ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ জুলাই ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২

ফটিকছড়িতে পুকুর থেকে বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার; হত্যা নাকি অপমৃত্যু নিয়ে রহস্যের ধূম্রজাল

ওবাইদুল আকবর রুবেল, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ২২:৫১, ২১ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২২:৫২, ২১ জুলাই ২০২৫

ফটিকছড়িতে পুকুর থেকে বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার; হত্যা নাকি অপমৃত্যু নিয়ে রহস্যের ধূম্রজাল

ছবিঃ সংগৃহীত

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভায় পুকুর থেকে বৃদ্ধের লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি নতুন মোড় নিচ্ছে। সেদিন বাবাকে হত্যার অভিযোগ এনে ছেলেকে মারধর করে প্রতিবেশীরা পুলিশে দেওয়ার ঘটনাটিকে ঘিরে রহস্যের দানা বাঁধলেও এবার অভিযোগের সে তীর প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে। পুকুরে পড়ে ওই বৃদ্ধের ‘অপমৃত্যু’ হয়েছে, নাকি তাকে ‘হত্যা’ করে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সে রহস্য নতুন করে দানা বেঁধেছে। প্রশ্ন উঠেছে—এটি অপমৃত্যু নাকি পরিকল্পিত হত্যা? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে অপেক্ষা করতে হবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি নিয়ে রহস্য কাটছেই না পুরো উপজেলাজুড়ে।

এর আগে, ১৮ জুলাই নাজিরহাট পৌরসভার পূর্ব-ফরহাদাবাদ গ্রামে বাড়ির পাশে পুকুর থেকে মো. এনামের (৬২) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিজ পিতাকে হত্যার অভিযোগ এনে ছেলে মো. মোবারক হোসেনকে আটক করে মারধর করে পুলিশে দেয় প্রতিবেশীরা। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিহতের স্ত্রী, কন্যা ও শ্যালককেও থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের ছেড়ে দিলেও মোবারককে আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠায়। বর্তমানে তিনি জেলহাজতে আছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘটনার আগের দিন রাতে বৃদ্ধ এনামকে বাড়িতে নিয়ে আসেন ছেলে মোবারক। সেই রাতে বাবাকে তালাবদ্ধ করে ভাড়াবাসায় চলে যান তিনি। পরদিন সকালে এসে দরজায় বাইরে তালাবদ্ধ থাকলেও ঘরে ছিলেন না বৃদ্ধ এনাম। কিন্তু সংক্ষুব্ধ প্রতিবেশীরা মোবারকের কাছে জানতে চান, তার বাবাকে মেরে কোথায় রেখেছে? এতে হতবম্ভ হয়ে যান পুত্র মোবারক। পরে কয়েক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর পুকুরে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায় বাবা এনামকে। তখনই ছেলের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে মারধর করে পুলিশে দেয় ক্ষুব্ধ প্রতিবেশীরা। ফলে রহস্যের দানা বাঁধে—এটি হত্যা নাকি অপমৃত্যু?

নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, নিহত এনামের প্রতিবেশী মো. শাহজাহানসহ কয়েকজনের সঙ্গে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বাড়ির সীমানা নিয়ে বিরোধ ছিল। সে বিরোধের জেরে বৃদ্ধ এনাম স্বপরিবারে কয়েক বছর আগে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নাজিরহাটে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। বছর খানেক আগে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন এনাম। তাকে সুস্থ করে তুলতে গিয়ে সন্তানদের খরচ হয় প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ না হয়ে চিরতরে অন্ধ হয়ে যান তিনি। এতে এনাম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং মনকে সান্ত্বনা দিতে স্বজনদের বাড়িতে চলে যেতেন। নিজে পৈতৃক বাড়িতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন এনাম। ফলে সন্তানেরা তাকে রাতে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দিয়ে ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতেন। আবার সকালে এসে খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু এসব পছন্দ করতেন না প্রতিবেশীরা। এ নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বাগ্‌বিতণ্ডা লেগেই থাকত তাদের।

