ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

স্মৃতিতে শহীদ শাকিল পারভেজ 

ড. এ. কে. আজাদ

প্রকাশিত: ১৬:১৫, ১৮ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৬:২২, ১৮ জুলাই ২০২৫

স্মৃতিতে শহীদ শাকিল পারভেজ 

ছবি: সংগৃহীত

মোঃ শাকিল হোসেন, ডাক নাম পারভেজ, যিনি শাকীল পারভেজ নামেই পরিচিত, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রোগ্রামের আশুলিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র। আমার সাথে তার দু’টি কোর্স ছিল, একটি ছিল ‘বেসিক কনসেপ্ট অব ইসলাম’ এবং আর কোর্সটি ছিল ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’। ছাত্র হিসেবে শাকিল খুব মেধাবী ছিল ও শাকিলের ক্লাস পারফর্মেন্স ছিল খুবই ভালো। শুধু ভাল ছাত্রই নয় বরং তার মধ্যে ছিল অনেকগুলো নেতৃত্বের গুণাবলি। বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্সে আমরা ঢাকার মধ্যে একটি স্টাডিটুর করেছিলাম, যার প্রধান দায়িত্ব ছিল শাকিলের। সে টুরের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দায়িত্ব সে এত সুন্দরভাবে পালন করেছিল যা আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছিল।  শাকিল, তুমিতো আর আসবেনা আমার আশুলিয়া অফিসে! বলবে না স্যার, আবার আপনার সাথে ঘুরতে যাবো। আপনার ক্লাসগুলো খুব মিস করি। স্যার আমাকে বিভিন্ন সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েন। স্যার, কিভাবে বিদেশে স্কলারশিপ পাওয়া যায়? আসবে না বিভিন্ন সমস্যার কথা জানাতে কিংবা কোন ভাল খরব নিয়ে।    

শাকিলের শাহাদাতের দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, জুলাই ১৮, ২০২৪, শ্রাবণ ০২, ১৪৩১, মুহাররম  ১১, ১৪৪৬। মুহররমের শেষ রোজা রেখেছিলাম। আসরের নামাজের পরে ফেসবুক খুলতে শাকিলের মৃত্যু সংবাদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনরত অবস্থায় উত্তারায় পুলিশের গুলিতে শাহাদত বরণ করেন।  কোন মতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সাথে সাথে শাকিলকে ফোন দিলাম, কিন্তু ফোনে  না পেয়ে আর একজন ছাত্রকে  ফোন দিলাম এবং জানতে পারলাম ঘটনার সত্যতা। এর পর ভিসি স্যার, প্রক্টর, সহকারি প্রক্টর, ডীন, রেজিস্ট্রার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, কোর্ডিনেটরসহ আরও বেশ ক’জন সহকর্মীর সাথে আলাপ করলাম। এর মধ্যে মাগরীবের আজান দিল। মাইকের আজানের সাথে সাথে শিয়া মসজিদ, মোহাম্মাদপুরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, সাথে মিছিলের শব্দ, মানুষের ছোটাছুটি। কোন মতে ইফতার ও নামায পরে সহধর্মিনী ও ছোট দু’টি সন্তানকে বললাম যে আমি যাই। তোমরা আমার  জন্য দোয়া করো। মহান আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে বেরহয়ে পরলাম। কিছুদূর হাটার পর একটা  রিক্সাপেলাম, বললাম, ভাই ! শ্যামলী যাবেন? সে বললো, ভাই, ওদিকে মারামারি হচ্ছে, “আমি যাইয়াম না”। এরপর আরো কিছুদূর হাঁটার পরে, আর একটা রিক্সা পেলাম, খুব অনুরোধ ও তিনগুণ ভাড়া বেশি দেয়ার শর্তে রাজি হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে শ্যামলীতে পৌঁছলাম। রাস্তায় পুলিশ,  বিজিবির গাড়ি ও দু’ একটি রিক্সা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। শ্যামলীতে গিয়ে একটা সি  এন জি পেলাম, সেটায় করে মাজার রোড পর্যন্ত গেলাম, কারণ এর চেয়ে বেশি আর সে যাবে না। সেখান থেকে আর একটা সিএনজি নিয়ে বিরুলীয়া ব্রিজ পর্যন্ত গেলাম। রাস্তায় কোন যানবাহন নেই বললেই চলে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি  লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিরুলীয়া ব্রিজ থেকে অটোরিক্সা নিয়ে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুলিয়া ক্যাম্পাসে পৌছালাম ছালাম। ফ্রিজ  এ্যাম্বুলেন্সে আমার সদা হাস্যোজ্জ্বল শাকিলকে নীরবে ঘুমাতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আবার শক্ত হওয়ার  চেষ্টা করলাম এই ভেবে যে, আমি যদি এভাবে ভেঙে পড়লাম তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা কি হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানাযা নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষে শাকিলের লাশ নিয়ে যাওয়া হলো তামীরুল মিল্লাতের গাজীপুর ক্যাম্পাসে এবং সেখান থেকে ওর গাজীপুরের  বাসায়।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের  ডীন, রেজিস্ট্রার,  প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা, সহকারি প্রক্টর, শিক্ষক ও কর্মকর্তারা সবাই মিলে ছাত্র-ছা্ত্রীদের সাথে মিটিঙে বসে তাদের কথা শুনলাম। শিক্ষার্থীরা প্রক্টর বরাবর তাদের  দাবীগুলো লিখিত আকারে জমা দিল। লাশের সাথে কে যাবে এই ভয়াল রাতে, এই নিয়ে চলছিল বেশ আলোচনা। অনেকেই সেদিন রাতে যাওয়ার ব্যাপারে পিছ পা হলেন। দায়িত্ব থাকা ব্যক্তিবর্গের অনেকে পরের দিন যাওয়ার কথা বললেও বাস্তবে আর যাওয়া হয়নি। অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি সেরাতে ভয়াবহতার কারণে জানাজা নামাযেও আসতে পারেনি।            

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনায় রাত দশটার দিকে আশুলিয়া ক্যাম্পাস থেকে আমার নেতৃত্বে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্রসহ দশ সদস্যের একটি টিম নিয়ে আমরা রওনা হলাম গাজীপুরের দিকে, কারণ গাজীপুরে শাকিলের বাসায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আবদুল্লাহপুর যাওয়ার সাথে সাথেই একদল লোক লাঠি দেখিয়ে আমাদের গাড়ি উল্টো ঘুরাতে বললো। গাড়ির চালক বাবুল ভাই বললো, কী করবো স্যার? ওরাতো গাড়ি ভেঙ্গে ফেলতে পারে, গাড়ি জ্বালিয়েও দিতে পারে। আমি বললাম, বাবুল ভাই পিছনে ফেরার কোন উপায় নাই। এখন do or die! সামনে এগিয়ে যেতে হবে। গাড়ি এগিয়ে গেল, আমরা পরিচয় দিলাম, কথা বললাম, ওরা আমাদের গাড়ির দরজা খুলে চেক করলো, লাইট  মেড়ে আমাদের চেহারা দেখলো। তারপর যেতে দিল। এভাবে বেশ কয়েকবার আমাদের গাড়ি চেকের  সম্মুখীন  হলাম। প্রতিবারই যখন হাতে লাঠি নিয়ে কিংবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আমাদের গাড়ি থামিয়ে চেক করছিল তখন আমরা কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিলাম। কারণ অনেক  গাড়ি জ্বালিয়ে দিতে দেখেছি, অনেক মানুষকে হতাহত হতে দেখেছি, অনেক মানুষকে বন্দী করে  নিয়ে যেতে দেখেছি, নির্মম অত্যাচারের দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু যতবারই আমরা ভয় পেয়েছি আমার মনে হয়েছে শাকিল আমাকে বলছে স্যার ভয় পাবে না আমি আপনাদের সাথে আছি। মহান আল্লাহ্‌র অসীম কৃপায় আমার বারবার একথাই  মনে হয়েছে। শাকিলের গাড়ি যখনই একটু পিছনে  পড়েযাচ্ছিল তখনই আমার ভয়, চিন্তা ও উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছিল, যে আমরা তো ঠিকঠাক মত পৌঁছাতে পারবোতো? মনে হচ্ছিল শাকিল বারবার বলছে স্যার চিন্তিত হবেন না। আমি তো আছি! ফজরের আজানের শব্দ শুনলাম, মনে হলো শাকিল বলছে স্যার নামাজ পড়েনিন। রাস্তার পাশে মসজিদ  দেখে গাড়ি থামিয়ে  আমরা ফজরের  নামাজ পড়তে দাড়ালে  আমার মনে হলো শাকিল কোথায়, শাকিল বললো আমার জন্য চিন্তা করবেন না আমিতো আপনাদের পিছনেই আছি। নামায শেষে আবার আমাদের যাত্রা  শুরু। এরই মধ্যে শাকিলকে বহনকারী গাড়ির পিছনের বামপাশের দু’টি চাকাই নষ্ট গেল। 

