
ঢাকার উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় জীবন দিয়ে অন্তত ২০ শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষা করেছেন শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্ব থেকে একচুল না সরে যাওয়া এই শিক্ষিকা এখন দেশের মানুষের চোখে সাহসিকতার প্রতীক। তাঁর আত্মত্যাগে গর্বিত এলাকাবাসী।
নিজ গ্রামে শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী। নিজ এলাকায় শুধু শিক্ষা নয়, সাধারণ মানুষের সুখে-দুঃখেও পাশে ছিলেন তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষদের স্থাপিত নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজটিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের স্বপ্ন নিয়ে দুই মাস আগে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হন তিনি। কিন্তু কে জানতো, তাঁর সেই স্বপ্ন- স্বপ্নই থেকে যাবে।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকেল ৪টায় নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়াস্থ বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। জানাজায় অংশ নেন হাজারো মানুষ।
মাহরীনের চাচা রিকো চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, দুই বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিল মাহরীন। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন। তখন থেকেই এলাকার প্রত্যেক মানুষের পাশে থাকতেন। ঢাকায় থেকেও এলাকার মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং সহযোগিতা করতেন। তিনি জানান, সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের মা মরহুমা জাহানারা খাতুন ও মাহরীনের দাদি মরহুমা রওশনারা বেগম ছিলেন আপন দুই বোন।
তিনি আরও জানান, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের স্বপ্ন নিয়ে দুই মাস আগে জলঢাকার বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে ওই প্রতিষ্ঠানে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শোকবার্তা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ফটকে ব্যানার টাঙানো হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন মাহরীনের দাদা মরহুম মজিবর রহমান চৌধুরী এবং পিতা মরহুম মাহফুজার রহমান চৌধুরী।
মাহরীনের ছোট ভাই মুনাফ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, ছোটবেলা থেকে বড় আপুকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি। বাবা-দাদারা যেভাবে এলাকার মানুষের পাশে থেকে সাহায্য করতেন, বড় আপুও তেমনি ছিলেন। তিনি এলাকার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখতেন। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর আমাদের সন্তানদের মধ্যে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মতো। আজ আমাদের মাথা থেকে অভিভাবকের হাত সরে গেল। আমরা আবারও এতিম হয়ে গেলাম।
মাহরীন চৌধুরীর প্রতিবেশী আব্দুল জব্বার জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি সুযোগ পেলেই গ্রামের বাড়িতে ছুটে আসতেন। এলাকার গরিব মানুষকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কালভার্ট নির্মাণেও সহযোগিতা করেছেন। তিনি শিক্ষানুরাগী হিসেবে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে মনোনীত হন এলাকাবাসীর সিদ্ধান্তে।
অপর প্রতিবেশী মোস্তফা আজাদ বলেন, তিনি একজন সৎ, ভালো মানুষ ছিলেন। বই-খাতা কিনে দিতেন এলাকার শিশুদের। আমরা একজন আদর্শ মানুষকে হারালাম।
বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মহুবার রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দুই মাস আগে প্রতিষ্ঠানের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি করা হয় মাহরীন চৌধুরীকে। সেসময় তিনি বলেছিলেন, বর্তমানে আমি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেই প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে চাই আমার পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া এই প্রতিষ্ঠানটিতে।
তিনি বলেন, আমরা কল্পনা করতে পারছি না যে তিনি আমাদের এভাবে ছেড়ে চলে যাবেন। তিনি শুধু একজন শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন মানবিক বীর। আমরা শিক্ষক সমাজ তাঁর আত্মত্যাগে গর্বিত ও শোকাহত।
উল্লেখ্য, মাহরীন চৌধুরী শিক্ষকতা জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন নীলফামারীর জলঢাকায়। এরপর তিনি চলে যান ঢাকায় এবং যোগদান করেন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে তিনি স্কুলের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর (৩য় থেকে ৫ম শ্রেণি) শিক্ষক ছিলেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বসবাস করতেন। মাহরীন চৌধুরীর দুই ছেলে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা করছে। বড় ছেলে আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী সদ্য এসএসসি পাস করেছে এবং ছোট ছেলে আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী নবম শ্রেণিতে পড়ে। স্বামী মনসুর আলী হেলাল একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী। দুই বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে মাহরীন ছিলেন বড়।
প্রসঙ্গত, সোমবার (২১ জুলাই) রাজধানীর উত্তরায় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এতে ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। কিন্তু তার আগেই ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন মাহরীন। সামান্য আঘাতও পান। কিন্তু ভিতরে আটকে পড়া অন্য শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে তিনি আবারও ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন। অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে আগুন থেকে উদ্ধার করেন মাহরীন চৌধুরী। উদ্ধার অভিযানের সময় তিনি দগ্ধ হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গজল আজম জামে মসজিদে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
আফরোজা