নিহত এনামের একমাত্র কন্যা সানজিদা শারমিন রিপা বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী শাহজাহান, মাস্টার রুমান, জসিমসহ অন্যরা আমার বাবাকে রাতের আঁধারে পুকুরে ফেলে হত্যা করেছে বলে আমার মনে হচ্ছে। কারণ তারা বাবার লাশ পাওয়ার আগেই কী করে বললেন যে আমার ভাই মোবারক বাবাকে হত্যা করেছেন? মোবারক তো সেদিন রাতে নাজিরহাটের বাসায় ছিলেন। প্রতিবেশীরা আমাদের পরিবারের উত্থান সহ্য করতেন না। এর আগে তারা আমাদের বাড়িছাড়া করেছেন। এখন আমার বাবাকে হত্যা করে আমার ভাইকে অপরাধী বানিয়ে আমার পরিবারকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। আমি প্রশাসনের কাছে এটির সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক বিচার চাই।’

এদিকে, ঘটনার দিন প্রতিবেশী শাহজাহান ও জসিম বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, ‘এনামের পুত্র মোবারকই তার বাবাকে হত্যা করেছেন।’ তারাই মোবারককে ঘরে আটকে রেখে মারধর করেন। ফলে পুলিশ লাশ উদ্ধার এবং পরবর্তী সময়ে স্বজনদের থানায় ডেকে নেয়। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে যাবার সময় আটক মোবারক কান্নায় আর্তচিৎকার করতে থাকেন। তিনি বলতে শোনা যায়, ‘প্রতিবেশীরা আমার বাবাকে মেরে আমাকে ফাঁসিয়ে এ ঘটনায় জড়াচ্ছেন। আমি আমার বাবাকে হত্যা করতে পারি না। আমি এর বিচার চাই।’

অন্যদিকে, ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দাফনের পর থেকে আত্মগোপনে যান বিভিন্ন ফেসবুক পেজে জোরালো বক্তব্য দেওয়া প্রতিবেশী সেই শাহজাহান, জসিমসহ অন্যরা। যাদের সঙ্গে তাদের পারিবারিক বিরোধ ছিল দীর্ঘদিন ধরে। আবার যেসব ফেসবুক পেজে জোরালো বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল, সরিয়ে ফেলা হয়েছে সেই সব ভিডিও সংবাদগুলোও। ফলে নানা বিষয় সামনে আসায় এনামের এই মৃত্যু নিয়ে নতুন করে প্রশ্নের দানা বেঁধেছে এলাকাবাসীর মনে। লোকজনের ধারণা—এটি আসলেই হত্যা? না অপমৃত্যু? আবার হত্যাকাণ্ড হলে এতে জড়িত প্রতিবেশী? নাকি নিজের ছেলে?

ঘটনার পর হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে প্রতিবেশী শাহজাহান ও জসিমের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তারা কোথায় আছেন সে ব্যাপারেও পরিবার মুখ খোলেনি। তবে অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, তারা ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। নিজেদের বাঁচাতে বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ করছেন।

যদিও এ ঘটনার পর থেকে সরেজমিনে অধিকতর তদন্ত করছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ফটিকছড়ি থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) শেখ মো. ইয়াছিন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমরা এ ঘটনায় এলাকাবাসীর দাবির মুখে ছেলেকে আটক করে আদালতে পাঠিয়েছি। ঘটনার রহস্য উন্মোচনে কাজ করছি। আশা করছি, দ্রতই আসল রহস্য উদ্ঘাটন হবে।’

ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর আহমেদ বলেন, ‘ঘটনার গতি-প্রকৃতি রহস্যাবৃত। এলাকার লোকজনের দাবির মুখে আমরা ছেলেকে আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছি। আপাতত অপমৃত্যু মামলা নিয়েছি। ছেলের অপরাধের বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে। প্রতিবেদন পেলে পরিষ্কার হবো এটি আসলেই কী?’

ইমরান

×