ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

লিবিয়ায় মুক্তিপণের জন্য জিম্মি ২ জন প্রবাসী ৪২ দিন আটক থাকার পর পিবিআই কর্তৃক উদ্ধার

প্রকাশিত: ১৭:২৬, ১০ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৭:২৬, ১০ জুলাই ২০২৫

লিবিয়ায় মুক্তিপণের জন্য জিম্মি ২ জন প্রবাসী ৪২ দিন আটক থাকার পর পিবিআই কর্তৃক উদ্ধার

লিবিয়ার ত্রিপোলি হতে গত ০৮/০১/২০২৫ তারিখ ভিকটিম ১। আলমগীর হোসেন (৪৫) ও ২। সিরাজ উদ্দিন (৩৫), জমাজৈতন এলাকায় ওয়ার্কশপে কাজ করার অবস্থায় কতিপয় অজ্ঞাতনামা অপহরণকারীদের মাধ্যমে অপহৃত হন। পরবর্তীতে রাত অনুমান ০১.০০ ঘটিকায় ভিকটিমদের ব্যবহৃত নম্বরের IMO অ্যাপসের মাধ্যমে তাদের পরিবারের নিকট মুক্তিপণ বাবদ জনপ্রতি বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২২ লক্ষ টাকা দাবি করে। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে ভিকটিমদ্বয়কে IMO-তে লাইভে রেখে নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন করে দ্রুত মুক্তিপণ না দিলে তাদেরকে প্রাণে মেরে ফেলবে মর্মে হুমকি দেয়।

১৩/০১/২০২৫ তারিখ ভিকটিম সিরাজ উদ্দিনের ভাবী পারভীন আক্তার অপহরণকারীদের দেওয়া বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে ১,৫০,০০০/- (এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) টাকা প্রদান করেন। তথাপি ভিকটিমদ্বয়কে মুক্তি না দিয়ে নানা প্রকার অত্যাচার চালিয়ে মুক্তিপণ দাবি করতে থাকলে ভিকটিম আলমগীরের বড় ভাই বাদী আব্দুল মালেক (৫২) অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে আদাবর থানার মামলা নং–১৪, তারিখ: ২৯/০১/২০২৫, ধারা: মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এর ১০(১)/১৪ ধারা রুজু করেন। বাদীর উদ্ধার আবেদনের প্রেক্ষিতে ও মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনায় পিবিআই, ঢাকা মেট্রো (উত্তর) স্বউদ্যোগে অধিগ্রহণ করে বিশেষ গুরুত্বের সাথে তদন্ত শুরু করে।

পিবিআই মামলার তদন্ত শুরু করে অজ্ঞাতনামা অপহরণকারীদের গোয়েন্দা তথ্য পর্যালোচনার পর আসামি মোঃ রাসেল হক (২৫), পিতা–মৃত মোঃ মতিউর রহমান, সাং–লক্ষীনারায়নপুর, থানা ও জেলা: চাঁপাইনবাবগঞ্জকে গত ৩০/০১/২০২৫ তারিখ রাজশাহী মহানগরের বোয়ালিয়া থানাধীন কড়ইতলা মোড় হতে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত আসামি মোঃ রাসেল হক (২৫) তার লিবিয়া প্রবাসী মামা কামাল হোসেনের সাথে ভিকটিমের পরিবারের দেওয়া মুক্তিপণের টাকা লেনদেনের বিষয়ে IMO-তে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন। ভিকটিম সিরাজের পরিবারের পাঠানো ১,৫০,০০০/- টাকার ব্যাংক স্লিপটি কামাল হোসেন গ্রেফতারকৃত আসামির ইমোতে প্রেরণ করেন। উক্ত প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে তার নিকট থেকে একটি কালো রঙের OPPO ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।

আসামিকে গ্রেফতারের প্রেক্ষিতে অপহরণকারীরা ভিকটিমদ্বয়কে তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এবং তাদেরকে মেরে ফেলেছে মর্মে জানিয়ে নম্বর ব্লক করে দেয়। তখন ভিকটিমদ্বয়ের ওপর আরও অমানবিক অত্যাচার শুরু করে। তারা বেশিরভাগ সময় ভিকটিমদ্বয়ের নম্বর ব্যবহার করে কথা বলত। মাঝে মাঝে ‘টাকা নাই, জীবন নাই’ নামের IMO-নাম লেখা নম্বর হতে কল করে ভিকটিমদের পরিবারকে টাকা না দিলে হত্যা করা হবে মর্মে হুমকি দিত।

