
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে শনিবার হৃৎকাব্যে প্রকৃতি শীর্ষক প্রদর্শনী দেখছেন এক দর্শনার্থী
সাধারণত চারপাশের চেনা জগতকে উপজীব্য করেই সৃজিত হয় শিল্পকর্ম। তেমনই এক শিল্পী মোঃ রকিবুল হাসান। সেই সুবাদে ক্যানভাসে মাটি ও মানুষের ধারাভাষ্য দিয়েছেন এই চিত্রকর। তবে তাঁর ছবি আঁকার আঙ্গিকে রয়েছে ভিন্নতা। বেছে নিয়েছেন নিরীক্ষাধর্মী পথরেখা। বিমূর্ত ধারার মিশ্রণে মেলে ধরেছেন দৃশ্যমান বাস্তবতাকে। আঁকার সেই করণকৌশলে চিত্রপটের বিষয়বস্তু দেখার পাশাপাশি কড়া নাড়ে শিল্পরসিকের অনুভূতির ভুবনে। তা তো বলা যায়, রকিবুল কেবল ছবি আঁকেন না, বরং অনুভব করান।
চিন্তার দুয়ার ছুঁয়ে যাওয়া সেসব ছবিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় মাটি ও মানুষ। সেখানে নিসর্গের সঙ্গে সখ্য ঘটেছে জীবনের। অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির মাঝে রচিত হয়েছে জীবনের জ্যামিতিক ভারসাম্য। নিসর্গ ও জীবনের সংলাপ আশ্রিত সেসব ক্যানভাসে মেঠোপথ ধরে হেঁটে যায় রাখাল বালক। ধানক্ষেতে মাথা নুয়ে নিবিষ্টচিত্তে কাজ করে যায় কৃষক। কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় পাহাড়। ভোরের নরম আলোয় বৃক্ষের ডালে ডালে বিচরণ করে পাখির ঝাঁক। খাদ্যের সন্ধানে খোলা মাঠে ঘুরে বেড়ায় গরুর পাল।
সুপেয় জল আহরণে কলসি কাঁখে পল্লীবধূ পাড়ি দেয় দীর্ঘ পথ। মনের সুখে অসীম অন্তরিক্ষে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় চিল। এমন মনোহর দৃশ্যকল্পের ছবির সম্মিলনে শিল্পায়োজনটির শিরোনাম ‘হৃৎকাব্যে প্রকৃতি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে চলছে এই প্রদর্শনী।
শিল্প সৃষ্টিতে বহুমাত্রিক মাধ্যম বেছে নিয়েছেন রকিবুল হাসান। ক্যানভাসে জলরঙের স্বচ্ছতার সমান্তরালে উপস্থাপিত হয়েছে তেলরঙের গভীরতা। টেরাকোটা কিংবা কাঠখোদা মাধ্যমের প্রাচীনতার আবেশে শিল্পী খুঁজেছেন শিল্পের নতুন ভাষা। সরু কিংবা স্ফিত রেখার টানে উন্মোচিত হয়েছে সময়ের স্বরূপ। রঙের ব্যবহারেও মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন এই রকিবুল। তুলির আঁচড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন ধোঁয়াশাযুক্ত মায়াময় এক আবহ। বেশিরভাগ ছবির রঙের আস্তরণে ধরা দিয়েছে ঊর্ধ্বমুখী রৈখিক অভিযাত্রা।
চিত্রপটের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ধাপে ধাপে বর্ণের বিন্যাস ঘটেছে। আবেগের নিরিখে ব্যবহৃত রংগুলো কখনো বিষণœ নীল, কখনো পুড়ে যাওয়া, কখনোবা থমকে থাকা ধূসর। রঙের এই বিন্যাসের গুণেই বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার সংলাপে পরিণত হয়েছে রকিবুলের ক্যানভাস।
রকিবুলের ক্যানভাসে নিসর্গের যে রূপময়তা মূর্ত হয়েছে, তা কখনো প্রমত্ত নয়Ñবরং ধ্যানী, সংযত ও নৈঃশব্দময়। এ কারণেই তার ছবি দর্শনার্থীর অনুভূতির জগতকে ধাবিত করে স্থিরতার অভিমুখে। জাগিয়ে তোলে প্রশান্তির অনুভব। এ কারণে তার চিত্রকর্মগুলো চোখ দিয়ে দেখার পরিবর্তে হৃদয় দিয়ে দেখার তাড়নাকে উসকে দেয়। শিল্পরসিকের মাঝে সঞ্চারিত হয় ¯িœগ্ধ অনুভূতি। তেলরঙে আঁকা নদীর ঢেউ বা পাহাড়ের রেখায় মিশে থাকা গভীরতায় প্রসারিত হয় দর্শকের ভাবনার ভুবন।
রকিবুল হাসানের দর্শন আশ্রিত চিত্রকর্মগুলো কেবল নিসর্গের রূপায়ন ঘটেনি; বরং প্রকৃতির ভেতর বাস করেও অস্তিত্বের গহিনে নজর ফেলেছে। এই শিল্পীর কাজে নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকা গাছ, নদী ও নারী, ফসলের মাঠে চলমান গরু, আকাশে হেলান দিয়ে কাত হয়ে থাকা ঘুমন্ত পাহাড়, অলৌকিক কুয়াশা, রঙের বৈভবময় মাছরাঙা, সাজেকের পাহাড়, বরন্দ্রেভূমির পাথুরে মাঠ, নদীর পাড়ে গরুর বিচরণ কিংবা ভোরের আলোয় দেখা দোয়েল- সবকিছুর মাঝেই উঁকি দেয় জীবনের প্রতীকী প্রতিচ্ছবি। এভাবেই শিল্পী স্মরণ করিয়ে দেন, ছবি শুধু দেখা বা বোঝার বিষয় নয় বরং অনুভবের এক গভীর আভাস।
প্রদর্শনীটি যৌথভাবে কিউরেট করেছেন ড. শেখ মনির উদ্দিন জুয়েল এবং ড. মোঃ আদনান আরিফ সেলিম। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত চলবে শিল্পায়োজন।