ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লতিফ সিদ্দিকীর এমপি পদ বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২৯ অক্টোবর ২০১৪

লতিফ সিদ্দিকীর এমপি পদ বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু

উত্তম চক্রবর্তী ॥ সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ থেকে অপসারিত এবং দল থেকে বহিষ্কৃত আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক রাখতে চায় না আওয়ামী লীগ। দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কারের পর এখন তাঁর দলীয় সংসদ সদস্যপদ বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে দলটি। দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কারের বিষয়টি স্পীকারকে লিখিতভাবে জানাতে একটি চিঠিও প্রস্তুত করছে তারা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার চিঠিটি দেয়ার কথা থাকলেও স্পীকার ভারত সফরে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা দেয়া হয়নি। স্পীকার ফিরলে দুই-একদিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিটি স্পীকারের কাছে পৌঁছে দেবেন বলে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানিয়েছেন। তবে দল থেকে বহিষ্কৃত আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ নিয়ে আইনী জটিলতা দেখা দিয়েছে। কেননা দলের সদস্যপদ হারানোর পর তাঁর সংসদ সদস্যপদ থাকছে কিনা, সে বিষয়ে সংবিধান এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। আওয়ামী লীগের প্রাথমিক পদ থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কার করা হলেও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাঁকে সংসদ সদস্যপদ শূন্য করার কোন সুযোগ নেই। তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২(১) এর (বি) ধারা অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ শূন্য করার ক্ষেত্রে সামান্য সুযোগ থাকলেও পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে গেলে সেই সিদ্ধান্ত ধোপে টিকবে না বলেই মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ শূন্য হওয়া বা না হওয়ার সবকিছুই নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর। তবে আওয়ামী লীগ আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ বাতিল চেয়ে আবেদন করলেও আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার থাকছে না। কমিশন বলছে, সংসদের অভিভাবক হচ্ছেন স্পীকার। সুতরাং কোন সংসদ সদস্যের বিষয়ে আওয়ামী লীগের পাঠানো চিঠি জাতীয় সংসদের মাধ্যমে এলেই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে কমিশন। ‘দি মেম্বারস অব পার্লামেন্ট ডিটারমিনেশন অব অসপিউট এ্যাক্ট’ অনুযায়ী, দল থেকে বহিষ্কারের চিঠি জাতীয় সংসদে পাঠানো হলে তা ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে পাঠাবে জাতীয় সংসদ। পরে ১৪ দিনের মধ্যে কমিশন অভিযুক্ত ব্যক্তি বরাবর চিঠি দেবেন। এরপর শুনানির দিন ধার্য করবে নির্বাচন কমিশন। শুনানির পরই লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে ইসি। তবে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনেরও লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের তেমন কোন সুযোগ নেই বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে অনেকটাই কলকাতায় নির্বাসনে থাকা দেশে এসে নির্বাচন কমিশনে শুনানিতে অংশগ্রহণ করা আপাতত সম্ভব নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। শুনানিতে অংশগ্রহণ না করার আইনী মারপ্যাঁচে ইসি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। অন্যভাবে তাঁর সংসদ সদস্যপদ শূন্য করা একটু জটিল বলেই মনে করছেন তাঁরা। এ বিষয়ে প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সম্প্রতি জানান, লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারও করা হলেও তিনি সংসদ সদস্য থাকবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আওয়ামী লীগের নয়, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য থাকবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে কিংবা দল থেকে নিজে পদত্যাগ করে অন্য দলে যোগ দিলেই কেবলমাত্র সংসদ সদস্যপদ চলে যাওয়ার বিধান রয়েছে। ওই সময় সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজও জানান, আইন অনুযায়ী ‘ফ্লোর ক্রসিং’ এ (দলের বিপক্ষে অবস্থান) না পড়ায় লতিফ সিদ্দিকী রাজনৈতিক দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও তিনি সংসদ সদস্য পদ হারাচ্ছেন না। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দল ও মন্ত্রিত্ব থেকে বহিষ্কৃত আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ওপর নীতিনির্ধারক নেতারা এতটাই ক্ষুব্ধ যে, তাঁর সঙ্গে দলের ন্যূনতম সম্পর্ক থাকুক তাও চান না তাঁরা। তাই আগামীতে লতিফ সিদ্দিকী যাতে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে পরিচিতি দিতে না পারেন, সেজন্য তাঁর এমপি পদও বিলুপ্তি চান দলের সিনিয়র নেতারা। নেতাদের মতে, লতিফ সিদ্দিকী এখন আওয়ামী লীগের কেউ নন। দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কারের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর এখন ন্যূনতম সম্পর্কও নেই। যতদিন তাঁর সংসদ সদস্যপদ নিয়ে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত না আসবে, ততদিন জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবেই থাকবেন লতিফ সিদ্দিকী, আওয়ামী লীগের নয়। আওয়ামী লীগের গত শুক্রবারের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক শেষে দলের মুখপাত্র ও এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্পষ্ট করেই সাংবাদিকদের জানান যে, লতিফ সিদ্দিকীর দলীয় প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে, এ সংক্রান্ত কাগজপত্র নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হবে। আমরা তাঁর এমপি পদ থেকেও বহিষ্কারের জন্যও নির্বাচন কমিশনে লিখিত আবেদন জানাব। আভাস পাওয়া গেছে, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবে সংসদের ট্রেজারি বেঞ্চে অর্থাৎ সামনের সারিতে থাকা লতিফ সিদ্দিকীর আসনটিও কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সামনের সারি থেকে তাঁকে সরিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের জন্য নির্ধারিত পেছনের সারিতে তাঁর জন্য আসন নির্ধারণ করা হতে পারে। আর এ ব্যবস্থা নেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে লতিফ সিদ্দিকীকে যে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে, তা লিখিতভাবে স্পীকারকে দলের পক্ষ থেকে জানানো হবে। চিঠি প্রাপ্তির পর স্পীকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে জানাবেন। সেই অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেবে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ জনকণ্ঠকে বলেন, দলের প্রাথমিক পদ থেকেও আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কারের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্তটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংসদের স্পীকারকে জানাতে দলীয় চিঠির খসড়া তৈরি হয়েছে। দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খসড়াটি দেখিয়ে চূড়ান্ত করেই যে কোন সময় তা স্পীকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন কমিশনের অভিজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংবিধান ও আইনে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলেও নির্বাচনী আইনের একটি ধারার আওতায় লতিফ সিদ্দিকী সংসদ সদস্যপদও হারাতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও নানা আইনী জটিলতার মুখোমুখি হতে পারে নির্বাচন কমিশন। আরপিও-এর ১২ (১) এর (বি) ধারায় বলা হয়েছে- ‘কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনীত অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী না হলে কেউ সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে পারবেন না।’ স্বতন্ত্র সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে আরপিওতে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। যার আওতায় পড়েন না লতিফ সিদ্দিকী। তবে বহিষ্কৃত সংসদ সদস্যের ব্যাপারে আরপিওতে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ভোটারদের ভোটেই তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। তাই তাঁর যদি দলের প্রাথমিক সদস্য পদই না থাকে, তাহলে তাঁর সংসদ সদস্যপদ থাকার প্রশ্নই উঠে না। ইসির কর্মকর্তারাও বলছেন, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরাসরি নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিলে ইসির কিছুই করার থাকবে না। তবে তারা যদি জাতীয় সংসদকে লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে চিঠি দেয় এবং সংসদ যদি নির্বাচন কমিশনে চিঠি পাঠায় তখন বিদ্যমান আইনগুলো পর্যালোচনা করে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়। তবে আগের দৃষ্টান্তের কথা উল্লেখ করে ইসির কর্মকর্তারা বলেন, আইনের অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। সর্বোপরি সরকার যা চাইবে তা-ই হবে। সরকার যদি লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ বাতিল করতে চায়, আইনে যা-ই থাকুক না কেন, সেটাই হবে। অতীতেও এমনটাই হয়েছে। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, এর আগে কয়েকজন সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তাঁদের সদস্যপদ বহাল থাকার নজির রয়েছে। অষ্টম সংসদে বিএনপির একজন এবং নবম সংসদে জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তাঁদের সদস্যপদ বহাল ছিল। এমনকি অষ্টম সংসদের স্পীকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও নবম সংসদের স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনেও পাঠাননি। এ ব্যাপারে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আগের দুই স্পীকার কেন বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে পাঠাননি, তা খতিয়ে দেখার বিষয় রয়েছে। আইনগত দিক পর্যালোচনার আগে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না। লতিফ সিদ্দিকী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংবিধানে উল্লিখিত যেসব কারণে সদস্যপদ শূন্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে তা সরাসরি প্রযোজ্য নয়। কারণ তিনি পদত্যাগ করেননি বা দলের বিপক্ষে ভোট দেননি। আর দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই। তবে লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে আরপিওর ১২ ধারা কার্যকর করা হতে পারে। উল্লেখ্য, গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের এক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে মাত্র ৫ মিনিটের বক্তব্যে দিয়ে নিজের ৬৬ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অর্জনকে ধ্বংস করে দেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। গত ১২ অক্টোবর মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে কেন চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হবে নাÑ জানতে চেয়ে ১৪ অক্টোবর কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়। চিঠির জবাব দিলেও তা সন্তোষজনক না হওয়ায় গত শুক্রবার দলের সর্বোচ্চ ফোরামের বৈঠকে লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়।
×