অজ্ঞাতনামা অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা ভিকটিমদ্বয়কে হাত-পা বেঁধে সারা শরীরে মারধর করত। কখনও কখনও পায়ের তালুতে পিভিসি ও ইলেকট্রিক মোটা ক্যাবলের তার দিয়ে মারত, এছাড়া হাঁটুতে মেরে গুরুতর জখম করত যেন উঠে দাঁড়াতে না পারে। খাবার ও পানীয় জলের কষ্ট দিত। এমনকি শীতের মধ্যে উলঙ্গ করে মুখে গামছা ভরে শরীর দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে বেধড়ক মারধর করত। এছাড়াও আরও অবর্ণনীয় কায়দায় মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন চালানো হতো।

পরবর্তীতে সপ্তাহ খানেক পর পুনরায় তাদের জীবন ভিক্ষা চাইলে জনপ্রতি ১০,০০,০০০/- (দশ লক্ষ) টাকা চেয়ে ভিকটিমদ্বয়ের পরিবারকে হুমকি দিতে থাকে। তখন উপায় না পেয়ে ভিকটিমদের পরিবার গত  ১৬/০২/২০২৫ তারিখ অজ্ঞাতনামা অপহরণকারীদের দেওয়া অ্যাকাউন্ট ‘ফরাজী টেলিকম’, ইসলামী ব্যাংক পিএলসি অ্যাকাউন্ট নম্বরে ২,০০,০০০/- (দুই লক্ষ) করে মোট ৪,০০,০০০/- (চার লক্ষ) টাকা পাঠায়। উক্ত অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অ্যাকাউন্টের মালিক মোঃ মিন্টু ফরাজী (৩৯), পিতা–মোঃ হাবিবুর রহমান ফরাজী, মাতা–মৃত ফাতেমা বেগম, স্থায়ী সাং–বাদুরতলা, পোস্ট: বিশারীঘাটা-৯৩২০, থানা: মোড়লগঞ্জ, জেলা: বাগেরহাটকে গত ১৬/০২/২০২৫ বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ এলাকা হতে গ্রেফতার করা হয়।

ধৃত আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, তার দূরসম্পর্কের ভাগ্নে জামাই লিবিয়া প্রবাসী নজরুল ইসলাম তার অ্যাকাউন্টে টাকা প্রেরণ করেছে। তার মোবাইলে ভিকটিমদের পরিবারের দেওয়া মুক্তিপণের টাকা লেনদেনের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। ভিকটিমদের পরিবারের পাঠানো ৪,০০,০০০/- টাকার ব্যাংক স্লিপটি নজরুল ইসলাম গ্রেফতারকৃত আসামির ইমোতে প্রেরণ করেন। উক্ত প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে তার নিকট থেকে একটি SAMSUNG ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন সেট, যার মডেল নম্বর SM-A260G জব্দ করা হয়। বিএফআইইউ (BFIU) এর সহায়তায় উক্ত অ্যাকাউন্টটি তাৎক্ষণিক ফ্রিজ করা হয়। আসামি পক্ষ টাকা উত্তোলন করতে পারেনি।

পরবর্তীতে গত ১৮/০২/২০২৫ তারিখ বাংলাদেশ সময় ০৩:৩০ ঘটিকায় লিবিয়ার ত্রিপোলি এলাকার জিলজিয়া হাসপাতাল নামক এলাকায় ভিকটিমদ্বয়কে ফেলে রেখে যায়। ভিকটিমদ্বয় ব্র্যাক মাইগ্রেশনের মাধ্যমে আইওএম (ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন) এর হেফাজতে ছিল। গত ০৯/০৭/২০২৫ তারিখ ভিকটিম আলমগীরকে পিবিআই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে হেফাজতে নেয়। অপর ভিকটিম সিরাজ উদ্দিনের আগমনের বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলমান রয়েছে।

উদ্ধার:
১। মোবাইল–২টি
২। লিবিয়ায় অবস্থিত আসামিদের সাথে গ্রেফতারকৃত আসামিদের ব্যাংক স্লিপ প্রেরণের প্রমাণপত্র স্ক্রিনশট
৩। লেনদেনকৃত অ্যাকাউন্ট দুটির ব্যাংক স্টেটমেন্ট
৪। ভিকটিমদের নির্যাতনকালীন অডিও/ভিডিও এবং উদ্ধার-পরবর্তী ভিডিও ও ছবি
৫। আইওএম (ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন) এর অবস্থানকালীন ছবি ও ভিডিও
৬। বিএফআইইউ (BFIU) এর চিঠি
৭। ব্র্যাক মাইগ্রেশনের সহায়তায় প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস

অতিরিক্ত আইজিপি পিবিআই জনাব মোস্তফা কামাল মহোদয়ের সঠিক তত্ত্বাবধানে ও জনাব মোঃ এনায়েত হোসেন মান্নান পিপিএম–সেবা, অতিরিক্ত ঊর্ধ্বতন পুলিশ মহাপরিদর্শক, পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) মহোদয়ের দিক নির্দেশনায় মামলাটি এসআই (নিরস্ত্র)/মোঃ জাকারিয়া আলম (০১৭১৬২২৭৬০৯) তদন্ত করেন।

আফরোজা

×