আমি ভীষণ চিন্তায় পড়লাম। মহান রব্বুল আলামীনের  সাহায্য চাইলাম, মনে হলো শাকিল আমাকে বলছে, স্যার এত চিন্তা করবেন না, আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় যথা সময় আমরা বাড়িতে পৌঁছতে পারবো। পথিমধ্যে এক বাজারে গাড়ি সারানো দোকানের কাছে থামিয়ে চাকা পরিবর্তন  করার চেষ্টা করলো কিন্তু এই বৈরী পরিবেশে ব্যবসায়ী তার দোকান খুলতে  চাইলো না।  উল্লেখ্য যে, গাড়ির অতিরিক্ত চাকাটিও ভালো ছিল না। অনেক কষ্ট করে পুরানো চাকাটি লাগিয়ে কোনো মতে আমরা সকাল নয়টার দিকে শাকিল হোসেনের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর থানার ১ নং উত্তর হামসাদী ইউনিয়নের, কাফিলাতলি, ১ নং ওয়ার্ডের আমানুল্লাহ মিয়াজি বাড়ি পৌঁছালাম। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই শত শত মানুষের প্রতিবাদী মিছিলে গ্রামের বন-বনানী কেঁপে  উঠছিল। শাকিলকে একনজর দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিল। সকাল দশটায় স্থানীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে  তার নামাজে জানাজার ব্যবস্থা করা হলো।  অত্র এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বর্গ আলোচনা করলেন, শাকিলের শিক্ষক হিসাবে আমাকেও কিছু বলার সুযোগ দিল।

আমার আলোচনায় বলেছিলাম শাকিলের মতো আদর্শবান তরুণের অত্মত্যাগ কখনই বৃথা যাবে না।   জানাজা শেষে শাকিলের লাশ কাঁধে করে কবরস্থানের দিকে যাচ্ছিলাম, আর মনে হচ্ছিল শাকিল বলছে, স্যার! আপনারা আমার জন্য এত কষ্ট করছেন। শাকিলকে কবরে নামানোর দৃশ্য দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। দু’চোখদিয়ে অঝোরে বৃষ্টিরমতো পানি ঝরছিল। মনে  হচ্ছিল ঐ মায়াবি হাসি দিয়ে শাকিল কি আমার সাথে   এসে আর কথা বলবে না? শাকিলকে মাটি দিয়ে যখন ঢেকে দেয়া হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল, শাকিল বলছে, স্যার, চিন্তা করবেন না একদিন দেখা হবে সবার সাথে জান্নাতে। শাকিলকে দাফন করার পর দোয়া করার দায়িত্ব আসে আমার উপর। শাকিলের জন্য ও শাকিলের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রাণভরে  মহান আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করলাম। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সকলের জন্য, বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য, সর্বোপরি বাংলাদেশের শান্তি আর সমৃদ্ধির জন্য দোয়া করলাম। শাকিল তুমি মানুষের হৃদয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকবে। তুমি শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্ববাসীর জন্য এক ত্যাগের মহিমা স্থাপন করলে। উল্লেখ্য  যে শাকিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়লেও তার পরিবার অনেকটাই অসচ্ছল। তাদের গ্রামে কোন ঘর নেই, ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকে।

শাকিল টিউশন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ চালাতো, সাথে পরিবারকেও সাহায্য করতো। মা’ শারবিন আক্তার দীর্ঘ্যদিন ধরে প্যারালাইজড, শাকিল মা’কে রান্না করে নিজ হাতে খাওয়ায়ে দিতো। তিন বোনের একমাত্র ভাই শাকিল হোসেন।  বড় বোন-বিউটি আক্তার, মেজো বোন- সুইটি আক্তার আর ছোটবোন-নাদিয়া আক্তার। বোনরা সবাই  বিবাহিত ও বোনদের জামাইরা ছোট-খাটো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বাবা মোঃ বেলায়েত হোসেন খুদে ব্যবসায়ী। জানাযা নামাজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সাময়িকভাবে দেয়া আর্থিক অনুদান শাকিলের বাবার হাতে তুলে দিয়েছি আর জড়িয়ে ধরে বলেছি শাকিলের মত সন্তানের বাবা হয়ে আপনি ধন্য। শাকিল আপনাদের জান্নাতের পথ সুগম করে দিয়েছে। শাকিলের মত ছাত্র আমাদের জন্য গর্ব, দেশ ও জাতীর অহংকার। শাকীলের রক্তেভেজা এই স্বপ্নের বাংলাদেশে সকল প্রকার মারামারি, হানাহানি ও বৈষম্য দূরহোক, আর ফিরে আসুক আবারিত শান্তি।  বাংলাদেশ একটি উন্নত, সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে উঠুক এটিইহোক শাকিলের শাহাদাত বার্ষিকীতে আমাদের সকলের প্রত্যাশা।

ফারুক

×