ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

আশ্রয়নের অধিকাংশ ঘরে তালা, থাকেন না বরাদ্দপ্রাপ্তরা পানির দরে বিক্রি হচ্ছে প্রকল্পের ঘর

শহিদুল ইসলাম রিপন, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৭:৫২, ১৩ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৭:৫৫, ১৩ জুলাই ২০২৫

আশ্রয়নের অধিকাংশ ঘরে তালা, থাকেন না বরাদ্দপ্রাপ্তরা পানির দরে বিক্রি হচ্ছে প্রকল্পের ঘর

ছবিঃ সংগৃহীত

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় বিগত সরকারের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের দেওয়া উপহারের বেশির ভাগ ঘরেই ঝুলছে তালা। কেউ কেউ আবার বিক্রিও করে দিচ্ছেন বরাদ্দপ্রাপ্ত সেই ঘর।

উপজেলার দেশিগ্রাম ইউনিয়নের বলদীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নাজমা খাতুন একটি ঘর পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর নামের বরাদ্দের ঘর উত্তরশ্যামপুর গ্রামের সাগর হোসেন নামের এক ব্যক্তির কাছে মাত্র ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন।

শ্যামপুর আশ্রায়ণ প্রকল্পে আরও সরকারি বরাদ্দের ঘর বিক্রি করেছেন দেওঘর গ্রামের জবেদা খাতুন। তিনি টাগড়া গ্রামের মো. হাবু নামের এক ব্যক্তির কাছে ৫০ হাজার টাকায় ঘরটি বিক্রি করেন। জবেদা খাতুনের প্রতিবেশি রেজিয়া খাতুনও উত্তরশ্যামপুর গ্রামের সাইদুর রহমানের কাছে ৩০ হাজার টাকায় তাঁর ঘর বিক্রি করেছেন।

যদিও আশ্রায়ণ প্রকল্পের সরকারি বরাদ্দের ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাঁর সন্তান ছাড়া অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করতে পারেন না বলে জানান তাড়াশ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের সার্ভেয়ার আব্দুল মমিন মণ্ডল। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিক্রেতারা গোপনে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তিতে বিক্রেতার স্বাক্ষর বা টিপসই নিয়েই বিক্রির কাজ শেষ করছেন বলে জানিয়েছেন আশ্রয়ণে বসবাসরত কয়েকজন বাসিন্দা।

শনিবার সরেজমিনে শ্যামপুর আশ্রায়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা গেছে, রেজিয়া খাতুনের বিক্রি করা ঘরে ক্রেতা সাইদুর রহমানের ভাই সাইফুল ইসলাম ব্রয়লার মুরগির খামার গড়ে তুলেছেন। অন্য দুটি বিক্রি হওয়া ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।

শ্যামপুর আশ্রায়ণ প্রকল্পের একাধিক বাসিন্দা জানান, প্রকল্পে মোট ৩৫টি ঘর রয়েছে, যার মধ্যে ৩টি ইতোমধ্যে বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি ঘর পাওয়া হাড়িসোনা গ্রামের জহুরুল ইসলাম, দেশিগ্রামের শারমীন খাতুন, তাড়াশের ছানা, বুলবুলি খাতুনসহ অন্তত ১০-১২ জন তাঁদের বরাদ্দ পাওয়া ঘরে থাকেন না। তাঁদের মধ্যে দু-একজন কাজের জন্য ঢাকায় বা অন্যত্র থাকলেও অধিকাংশের আগে থেকেই নিজস্ব ঘর-বাড়ি থাকায় তাঁরা সেখানে বসবাস করছেন। ফলে আশ্রায়ণের সরকারি ঘর তালাবদ্ধ রেখে মালিকানা ধরে রাখছেন অথবা বিক্রির চেষ্টা করছেন।

শ্যামপুর আশ্রায়ণ প্রকল্পের সভাপতি হেলাল উদ্দিন সরকার বলেন, যারা সরকারি ঘর বিক্রি করেন, তাঁরা গোপনে এসব কাজ করেন। পরে যখন ক্রেতারা বসবাস শুরু করেন, তখন বিষয়টি জানা যায়। তিনি আরও জানান, আমার জানা মতে গত তিন-চার মাসে আশ্রায়ণের তিনটি ঘর বিক্রির ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। মূলত তদবির, জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের লোকজন বা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সামর্থ্যবানরা ঘর পেলেও তাঁরা ঘরে থাকেন না অথবা বিক্রি করে দেন—এটাই বাস্তবতা।

উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রায়ণ প্রকল্পের আওতায় বিগত সরকারের সময়ে উপজেলার আটটি ইউনিয়নে মোট ৩৫৬টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে দেশিগ্রাম ইউনিয়নের বড়মাঝদক্ষিণা আশ্রায়ণ প্রকল্পে ৪৮টি, শ্যামপুরে ৩৫টি, তালম ইউনিয়নের গুল্টা মৌজার খ্রিস্টান মিশনারীপাড়ায় ১৩টি, গুল্টা কলেজ পাড়ায় ৬টি ঘর রয়েছে। বাকিগুলো বিভিন্ন ইউনিয়নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্যামপুর আশ্রায়ণ প্রকল্পে ৩ জন ও বড়মাঝদক্ষিণা আশ্রায়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া তেঘরী গ্রামের ফয়েজ আলী এবং কর্ণঘোষ গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ১ লাখ টাকা করে মোট ৫ জন তাঁদের বরাদ্দ পাওয়া ঘর বিক্রি করেছেন। তবে ঘর বিক্রি প্রসঙ্গে ফয়েজ আলী ও আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কথা বলতে রাজি হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড়মাঝদক্ষিণা আশ্রায়ণের এক নারী সদস্য জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ কয়েকটি আশ্রায়ণের ঘর বিক্রি হয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি মিথ্যে নয়—আপনারা (সাংবাদিক) খোঁজ নিতে পারেন।

এছাড়া শ্যামপুরে ৮-১০ জন, বড়মাঝদক্ষিণায় ৭-৮ জন, গুল্টা কলেজ পাড়ায় বরাদ্দ পাওয়া ১৮-২০টি পরিবারের কেউই গত দেড় বছরে ঘরে বসবাস করেননি। বর্তমানে এসব ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। তবে গুল্টা খ্রিস্টান মিশনারীপাড়ার আশ্রায়ণ প্রকল্পের ১৩টি ঘরের সবকটিতেই পরিবারসহ বসবাস করছেন বরাদ্দপ্রাপ্তরা। এখানে কেউ ঘর বিক্রি বা তালাবদ্ধ রাখেননি।

শ্যামপুর আশ্রায়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মকবুল হোসেন (৭৫) বলেন, আমাদের আশ্রয়ণের সাতটি টিউবওয়েলের মধ্যে ৩টি নষ্ট, ড্রেনগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো, আর আশ্রয়ণের ভেতরে ও বাইরে চলাচলের রাস্তা কাদা-মাটিতে একাকার। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও নেই। এসব কারণেও অনেকে সরকারি ঘর বরাদ্দ পেলেও তাতে থাকতে চান না।

অন্যদিকে তাড়াশ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আশ্রায়ণের ঘর বরাদ্দ পাওয়া দেশিগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জ্ঞানেন্দ্রনার্থ বসাক বলেন, ঘর বিক্রি বা ঘরে না থাকার বিষয়গুলো আমাদের অনেকেই জানান, তবে লিখিতভাবে কেউ জানায় না।

এ বিষয়ে তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নুসরাত জাহান বলেন, ঘর বিক্রির অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য বিষয়গুলোও জেনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
 

 
 
 

মারিয়া

×