ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩০ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ৮০ শতাংশ পুকুর ক্ষত-বিক্ষত

সোহেল আহাদ, কন্ট্রিবিউট রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ২৯ মে ২০২৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ৮০ শতাংশ পুকুর ক্ষত-বিক্ষত

ছবিঃ জনকণ্ঠ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতি সুপ্রাচীন একটি শহর। ১৮ বর্গকিলোমিটারের উত্তর দক্ষিণ লম্বাকৃতি শহরটি ১৮৬৮ সনে শহরের দক্ষিণে বৃহত্তর ভাদুঘর থেকে শহরের উত্তরে বৃহত্তর মেরুরাসহ (মেড্ডা) ছোট বড় ত্রিশটি মহল্লা নিয়ে ৪টি ওয়ার্ডে ঘটিত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা।

পৌরসভা গঠন হওয়ার শুরু থেকে ১৯৯৩ সন পর্যন্ত শহরটি ৪টি ওয়ার্ডে বিভক্ত ছিল। শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগরায়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৯৯ সনের পৌর নির্বাচনের পূর্বে ৪টি ওয়ার্ডকে ভেঙে ১২টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়।

 প্রবীণদের মতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর সত্তরের দশকে পুকুরের শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। পৌর শহরের পুরাতন ৪টি ওয়ার্ডে প্রায় চার শতাধিক পুকুর ও জলাশয় ছিল যা এখন দুই শতাধিকে এসে ঠেকেছে।

সরেজমিনে দেখা যায় শহরে জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা ও ব্যক্তি মালিকানাধীনসহ মোট ১৮৮ টি পুকুর, ছোট বড় প্রায় ২৬টি খাল ও জলাশয়ের তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

যার মধ্যে গোকর্ণঘাট মহল্লায়-৬টি, আমিনপুর-২টি, বৃহত্তর মেড্ডা-২২টি, শরীফপুর-২টি, শেরপুর-৫টি, উত্তর মৌড়াইল-৬টি, দক্ষিণ মৌড়াইল-৬টি, দাতিয়ারা-৪টি, পুনিয়াউট-১৫টি, কলেজপাড়া-৫টি, উত্তর পৈরতলা-৯টি, দক্ষিণ পৈরতলা-১১টি, ছয়বাড়িয়া-২টি, নয়নপুর-২টি, কাজীপাড়া-৭টি, কান্দিপাড়া-৩টি, শিমরাইলকান্দি-৪টি,পাইকপাড়া-১৫টি কালাইশ্রীপাড়া-২টি, ফুলবাড়িয়া ও মুন্সেফপাড়া-৫টি, বাগানবাড়ি-২টি, বৃহত্তর মধ্যপাড়া-১২টি, মৌলভীপাড়া ও হালদারপাড়া-৬টি ও বৃহত্তর ভাদুঘর-৩৭টি পুকুর রয়েছে। এর মাঝে পশ্চিম মেড্ডার আইন কলেজ সংলগ্ন সিকদার পুকুর, টেঙ্কেরপাড় লোকনাথ দীঘি, ফুলবাড়িয়া রামা পুকুর, শেরপুর পুকুর, রামকানাই হাই স্কুল সংলগ্ন পুকুর, অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন পুকুর, মধ্যপাড়া মহেশ্বরী দীঘি, পৌর ভবন পুকুর, কাজীপাড়া পুকুর ও পাওয়ার হাউজ রোডের ভবদেব পুকুরসহ মোট ১০টি পুকুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার নিজস্ব পুকুর বলে দাবি করলেও অধিকাংশ পুকুরই এখন পৌর কর্তৃপক্ষের দখলে নেই।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ তাদের ৭টি পুকুরের দাবি তোলেন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ, জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ, উপজেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষের কয়টি পুকুর রয়েছে তার কোন তথ্য নেই এসব দপ্তরে। খাল জলাশয়ের জরীপে শহরে মোট ২৬টি ছোটবড় খাল জলাশয় রয়েছে যা এখন সবগুলোই মৃত প্রায়।

এর মাঝে তিতাস নদী সংলগ্ন মেড্ডা সার গুদাম থেকে উৎপত্তি খালটি মেড্ডা মহল্লা দিয়ে বয়ে গেছে, তিতাস সংলগ্ন মেড্ডা বাজার দক্ষিণ থেকে উৎপত্তি খালটি বিরাসার বাসস্ট্যান্ড লেগেছে যা এখন বিলুপ্ত, তিতাস সংলগ্ন পূর্ব পাইকপাড়া বান্নীঘাট থেকে উৎপত্তি খালটি কুমারশীল মোড়ে শেষ হয়েছে যা এখন বিলুপ্ত। তিতাস সংলগ্ন আনন্দ বাজার ঘাট থেকে উৎপত্তি খালটি সদর হাসপাতালে শেষ হয়েছে যা এখন বিলুপ্ত। ভাদুঘর মহল্লায় ৮টি ছোটবড় খাল, মধ্যপাড়া ২টি, জেল রোড ১টি, মৌলভীপাড়া ১টি, শিমরাইলকান্দি পাওয়ার হাউজ রোড ১টি, উত্তর পৈরতলা ১টি, ফুলবাড়িয়া ১টি, বৃহত্তর টাউনখাল ১টি, গোকর্ণঘাট ২টি, ছয়বাড়িয়া ১টি, আমিনপুর ১টি, কান্দিপাড়া ২টি, কাজীপাড়া ১টি, মসজিদ রোড ১টি খালের তথ্য কাগজে থাকলেও সরেজমিনে তা দেখার জন্য অনুবিক্ষণ যন্ত্রের সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে।

