ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল মান্নান

কিসমতের কিসমত ও আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৯ মার্চ ২০১৫

কিসমতের কিসমত ও আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন

॥ এক ॥ ঠিক করেছিলাম বাংলাদেশের ৪৫তম স্বাধীনতা দিবসটিতে কিছু অলস সময় কাটাব। সে মতে প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম, দিনের অর্ধেকটা কাবার করে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে পত্রিকাগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে আরও এক পসলা দীর্ঘ তন্দ্রা। তারপর দুপুরের খাবার, এরপর দীর্ঘদিনের অভ্যাসের দিবানিদ্রা। মাঝেমধ্যে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারতকে বিধ্বস্ত করার দৃশ্য উপভোগ করা। মাঝপথে বাদ সাধলেন চট্টগ্রামের আমার অগ্রজ প্রতিম বন্ধু বখতিয়ার ভাই, মানে বখতিয়ার নূর সিদ্দিকী। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা। বেশ অনেকদিন ধরেই শরীরটা ভাল যাচ্ছে না বখতিয়ার ভাইয়ের। চট্টগ্রাম থেকে ফোন করে মাঝেমধ্যে আমার এই প্রিয় শহরের রাজনীতির খবরাখবর দেন। আমার কাছে সবসময় মনে হয় চট্টগ্রামের রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির চেয়েও জটিল। এই মুহূর্তে চট্টগ্রামের রাজনীতির গরম খবর হচ্ছে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। বেশ কয়েকদিন ধরেই এই নির্বাচন নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। সকলের আগে এই নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন তিন তিনবারের নির্বাচিত মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। মহিউদ্দিন চৌধুরী হচ্ছেন এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে এসেছেন। তুলনা করা হয়ত ঠিক হবে না, তারপরও বলতে হয় তিনি বঙ্গবন্ধুর সকল রাজনৈতিক গুণাবলী ধারণ করেছিলেন। সত্যিকার অর্থে জনমানুষের নেতা তিনি। ১৯৯৪ সালে তিনি বেগম জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন মীর মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিনকে ১৬ হাজার ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে তিনি এক অখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বী দিলীপ ভদ্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একতরফাভাবে বিজয় লাভ করেন। ২০০৫ সালেও তিনি মীর মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিনকে এক লাখ ভোটে পরাজিত করেছিলেন। ২০১০ সালে তিনি এমন একজন ব্যক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন যিনি বড়জোর একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। বিজয়ী প্রার্থী মনজুর আলম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শিষ্য ছিলেন এবং দীর্ঘ ১১ বছর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মনজুর আলম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে বিএনপি মনজুর আলমকে জিতিয়ে এনেছিল। এই বিজয়ে মনজুর আলমের তেমন কোন কৃতিত্ব ছিল না। ছিল মহিউদ্দিন চৌধুরীর কিছু কৌশলগত ভুল সিদ্ধান্ত আর তাঁর চারপাশে থাকা চাটুকারদের অবদান। এই বিষয়ে পরে লেখার ইচ্ছা রইল। ফিরে আসি আমি বখতিয়ার ভাই প্রসঙ্গে। তিনি বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, বঙ্গবন্ধুর খুনীর লাশ যেন কিছুতেই বাংলাদেশে না আসে। প্রথমে বুঝতে পারি না। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের একজন এবং জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত ঘাতক ক্যাপ্টেন (অব.) কিসমত হাসেম বৃহস্পতিবার ভোর ৬টায় কানাডায় মৃত্যুবরণ করেছেন। পঁচাত্তরের ঘাতকরা খোন্দকার মোশতাকের দৃষ্টিতে ছিল সূর্যসন্তান। তাদের বিচার বন্ধ করার জন্য তিনি একটি ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, যা জিয়া ক্ষমতা দখল করে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে তাকে আইনে রূপ দিয়েছিলেন। জিয়া এসব ঘাতককে পরবর্তীকালে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে উচ্চপদে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। বেগম জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ঘাতকদের এক শীর্ষ নেতা কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদকে সংসদ নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বানিয়েছিলেন। তারও আগে জেনারেল এরশাদ কর্নেল ফারুককে দেশে ফিরিয়ে এনে ফ্রিডম পার্টি প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। পরে ফারুক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ফারুক-রশিদ দু’জনই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি। ফারুকের মৃত্যুদ- ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সব খুনী বা তাদের আত্মীয়স্বজন হয় সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন অথবা তাদের রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষভাবে নিজেদের যুক্ত করেছেন। কিসমত হাসেমের ভাই শওকত হাসেম শকু বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর। ফ্রিডম পার্টির চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ফজলে খোদা তোতন বর্তমানে বিএনপির মধ্যম সারির নেতা এবং পুলিশের খাতায় বড় মাপের পেট্রোলবোমার কারিগর। তাকে দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ খুঁজছে। বখতিয়ার ভাই বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন, হাসেমের মৃতদেহ যেন কিছুতেই বাংলাদেশে আনতে দেয়া না হয়। বখতিয়ার ভাইকে বলি তার কোন সম্ভাবনা নেই, কারণ গত বছর পাকিস্তানে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের মৃত্যু হলে তার পরিবার তার মৃতদেহ বাংলাদেশে আনার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু জনরোষের ভয়ে মৃতদেহ পাকিস্তানেই সৎকার করা হয়। সত্তরের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে যে দু’জন সদস্য আওয়ামী লীগের বাইরে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাঁর একজন ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায় আর অন্যজন ময়মনসিংহের নূরুল আমিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দু’জনই পাকিস্তান সামরিক জান্তাকে সমর্থন করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে উভয়ই পাকিস্তানে পালিয়ে যান। নূরুল আমিন পরে ভুট্টোর উপ-রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হলে তাঁকে করাচিতে জিন্নাহ্র সমাধিসৌধে দাফন করা হয়। রাজা ত্রিদিব রায় ভুট্টোর মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন এবং পাকিস্তান সরকারের পক্ষে জাতিসংঘে গিয়ে বাংলাদেশকে সদস্যপদ না দেয়ার জন্য ওকালতি করে প্রথম দফায় চীনের সহায়তায় সফল হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানে ফিরে এলে ভুট্টো সকল প্রটোকল ভঙ্গ করে তাঁকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছিলেন। পরে তিনি বিদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর স্ত্রী বিনীতা রায়কে জিয়া মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছেÑ কিসমত হাসেমকে শুক্রবার কানাডায় দাফন করা হয়েছে। নূরুল আমিন বা রাজা ত্রিদিব রায়ের মতো কিসমতেরও কিসমত খারাপ নিজ দেশে তার নিজের জন্য দু’গজ জায়গা হলো না। অথচ এরশাদ পতনের আগ পর্যন্ত কিসমত নিয়মিত বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করতেন। ॥ দুই ॥ যদিও দলের কিছু বাঘা বাঘা নেতা স্বীকার করতে চান না, তথাপি বলতে হয় বিএনপি নামক দলটি এখন চরম বেকায়দায়। এমনটি চলতে থাকলে হয়ত আর কিছু দিনের মধ্যে দলটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বড়জোর বাংলাদেশের নয়া মুসলিম লীগ হিসেবে টিকে থাকবে। এটি রাজনীতির জন্য ভাল নয়! কারণ একটি দেশে গণতন্ত্র বিকাশ লাভ করতে হলে একাধিক সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে এই শূন্যতা পূরণ করতে পারত বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু তাদের তত্ত্বসর্বস্ব রাজনীতির কারণে এই বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর আর কোন ভবিষ্যত নেই। বর্তমানে তাদেরও একমাত্র পুঁজি জামায়াত-বিএনপির মতো কারণে-অকারণে আওয়ামী লীগ বিরোধিতা। কথায় কথায় তাঁরা আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এবং শেখ হাসিনা আর বেগম জিয়াকে একপাল্লায় মাপেন। বিএনপি যদি আমলা আর ব্যবসায়ীনির্ভর রাজনৈতিক দল না হয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীনির্ভর দল হওয়ার চেষ্টা করত এবং জামায়াত হতে নিজেদের বিযুক্ত করতে পারত তা হলে তাদের বাংলাদেশে একটি সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল এবং সেই সম্ভাবনা এখনও আছে। তবে তার আগে তাদের ঠিক করতে হবে দল কে চালাবে। দল যদি একজন অর্বাচীন তারেক রহমানের হাতে সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়া হয় তা হলে তার দলটি আগামীতে আরও বিপদে পড়বে। বেগম জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন তবে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতার ঘাটতি পর্বতসম। বর্তমানে তিনি তাঁর পুত্রের হাতে একজন, পুতুল এবং রিমোট কন্ট্রোলে চালিত। তিনি প্রায় তিন মাস তাঁর গুলশান কার্যালয়ে এক অজ্ঞাত কারণে স্বেচ্ছায় অবরোধবাসিনী (অন্তঃপুরবাসিনী) হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবসে আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে তিনি শহীদ মিনার অথবা জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। এটি একটি শুধু অমার্জনীয় অপরাধই নয়, ভাষা শহীদ আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের প্রতি চরম অবমাননার সমতুল্য। অথচ তিনি ও তাঁর দল দাবি করেন তাঁদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া নাকি স্বাধীনতার ঘোষক! বেগম জিয়া গত জানুয়ারির ৩ তারিখ থেকে তাঁর গুলশান অফিসে অবরোধবাসিনী হয়েছেন। ৫ তারিখ তাঁর দলের এক নির্ধারিত মহাসমাবেশে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার কথা ছিল। এই মহাসমাবেশ হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে এই আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ বিএনপিকে এই মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি। তারপরও তিনি যাবেন সেই মহাসমাবেশে, যা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। অন্য উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর গুলশান অফিস থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাঁকে বাধা দেয়। তাৎক্ষণিক তিনি সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ চলবে। এরপর থেকে তিনি অবরোধবাসিনী। এর কয়েকদিন পর ঘোষিত হলো প্রতি সপ্তাহের কার্যদিবসে দেশে হরতাল চলবে। অবরোধ বা হরতালে দেশের মানুষ কোন ধরনের সাড়া না দিলেও জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীদের ছোড়া পেট্রোলবোমার আঘাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করেন প্রায় দেড় শ’ নিরীহ মানুষ, যাদের অধিকাংশের সঙ্গেই রাজনীতির কোন সম্পর্ক ছিল না। দেশের বার্ন ইউনিটগুলোতে কাতরাচ্ছে আরও কয়েক শ’ মানুষ। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে আগামী ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় আট বছর আগে। সর্বশেষ মেয়র ছিলেন বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা। এক-এগারোর পর সব সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের গ্রেফতার করা হলেও এক অজ্ঞাত কারণে সাদেক হোসেন খোকাকে রেহাই দেয়া হয়। জানা যায়, তাঁর সঙ্গে এক-এগারো সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের যোগাযোগ ছিল। তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমান, প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার (অব.) জেড এ খান, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন প্রমুখকে নিয়ে বেগম জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, যা অন্যদের সমর্থন না পাওয়ায় ভেস্তে যায়। এবার ঘোষিত মেয়র নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কি-না তা নিয়ে দলে নানা ধরনের সমীকরণ চলছে। এক দলের মতে এই সময় নির্বাচন দেয়াটা সরকারের বিএনপি-জামায়াত জোটের চলমান আন্দোলন ভাঙ্গার একটি কৌশল। এই দল দুটি মনে করে তাদের নেত্রীর ডাকে দেশে এখন একটি দারুণ আন্দোলন চলছে এবং সেই আন্দোলনে সরকার এখন তার অন্তিম সময়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর একটু ধাক্কা দিলে সরকার পড়ে যাবে এবং তাদের নেত্রী ক্ষমতার মসনদে গিয়ে বসবেন। দলের ভেতরে আরও একটি রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব গোষ্ঠী আছে, যারা মনে করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে না যাওয়াটা ছিল তাদের একটি আত্মঘাতী ভুল, যার খেসারত দলকে এখন দিতে হচ্ছে। এর ফলে যেটি হয়েছেÑ দলের সিনিয়র নেতাদের বেগম জিয়ার পাশে আগের মতো তেমন একটা দেখা যায় না। দলের অনেক নেতাকর্মী জেলে আছেন তা ঠিক; আবার অনেকে দেশের বাইরেও নিরাপদে অবস্থান করছেন। অন্যরা নিজ নিজ পেশায় ফিরে গেছেন। দল হিসেবে বিএনপি এখন অনেকটা ছত্রভঙ্গ। একটি নির্বাচনে দল অংশগ্রহণ করলে দলের নেতাকর্মীরা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি না যাওয়ায় সেই সুযোগ থেকে তারা সম্পূর্ণরূপে শুধু বঞ্চিতই হয়নি, তাদের অনেক নেতাকর্মী এখন জামায়াত-শিবিরের মতো সন্ত্রাসের পথ ধরেছে। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে হয়ত বিএনপি নামক দলটির অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হবে। ইতোমধ্যে বিএনপি ঘরানার ছয়জন সুশীল বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং তাঁরা কয়েকটি দাবি উত্থাপন করেছেন। তাঁরা কী নিজের উদ্যোগে গিয়েছিলেন, নাকি বেগম জিয়া আর তারেক রহমানের নির্দেশে গিয়েছেন তা পরিষ্কার নয়। তাঁদের দলে বিএনপির কোন সদস্য ছিল না। তাঁদের দাবির মধ্যে ছিল মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কয়েকদিন বাড়ানো, কোন প্রার্থী কারাগারে থাকলে তাকে জামিনে মুক্ত করা, আর কোন নেতাকর্মী অথবা সমর্থককে গ্রেফতার না করা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচন করতে চাইলে যে সময় দেয়া হয়েছে তা যথেষ্ট। কোন প্রার্থী আদালত থেকে আইনের মাধ্যমে জামিন নিলে তাতে কারও কোন কিছু বলার থাকতে পারে না। তবে কারও বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকে তাকে গ্রেফতার করতে কোন বাধা থাকা যেমন উচিত নয়, ঠিক একইভাবে কারও বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যদি না থাকে তা হলে তাকে আটক রাখাটাও ঠিক নয়। প্রতিনিধি দল আরও ছোটখাটো কিছু দাবি-দাওয়া পেশ করে এসেছেন। সেগুলোর যৌক্তিকতা থাকলে নিশ্চয় নির্বাচন কমিশন তা বিবেচনা করবে। শুক্রবার অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের নেতৃত্বে আটজনের আরও একটি সুশীল প্রতিনিধি দল বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে বলেছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি ও তারেক রহমানের গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া গেছে। তবে তাঁদের কথায় পরিবেশ ভাল না থাকলে আর লেভেল প্লেইং ফিল্ড না থাকলে তাঁরা নির্বাচন বর্জনও করতে পারেন। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একটি ভাল সিদ্ধান্ত। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জিতলেও বিএনপির লাভ আর হারলেও লাভ। অংশগ্রহণ করলে প্রথম লাভটি হবে তাদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া নেতাকর্মীদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ। আর অংশগ্রহণে দ্বিতীয় লাভটি হচ্ছে বেগম জিয়ার অপরিণামদর্শী অবরোধ আর হরতাল ডাকার ফলে দলটি যে রকম গর্তের মধ্যে পড়েছে সেখান থেকে বের হয়ে আসারও একটি সুযোগ সৃষ্টি হবে। নির্বাচনে যদি বিজয় লাভ করে তা হলে এত পেট্রোলবোমা আর নরহত্যা সত্ত্বেও তাদের পেছনে এখনও যে জনসমর্থন আছে তা তারা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারবেন। আগামীতে তাঁরা পেট্রোলবোমা মার্কা নিয়ে নির্বাচনও করতে পারেন। যদি পরাজিত হয় এবং সেই পরাজয়ে সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের কোন হাত থাকে তা হলে বলতে পারবে এই সরকার বা নির্বাচন কমিশনের অধীনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও নিরাপদ নয়। স্বাভাবিক নিয়মে পরাজিত হলে তখন দলের দুর্বল দিকগুলো বিশ্লেষণ করে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে। তবে সমস্যা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বেগম জিয়া বা তারেক রহমান এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে তাঁদের অবস্থান কেমন রাখবেন তা নিয়ে। যেদিন সুশীল বুদ্ধিজীবীরা প্রথমবার বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন, ঠিক সেদিনই দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বরকতউল্লা বুলু গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, এই নির্বাচন একটি তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। এখনও বুঝার চেষ্টা করছি বিএনপি নামক দলটি কে চালায় এবং আগামীতে তাদের চিন্তা-চেতনা আর কর্ম কেমন হবে! ২৮ মার্চ, ২০১৫ লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
×