
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা মিরপুরসহ রাজধানী জুড়ে জনসাধারণের চলাচলের সুবিধায় রাজপথ থেকে গলিপথ ঘেঁষে ফুটপাতের জন্ম হলেও বেদখল কাণ্ডে চলাচলের সুবিধায় পথচারীদের কাজেই আসছে না ফুটপাত।
রাজধানীর ফুটপাতগুলোর ব্যবহার সুনিশ্চিতে উচ্চতর আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকলেও তা মানছে না কেউই, প্রতিপালনও হচ্ছেনা। ফলে সমগ্র রাজধানীর ফুটপাতগুলো বেদখলের ধারাবাহিকতায় রাজধানীর মিরপুরের ফুটপাতগুলোও কিছু প্রভাবশালীদের বেদখলে থাকায় পথচারীদের চলাচলের সুবিধা শিকেয় উঠেছে।
মহানগরবাসীর করের টাকায় ফুটপাতের জন্ম ঘটলেও এর মালিকানা কাগজে কলমে দুই সিটি কর্পোরেশনের। কিন্ত বাস্তবের চিত্রটি ভিন্ন। ফুটপাতের মালিক ক্ষমতাশালীরা, প্রভাবশালীরা।
কার্যকর আইন ও উচ্চ আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গাফিলতির কারণে মিরপুরের ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সমস্যাটি জিইয়ে রাখার জন্য পুলিশের গাফিলতিকে দুষছেন কিছু সুবিধাভোগী প্রভাবশালী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও। পক্ষান্তরে এই দায় নিতে নারাজ পুলিশ। তাদের মতে সমস্যাটি রাজনীতিবিদদেরই সমাধান করতে হবে।
অন্যদিকে মিরপুরবাসীর অভিযোগ, ফুটপাত দখলমুক্ত না থাকায় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনে বসে থেকে অসহনীয় ভোগান্তি পোহালেও কিছুই করার থাকে না তাদের। যদি ফুটপাতে হাঁটার পরিবেশ থাকত তাহলে যানজটও কম হতো। মানুষ গণপরিবহন ছেড়ে হেঁটে গন্তব্যে যেত।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যাণ মতে, নগরীর ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। এরমধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাতই এখন অবৈধ দখলে। আর ২২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার রয়েছে বেদখল। এগুলোতে সরকার দলের অঙ্গসংগঠনে নেতা-কর্মীদের ছত্রচ্ছায়ার বসেছে পণ্যের পসরা। কোথাও কোথাও ফুটপাত ছাড়িয়ে মূল সড়ক পর্যন্ত বসছে পণ্যের পসরা। ফলে নগরীতে পথচারীদের ভোগান্তি আর সড়কের যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ ছিন্ন মূল হকার্স সমিতির জরিপের তথ্যমতে, নগরীর ফুটপাতের ১৩ ভাগ হকারদের দখলে, ১৫ ভাগ মার্কেট মালিকদের দখলে, পাবলিক টয়লেট ও অন্যান্য যাত্রী ছাউনি ৫ শতাংশ, রাজনৈতিক দলের অফিস ১ শতাংশ, সব মিলিয়ে ৪৮ শতাংশ বিভিন্ন দখলে রয়েছে, এবং ৫২ শতাংশ উন্মুক্ত রয়েছে।
ছিন্নমূল হকার্স সমিতির তথ্য মতে, নগরীতে ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ হকারী পেশার সাথে জড়িত।
ঢাকা সিটি ম্যানুয়াল-১৯৮২ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-তে রাজধানীর ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত রাখতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ফুটপাত পথচারীদের হাঁটার জন্য উপযোগী করার কথাও উল্লেখ রয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ১৫ নম্বর ধারায় পুলিশের সাধারণ দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, জনগণের জন্য অস্বস্তিকর ও ক্ষতিকর অবস্থার অবসান ঘটানোর দায়িত্ব পুলিশের। ফুটপাত থাকবে পথচারীদের নির্বিঘ্নে হাঁটার উপযোগী পরিবেশ। ফলে ফুটপাত দখল করে দোকান দিয়ে পথচারীদের হাঁটা-চলায় বাধা সৃষ্টি করলে তা সমাধানের দায়িত্ব পুলিশের।
মিরপুরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিড়িয়াখানার ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের পার্কিং, রোডের সনি সিনেমা হলের অদূরেই ঈদগাঁ মাঠের সামনে মূল সড়ক দখল করে বাজার বসিয়ে জনদূর্ভোগ সৃষ্টির বিষয়ে স্থানীয়রা বলেন, ‘স্থানীয় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ যদি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখায়, তাহলে ফুটপাত দখল মুক্ত রাখা সম্ভব।
অপরদিকে ফুটপাত দখলমুক্ত করার বিষয়ে পুলিশ বলছে, ‘পুলিশ নিয়মিতভাবেই ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছে। হকাররা দেশের একটি বড় ইস্যু, সেটা সরকার ও রাজনীতিবিদরা জানেন। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরা যদি তাদের ফুটপাত থেকে উঠিয়ে দেয়, তাহলে সেটা সফল হবে না।’
ফুটপাত দখল আর বেদখল বিষয়ে ভিন্নমত পুলিশ প্রশাসন আর স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের মাঝে। এই মতভিন্নতার কারণে মাঝখানে সুযোগ পাচ্ছে দখলবাজরা। যাদের আয় রুজির উৎসই হলো ফুটপাত। এই উৎসকে জিইয়ে রাখতে ওইসব দখলবাজরা ধর্ণা দেয় রাজনীতিবিদ আর পুলিশের দুয়ারে। এছাড়া নিয়মিত অভিযানে ফুটপাত দখলমুক্ত করা হলেও কিছুক্ষণ পরই ঘুরে ফিরে সেই চেহারায় উপনীত হয় রাজধানীর ফুটপাত।
ফুটপাত ও চলাচলের পথ পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত রাখার নির্দেশনা চেয়ে ২০০১ সালে জনস্বার্থে রিট আবেদন দায়ের করেছিলেন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর সাদাত। প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। রুলে ঢাকা সিটি ম্যানুয়াল-১৯৮২ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ অনুসারে ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের কেন নির্দেশনা দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘জনস্বার্থে’ বেশ কিছু নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত। ঢাকা শহরে পথচারীদের ‘সহজ ও মুক্ত’ চলাচল নিশ্চিত করতে ‘স্পষ্ট ও কার্যকর’ আইন থাকলেও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিবাদীদের অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তায় তা বাস্তবায়ন হয়নি।
আইনের মূলনীতিসমূহ সতর্কতা ও মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ফুটপাত ও মানুষের চলাচলের পথ দখলকারীদের বিরুদ্ধে বা রাস্তা, সড়ক, ফুটপাত ও চলাচলের পথে নির্মাণ-সামগ্রী ফেলে রাখা বা জমা করে রাখার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে বিবাদীদের হাতে সন্দেহাতীতভাবে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্ত বর্ণিত দায়িত্ব ও আইনগত বাধ্যবাধকতা পালনে তাদের মধ্যে প্রমাণিত ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে।
মিরপুর বাসীর আরো দাবি, মিরপুরের ফুটপাত ও চলাচলের পথকে জনসাধারণের ব্যবহার ও পথচারীদের জন্য অবশ্যই পরিচ্ছন্ন এবং উন্মুক্ত রাখতে হবে। অবৈধ স্থাপনা অপসারণে বিবাদীদের পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সড়কের ফুটপাত ও চলাচলের পথে নির্মাণসামগ্রী রাখা বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া ‘দরিদ্র’ হকারদের সরকার ক্রমান্বয়ে পুনর্বাসন করতে পারে।
আঁখি