ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

অস্তিত্ব সংকটে হাওরের জেলে পেশা

আতাউল গণি, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার,অষ্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৬:৫১, ৩০ জুলাই ২০২৫

অস্তিত্ব সংকটে হাওরের জেলে পেশা

ছবি: জনকণ্ঠ

চারদিকে ভরাট নদী ধুধু বালুচর। ঘরের পর ঘর। ঘর নয় যেন ছোট ছোট খোপরি। জড়াজীর্ণ টিন-বাঁশের নড়বড়ে খোপরি ঘর, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। বাসিন্দাদের চোঁখে মুখে হতাশার ছাপ। নির্ঘুম চোখ, শরীরে ক্লান্তি ভাব। রোগা জীর্ণ শীর্ণ দেহ। সবকিছু যেন স্বাক্ষী দিচ্ছে নিদারুন দৈন্যতার। এরকম চরম দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে হাওরের নিভৃত ছোট ছোট পল্লীতে বাস করছে হিন্দু ধর্মবলম্বী এ জনগোষ্ঠী। আবহমান কাল ধরে বংশ পরম্পরায় তারা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

 

 
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টের কারণে তাদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। ওলট পালট হয়ে গেছে তাদের জীবন ধারা। স্বাভাবিক জীবিকা প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং তাদের অস্থিস্ত সংকট দেখা দিয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পলি, বালি জমে ভরাট হয়ে গেছে হাওরের নদী, নালা, খাল, বিল।

জলবায়ু পরিবর্তনের নানামুখী দুর্যোগের ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে নদীর তীরে গড়ে ওঠা নদী কেন্দ্রীক জীবিকা নির্ভর এ জনগোষ্ঠীর জীবিকার উপর। পর্যাপ্ত জলাধারের অভাব, নদীতে মাছের অপ্রতুলতার কারণে উপার্জন অক্ষম হয়ে পড়েছে তারা। মনে হচ্ছে প্রকৃতি তার নিজ হাতে কেড়ে নিয়েছে এ জেলে পল্লীর সুখ। এক সময় ঘাটে ঘাটে সারি সারি মাছ ধরার ডিঙ্গি বাঁধা থাকত। মাছ ধরার ক্ষেত্রও ছিল অবাধ। এখন আর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। শুকনো মৌসুমে ভরাটের কারণে নদী-নালা শুকিয়ে যায়। তখন সম্পুর্ণ কর্মহীন হয়ে পড়ে জেলেরা। জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায় -বর্ষাকালে মাছ ধরার সুযোগ থাকলেও জলমহালগুলো থাকে এক শ্রেণির প্রভাবশালী ইজারাদারদের দখলে। দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলেও বন্ধ হয়নি জলমহাল ইজারা প্রথা।

কেবল অসাধু দখলদারদের হাত বদল হয়েছে। নৌকা প্রতি  ২৫ হাজার টাকা শোসিত ইজারাদারদের দিয়ে জলমহালের আশে পাশে মাছ ধরার সুযোগ পেলেও পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় নিদারুন অভাব অনটনে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের। পক্ষান্তরে হাওরের অধিকাংশ কৃষক কৃষি কাজের পাশাপাশি মাছ ধরার সকল কৌশল রপ্ত করে নিয়েছে। বর্ষাকালে তারাও মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। এমনকি মাছ ধরার ক্ষেত্রে তাদের জালের ধারে জাল ফেললে দূর্বল প্রকৃতির জেলে সম্প্রদায়ের উপর জোর জবরদস্তিও করে । ফলে তাদের ভয়ে জেলেরা যত্রতত্র জাল ফেলতে ভীত সন্ত্রস্থ থাকে। নানা কারণে মাছ ধরা জেলে সম্প্রদায়ের কাছে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। ফলে তারা একমাত্র অবলম্বন মাছ ধরা পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। জীবিকার তাগিদে অন্য পেশার দিকে ছুটতে হচ্ছে। দৈনিক কৃষি মজুরী করতে দেখা যায় জেলে নারী-পুরুষদের। অভ্যস্থ না থাকায় অন্য পেশার কাজও তারা সঠিকভাবে করতে পারছে না। তবুও সকাল-সন্ধা কৃষি শ্রমে নিয়োজিত থেকে কোন রকমে অনাহারে অর্ধাহারে কাটছে তাদের জীবন।
 হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে প্রায় 9 হাজার জেলে পরিবারের বাস। তাদের বেশির ভাগই দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। আর্থিক অনটনের কারণে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে গভীর উৎকণ্ঠায় কাটছে অনেক বাবা-মার।মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে মেয়ের বিয়ে, সংসারের ভরণ পোষণ, নৌকা-জাল কিনতে ঋণের বোঝা বাড়ছে এবং ঋণ পরিশোধের টেনশন আরও কষ্টের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে তাদের।

 


গভীর রাত থেকে এমনকি সারা রাত অনেক সময় ঝড়, বৃষ্টি, কনকনে শীত উপেক্ষা করে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে হয় তাদের । ফলে তারা শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন এ অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অনেকেই পক্ষাগাত গ্রস্থ হয়ে পড়ে। অর্থের অভাবে সঠিক চিকিৎসা করতে না পেরে নিদারুন দুঃখ কষ্টে ভোগতে হয় এবং পরিবারের উপর নেমে আসে চরম দুর্ভোগ।পরিবার পরিজন নিয়ে এভাবেই তারা বছরের পর বছর মানবেতর জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
তাছাড়া জাতিভেদ বর্ণ প্রথার ধর্ম ভিত্তিক বিভাজনের কারণে অন্যান্য পেশাজীবিদের তুলনায় জেলে সম্প্রদায় নীচু অবস্থানের হওয়ায় সামাজিকভাবেও তারা হয় অবহেলিত।
সর্বোপরি সরকারি উদ্যোগে নদী খনন, হাওরের জলমহালগুলো অবমুক্ত করে উন্মুক্ত করে দিলে জেলেরা অবাধে মাছ ধরার সুযোগ পাবে। মাছ ধরা ছাড়াও তাদের প্রশিক্ষিত করে টেকসই ও বিকল্প জীবিকার উৎস বের করা এখন সময়ের দাবী। সরকারি নানামুখী সুবিধা নিশ্চিত, সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করণের মাধ্যমে হাওরের জেলে সম্প্রদায়কে দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে তাদের জীবনমানে গতি সঞ্চালিত করা সকলের প্রাণের দাবী।

ছামিয়া

×