ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যে সব অপরাধে সাজা-

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৭ জুন ২০১৫

যে সব অপরাধে সাজা-

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন সেই অভিযোগ আপীল বিভাগের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে। একাত্তর সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্যতম হোতা ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধতন দায়) জন্যও দায়ী হয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রেখেছেন আপীল বিভাগ। ট্রাইব্যুনাল যেভাবে মুজাহিদকে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতে দায়ী করেছিলেন, রায় বহাল থাকায় একই দায় সেভাবেই রয়েই গেল একাত্তরের এই আলবদর প্রধানের। সর্বোচ্চ আদালত বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার জন্য ৬ নম্বর অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- বহাল রেখেছেন। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা ৭টি অভিযোগ আনে। এর পর প্রসিকিউশন পক্ষ যাচাই বাছাই করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে ফাঁসতে ঝুলিযে মৃত্যুদ- প্রদান করেছিল। ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, আলবদর হলো জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র গ্রুপ। আলবদর গঠিত হয়েছিল ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীদের দ্বারা। জামায়াতে ইসলামী মিলিটারিদের কার্যক্রমে সাহায্য করার জন্য ২টি শাখা গঠন করে। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে বলা যেতে পারে, জামায়াতে ইসলামী, আলবদর, রাজাকার,আলশামস এবং শান্তিকমিটি গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। জামায়াতে ইসলামী ২টি প্যারমিলিটারি ইউনিট গঠন করে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫০ হাজার রাজাকার রিক্রুট করা হয়। জামায়াতে ইসলামী আলবদরের দ্বারা সংগঠিত হত্যা, নির্যাতনের দায় এড়াতে পারে না। রায়ে বলা হয়, মুজাহিদ তৎকালীন ছাত্রসংঘের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আলবদর বাহিনী তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতে থাকা নেতা হিসেবে গণহত্যা সংঘটিত করা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, হত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এ অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে ৬ নম্বর অভিযোগে। মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত ষষ্ঠ অভিযোগটি প্রসিকিউশন সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রমাণিত ছয় নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও ওই স্থানে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ অপরাধজনক নানা কার্যক্রম চালায়। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হবার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত উর্ধতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আসামি ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানসহ সারা বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদিসহ যাবতীয় মানবতবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা সংঘটিত করেন। প্রসিকিউশন পক্ষ আসামির বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ এনেছিল তার মধ্যে রয়েছে, অভিযোগ-১ ॥ একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ থেকে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। আসামির পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭/৮ যুবক তাকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। আজ অবধি তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি, যা আন্তজার্তিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩(২) (এ) (জি) এবং ৪(১), ৪(২) ধারায় বর্ণিত অপরাধ করেছেন। উক্ত আইনের ২০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটন করেছেন। ঐ সময় সিরাজ উদ্দিন হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঐ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নিজ পত্রিকায় ভাষ্যকার পরিচয়ে ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লিখে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এদেশীয় এজেন্টদের বাংলাদেশের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর হয়রানির চিত্র তুলে ধরেন। উক্ত প্রবন্ধ প্রকাশের পর জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ শিরোনামে পাল্টা প্রবন্ধ ছাপা হয়। ঐ প্রবন্ধে সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে সমালোচনা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাতে আনুমানিক ৩টার সময় তার ৫ নম্বর চামেলীবাগের ভাড়া করা বাসায় ৭/৮ রাইফেলধারী যুবক ঢুকে পড়ে। তাকে তারা নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। অভিযোগ-২ ॥ একাত্তরের মে মাসে একদিন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নেতৃত্বে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানার বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের প্রায় তিন শ’ থেকে সাড়ে তিন শ’ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৫০ থেকে ৬০ হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩(২) (এ)(সি) (জি) এবং ৪(১) ধারায় অপরাধ সংঘটিত করেছে। অভিযোগ-৩ ॥ একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে যে কোন একদিন ফরিদপুর শহরের খাবাশপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট (রথখোলার) মৃত রমেশচন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ, প্রকাশÑ বাবুকে আটক করে। বেলা অনুমান ১১টার দিকে ফরিদপুর পুরাতন সার্কিট হাউসে তাকে আসামি আলী আহসান মুজাহিদের সামনে পাকিস্তানী সেনা অফিসার মেজর আকরাম কোরাইশীর নিকট হাজির করা হয়। তখন মুজাহিদ উক্ত মেজরের সঙ্গে কথা বলার পর তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার একটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হয়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বিহারী ক্যাম্পের উত্তর পাশের আব্দুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে রাজাকাররা আটকে রাখে। পরে রাতে রণজিৎ নাথ বাবু তার আটক ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে ঘর থেকে পলায়ন করে জীবন বাঁচান। অভিযোগ-৪ ॥ একাত্তরের ২৬ জুলাই সকালবেলা ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা হতে স্থানীয় রাজাকাররা মোঃ আবু ইউসুফ, প্রকাশÑ পাখি, পিতা-মৃত মোঃ জয়নাল আবেদীন, সাং-পূর্ব গোয়ালচামট খোদাবক্সপুর, থানা-কোতোয়ালি, জেলা ফরিদপুরকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করা হয়। এর পর পাখিকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখে। বন্দীদের মধ্যে আবু ইউসুফ, প্রকাশÑ পাখিকে দেখে আসামি মুজাহিদ সঙ্গে থাকা পাক আর্মি মেজরকে কিছু একটা বলার পরই তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। সেখানে ১ মাস ৩ দিন আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। নির্যাতনের ফলে আবু ইউসুফ, প্রকাশ- পাখির বুকের ও পিঠের হাঁড় ভেঙ্গে যায়। অভিযোগ-৫ ॥ ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরাতন এমপি হোস্টেল আর্মি ক্যাম্পে যায়। সেখানে তারা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করে এবং পাকিস্তানী আর্মি ক্যাপ্টেনকে বলে যে, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের পূর্বেই তাদরেকে হত্যা করতে হবে। আসামি অন্যদের সহায়তায় আটকদের একজনকে ব্যতীত অন্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দীদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। অভিযোগ-৬ ॥ একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও উক্ত স্থানে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ অপরাধজনক নানা কার্যক্রম চালায়। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হবার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত উর্ধতন আর্মি অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এই ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানসহ বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদি যাবতীয় মানবতবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা সংঘটিত করে। অভিযোগ-৭ ॥ একাত্তরের ১৩ মে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে। শান্তি কমিটির বৈঠক শেষে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বকচর গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালিয়ে বিরেন্দ্র সাহা, উপেন সাহা, জগবন্ধু মিস্ত্রি, সত্য রঞ্জন দাশ, নিরোদ বন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করা হয়। উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকা দিয়ে তার স্বামীর মুক্তি চান। রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝুমা রানীকে ধর্ষণ করে। পরে আটক হিন্দু নাগরিকদের হত্যা করে। তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অনিল সাহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।
×