুষ্ঠিত ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলনেও এই সিন্ডিকেট সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে থেকে নামমাত্র ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখা কর্মীরাই এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে নেতৃত্বে এসেছেন। এই ঘটনার জের ধরে ক্ষোভের বহির্প্রকাশ হিসেবে সংগঠনের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদারের বাসায় হামলা করেন পদবঞ্চিত নেতারা। কমিটি ঘোষণার পরপরই সদ্য সাবেক হওয়া ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি আনিসুজ্জামান আনিসের অনুসারীরা ৬০ থেকে ৭০টি মোটরসাইকেল নিয়ে সেগুনবাগিচায় লিয়াকত সিকদারের বাসায় হামলা চালায়। এতে ওই বাসার নিরাপত্তারক্ষী এবং লিয়াকত শিকদারের ড্রাইভার তফসির মারাত্মক আহত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদেও বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের অনুসারী কাছের ‘ছোট ভাইদের’ ক্ষমতায় বসিয়েছেন। আসছে ২৫-২৬ জুলাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
×