
ছবি: জনকণ্ঠ
পঞ্চগড়ের বোদায় নিবন্ধনহীন ভুয়া পশু চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য থামছেইনা, প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে গরু মারা যাওয়ার ঘটনা। সরকারি বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে উপজেলার সর্বত্র ভুয়া চিকিৎসকদের দৌরাত্ম আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সর্বশান্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারীরা।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় সকলের নাকের ডগায় গ্রাম-গ্রামান্তর জুড়ে হাতুড়ে পশু চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। আবার এসব ভুয়া চিকিৎসকের অনেকেই রেজিষ্ট্রেশনবিহীন কোম্পানির ওষুধ বিক্রি করে বনে গেছেন লাখপতি। খামারিদের কাছ থেকে ওষুধের মূল্য নিচ্ছেন ইচ্ছেমতো। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ও হাটবাজারে হাতুড়ে চিকিৎসকদের অনেকেই সাইনবোর্ড, প্যাড ও ভিজিটিং কার্ডে 'ডা:' পদবী ব্যবহার করে প্রাণী সম্পদ আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন করেছেন।
সূত্র জানায়, এসব হাতুড়ে চিকিৎসকদের বেশীরভাগেরই এসএসসি পাশের নূন্যতম সার্টিফিকেট পর্যন্ত নেই। অথচ গ্রামের খামারিদের কাছে এইসব ভুয়া চিকিৎসকরা সুকৌশলে নিজেদের নামকরা ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি ঘটান।
বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল অ্যাক্ট ২০১৮ অনুযায়ী যেকোনো প্রাণী ও পাখির লাইসেন্সবিহীন হাতুড়ে চিকিৎসা করলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা দুই লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা যাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, উপজেলায় কয়েক শতাধিক নিবন্ধনহীন পশু চিকিৎসক রয়েছে যারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কোনরকম সরকারি প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার সনদ ছাড়াই কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
উপজেলার ঝলইশালশিরি ইউনিয়নের দামুকাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বেগমের সাথে গরু সহ সাক্ষাৎ হয় উপজেলা প্রাণীসম্পদ হাসপাতালে। বেগমের ৫টি গরুর ছোট্ট খামার, তন্মধ্যে ২টি গরুতে লাম্পি ভাইরাস দেখা দিয়েছে। তিনি আক্ষেপ নিয়ে জানান, "হামেরা গরীব মানশি এত্ত কিছু কি জানি, অনেকদিন ধরে ডাক্তারের চিকিৎসা করাছি ভালো হয়না বাধ্য হয়ে এলা পশু হাসপাতালের বড় ডাক্তার দেখাবা আইচ্চি। হেমেরা কয়েছে এতদিন ভুল চিকিৎসা কইছে, এই গরু দুইটার কিছু হইলে মোর কি হবে"!
মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের ডাবরভাঙ্গা গ্রামের মো. নুরে আলম এর তিনটি গরুর মধ্যে দুটির লাম্পি হয়েছে তিনি বলছেন, গ্রাম্য পশু ডাক্তারকে খবর না দিলেও কীভাবে যেন খবর পেয়ে নিজ থেকেই চলে আসে চিকিৎসা দিতে, ওই ডাক্তারের পরামর্শে প্রায় ৩৫০০ টাকা খরচ করেও গরু সুস্থ না হওয়ায় উপজেলা পশু হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।"
এছাড়াও সাতখামার এলাকার খুরশেদ আলম, পৌর এলাকার মন্নাপাড়ায় মতিউর রহমান, চন্দনবাড়ী ইউনিয়নের বাসিন্দা সুমন, একই এলাকার সৌরভ, মাড়েয়া ইউনিয়নের জমির হোসেনসহ প্রত্যেকেই ভুয়া পশু চিকিৎসকদের খামখেয়ালীপনায় লাম্পিতে গরু মৃত্যুর ঘটনায় অপরিমেয় ক্ষতির স্বীকার হয়েছেন বলে জানান।
এ বিষয়ে ভেটেরিনারি কেয়ার সেন্টার এন্ড ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী ও ডেইরি এবং পোল্ট্রি কনসালটেন্ট ডা: ইমাম হোসেন জানান, "আমার কাছে অনেকেই আসেন যারা নিবন্ধনহীন এসব চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে অনেক পশু মারা যাওয়ার মত ঘটনাও ঘটছে। এসব হাতুড়ে চিকিৎসকরা খামারিদের ভুলভাল বুঝিয়ে এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিয়ে ব্যবস্থাপত্র লিখে দেয় এবং পরবর্তীতে নিজেরাই প্রতিবার ইনজেকশন দেয়া বাবদ ৩০০- ৫০০ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়।"
তিনি আরও বলেন, লাম্পি সহ যেকোনো রোগে শুরুতেই প্রাণীর দেহে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে আমরা খামারিদের সতর্ক থাকতে বলি কিন্তু নিবন্ধন বিহীন পল্লী চিকিৎসকের কারণে খামারিদের বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।
বোদা উপজেলা প্রাণীসম্পদ কার্যালয়ের ভেটেরিনারি সার্জন আব্দুল আলিম বলেন, হাতুড়ে পশু চিকিৎসকদের খামখেয়ালী চিকিৎসা ব্যবস্থা পশুর চিকিৎসায় নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এইসব হাতুড়ে পশু চিকিৎসকের কারণে ছোট ও মধ্যম শ্রেণীর খামারিরা বেশি নাজেহাল হচ্ছেন। পশুর সঠিক রোগ নির্ণয় ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন সহ অতিরিক্ত ওষুধে ব্যবস্থাপত্র লিখছেন যা পশু চিকিৎসায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য।
তিনি আরও জানান, লাম্পি রোগে ফেব্রুয়ারী-মার্চের দিকে ভ্যাক্সিন গ্রহণ করলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ। কিন্তু বেসরকারিভাবে ভ্যাক্সিনেশন পাওয়া গেলেও সরকারিভাবে অপ্রতুল।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, নিবন্ধনবিহীন প্রাণী চিকিৎসা দেওয়ার যোগ্যতা ও আইনগত কোন বৈধতা নেই। কদিন আগে রাজু নামের একজন ভুয়া পশু চিকিৎসকের কাছে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
আবির