ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গরমে হাঁসফাঁস মানুষ ॥ আর্দ্রতার দাপটে বেড়েছে অস্বস্তি

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৩ মে ২০১৫

গরমে হাঁসফাঁস মানুষ ॥ আর্দ্রতার দাপটে  বেড়েছে অস্বস্তি

নিখিল মানখিন ॥ তাপমাত্রা এখনও চল্লিশ স্পর্শ করেনি। অথচ মনে হচ্ছে তার বহুগুণ বেশি! বাতাসে অত্যধিক গরম ভাব। গ্রীষ্মের তীব্র দহন। তপ্ত গরমে অতিষ্ঠ দেশবাসী। এখনই বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে আবহাওয়া দফতর। আর্দ্রতার দাপটেই শুক্রবার বেড়ে যায় অস্বস্তির মাত্রা। সকাল থেকেই তাপ ছড়াতে শুরু করছে সূর্য। মাটি থেকে তাপ ঠিকরে বেরোচ্ছে। শরীর চাইছে ঘাম ঝরিয়ে নিজেকে ঠা-া রাখতে। মানুষ ঘামছেও কুলকুলিয়ে। কিন্তু সেই ঘাম শুকাতে পারছে না, উল্টো গায়ে জমে থাকছে। আগামী কয়েকদিনে বৃষ্টিপাতের খবর দিতে পারছে না আবহাওয়া অফিস। বরং অধিদফতরের পূর্বাভাসে আজ শনিবারও তাপপ্রবাহ নতুন নতুন এলাকায় বিস্তারলাভ করার খবরে অস্বস্তিতে পড়েছে দেশবাসী। প্রশান্তি পেতে অপেক্ষা করছে এক পশলা বৃষ্টির। চলতি মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অফিস। পাশাপাশি দু’টি নিম্নচাপ এবং একটি ঘূর্ণিঝড়ের। এখন পর্যন্ত কোনটাই বাস্তবে রূপ নেয়নি। তবে আবহাওয়া অফিসের দেয়া তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার পূর্বাভাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের তাপমাত্রা। হাঁসফাঁস গরমের মাঝে গলদঘর্ম অবস্থা দেশবাসীর। ঘর্মাক্ত কলেবরে হাঁসফাঁস। জমা ঘামের চাপে শরীরের ভিতরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের হারও। এর পেছনের কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মধ্য ভারত থেকে ধেয়ে আসছে গরম বাতাস। এখানে বায়ুম-লের নিচের স্তরে অবস্থান করছে ঘূর্ণাবর্ত। ঘূর্ণাবর্তের টানে সমুদ্র থেকে ঢুকছে জলীয়বাষ্প। সকাল সাড়ে আটটার পরই পাল্টে যাচ্ছে আবহাওয়ার চিত্র। আধা কিলোমিটার হাঁটলেই ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরীর। দুপুর গড়াতেই একটু খানি ছায়ার খোঁজে সকলেই। স্বস্তি খুঁজতে ভিড় বাড়ছে ঠা-া পানীয়ের দোকানে। শুক্রবার ছুটির দিনে রাজধানী ঢাকায় তাপমাত্রা আরও বাড়ল। কোন স্বস্তির খবর শোনাতে পারল না আবহাওয়া অধিদফতর। বরং শুনিয়ে দিল যে, বঙ্গোপসাগরের ওপর একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হওয়ায় বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকবে। ফলে বাড়বে অস্বস্তিকর গরম। এ সময়ে তাপপ্রবাহ ও গরম ব্যতিক্রমী ঘটনা নয় বলে জানিয়ে দেশবাসীকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন আবহাওয়াবিদরা। তীব্র নয়, মৃদু তাপপ্রবাহ বইছে এখন। সঙ্গে যোগ হয়েছে বৃষ্টিশূন্যতা। দুইয়ে মিলে বেশ উত্তপ্ত সারা দেশ। গরমের মাত্রাটা খানিকটা বেশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলজুড়ে। আজকালের মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের মধ্যাঞ্চলে তাপপ্রবাহের বিস্তার হতে পারে। দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর (বর্ষা) বাংলাদেশে প্রবেশ নিয়েও দেশের আবহাওয়া অধিদফতর ও আন্তর্জাতিক আবহাওয়া অফিসসমূহের পূর্বাভাস নিয়েও চলছে আলোচনা। ভারতের আবহাওয়া অফিস বলছে, এবার মৌসুমী বায়ু আগেই প্রবেশ করবে, তবে বৃষ্টিপাত কম থাকবে। আর বৃষ্টির সুখবর দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস। তাঁরা বলছে, মৌসুমি বায়ু প্রতিবেশী মিয়ানমারের ইয়াঙগুন শহর পর্যন্ত চলে এসেছে। জ্যৈষ্ঠের এই দহন খুব একটা স্থায়ী হবে বলে মনে করছেন না তাঁরা। তাঁদের মতে, খানিকটা ঝড়-বৃষ্টি, এর সঙ্গে মৌসুমী বায়ু যোগ হলে গরমের দাপট কমে যাবে। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শাহ আলম জানান, ১০ জুনের মধ্যে মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের আকাশে চলে আসতে পারে। তাই বৃষ্টি হলে এবার গরমের মাত্রা অন্যান্য বছরের মতো বাড়বে না বলে জানান তিনি। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদদের এই আশ্বাসে যেন ভরসা পাচ্ছে না কাঠফাটা রোদ ও ভ্যাপসা গরমে অতীষ্ঠ দেশবাসী। গ্রীষ্মের দাবদাহে শুধু মানুষ নয়, গোটা প্রাণীকুল অস্থির হয়ে পড়েছে। দিনভর কাঠ ফাটা রোদ। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরও ভ্যাপসা গরমের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। ঘন ঘন লোডশেডিং যেন বাড়িয়ে দেয় দুর্ভোগের মাত্রা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরেও গরমের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলছে না। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই এতটুকু। ক্লান্তি দূর করতে কেউ পান করছেন ডাবের পানি, কেউবা খাচ্ছেন শসা, ক্ষীরা। তারপরও স্বস্তি মিলছে না। কারওয়ান বাজারের ফল ব্যবসায়ী মোঃ জলিল জানান, গরম বেড়ে যাওয়ায় ডাব, আনারস, তরমুজ, শসা, বাঙ্গি, বেলসহ বিভিন্ন ফল বেশি বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, কয়েক দিন ধরে ডাবের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। চাহিদামতো ডাব সরবরাহ করতে পারছি না। খুচরা বাজারে ৩৫ টাকার কমে কোন ডাবই নেই। এদিকে তীব্র গরমে হিটস্ট্রোক, সর্দি-কাশি, জ্বর, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চলতি মাসে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন আবহাওয়াবিদরা। এমন অবস্থায় হিটস্ট্রোক ও ডায়রিয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। গত বছর এমন সময়ে হিটস্ট্রোকে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে। রাজধানীতে ইতোমধ্যে তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন করে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। তাপমাত্রা বাড়লে ডায়রিয়ার জীবাণুগুলোর সংক্রমণের ক্ষমতা বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়রিয়ামুক্ত থাকতে পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। আর হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। অতি প্রয়োজন না হলে রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। রোদে কাজ করার সময় মাথা ও শরীরে ঢাকনা দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় কিছু খেতে হবে। ঢিলাঢালা পোশাক বিশেষ করে সুতি কাপড় পরিধান করতে হবে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে ছায়াচ্ছন্ন স্থানে শুইয়ে দিতে হবে। ঠা-া পানি(রেফ্রিজারেটরের পানি নয়) নিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। এতে উন্নতি না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানী ও ইউনিট প্রধান ড. মোঃ শাহাদাত হোসেন বলেছেন, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে গেলেই এদেশের মানুষের হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। যতটা সম্ভব প্রখর রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। বেশি মাত্রায় পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আবহাওয়া অফিসের পরামর্শও প্রায় একই। ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের তাপমাত্রা এদেশের মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর উপরে চলে গেলে তা হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ যা সহ্য করতে এ দেশের মানুষ অভ্যস্ত নন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় বিশেষ করে ‘ওর স্যালাইন’ খেতে হবে। ঢিলেঢালা জামা পরিধান করতে হবে। আর হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে ছায়ায় নিতে হবে। শরীর মুছে দিতে হবে। এতে আক্রান্তের অবস্থার উন্নতি না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের আগে শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থার বেশি থাকবে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। বমি বমি ভাব দেখা দিবে। মাথা ঘুরতে থাকবে। প্রস্রাব কমে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তের চাপও কমে যাবে। এ সব লক্ষণ দেখা দিলেই ছায়াচ্ছন্ন স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই বিশেষ সতর্ক থাকার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তিনি।
×