সবগুলো খাল বিভিন্ন দপ্তরের যোগসাজসে এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ে কতিপয় ভূমিখেকুরা দিনদিন দখল করে পুকুর খাল জলাশয়গুলো বিলীন করে দিচ্ছে। তথ্যানুযায়ী শহরের মেড্ডা মহল্লায় পোদ্দার বাড়ির পুকুরটি মাটি ভরাটে দখল নিতে স্থানীয় প্রভাবশালীরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সিলেট রোডের পাশে অবস্থিত রাম ঠাকুর আশ্রমের পুকুরটি সরকারি হলেও প্রশাসনের নাকের ডগায় ভরাট করে বৃহৎ অট্টালিকা গড়ে উঠেছে। পুর্ব মেড্ডা কালাগাজীর মাজার সংলগ্ন পুকুরটি সর্বোচ্চ বাঁধা প্রয়োগ করেও আওয়ামী দলীয় প্রবাবশালীদের প্রভাবে পুকুরটি অবশেষে রক্ষা করা যায়নি। মধ্যপাড়া বর্ডার বাজার পুকুরটি দখল, মধ্যপাড়া ধোপাবাড়ির পুকুরটি দখল, মধ্যপাড়া বসাকপাড়া পুকুরটি ভরাট, শান্তিবাগ সফর আলী মেম্বার বাড়ির পুকুরটি দখল, পশু হাসপাতালের পিছনের পুকুরটি দখল, কালাইশ্রীপাড়া মদিনা মসজিদ পুকুরটি ভরাট, লোকনাথ দীঘি সংলগ্ন পূর্ব পাড় অবস্থিত পুকুটি ভরাট করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

গণপ্রজান্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১০ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ সংশোধনপূর্বক জলাধার সংরক্ষণের লক্ষ্যে উক্ত আইনে ৬ঙ ধারা সংশোধন করা হয়েছে। জলাধার ভরাটের অপরাধে দশ বছর কারাদণ্ড বা দশ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড আরোপণের বিধান রয়েছে।

জেলা খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদক নীহার রঞ্জন সরকার বলেন, এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা পুকুরে পরিপূর্ণ থাকলেও এখন খুঁজতে হবে জুম লেন্স ক্যামেরা দিয়ে। অধিকাংশ পুকুরই ভরাট করে ফেলা হয়েছে, যা আছে মৃতপ্রায়, নোংরা, কচুরিপানায় ভরা, সুয়ারেজ লাইন দিয়ে পুকুর ও পরিবেশের সর্বনাশ করা হচ্ছে। যা জলাশয় আইন পরিপন্থী। পুকুরগুলো ভরাট হওয়ায় পৌরসভার শিশুরা সাঁতার জানা থেকে বঞ্চিত, আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের পানির অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা দুরুহ হয়ে যায়। পৌরসভার নিশ্চয় অনেক দায় আছে তাই সেই দায়িত্ববোধ থেকে পুকুরগুলোর দ্রুত সংস্কার করে চারপাশ হাঁটার রাস্তা করে দেয়া উচিত বলে মনে করেন।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলী আজম বলেন, জলাশয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শহরের পুকুরগুলো এখন আর ব্যবহার উপযোগী নয়। পলিথিন, কচুরীপানা এবং পলিমাটি জমে পুকুরগুলো জরাজর্ণী হয়ে পড়েছে। শহরের পুকুরগুলো এখন ভূমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে। ভুমিদস্যুদের থেকে পুকুরগুলো রক্ষা করে এবং সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, পুকুরগুলো পুনরুদ্ধা করে সুন্দর একটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া গড়ার প্রত্যাশা করি।

“হতে হবে সোচ্চার, জলাধার ভরাট করবো না আর” পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তৃপক্ষ পুকুর এবং জলাশয়ে ময়লা না ফেলার সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দায়সাড়ার অভিযোগ কর্ণপাত না করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন ভূইয়া জানান, পুকুরের জলাশয়ের তালিকা আমাদের কাছে থাকার কথা নয়, এগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা এবং উপজেলা ভূমি অফিস করবে। পুকুর ভরাট করার বিরুদ্ধে সরেজমিনে আপনাদের কোন তৎপরতা না থাকার কারণ অস্বীকার করে বলেন, আমরা অভিযোগ পেলে বাদী এবং বিবাদী উভয়কে ডেকে এনে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করি। পুকুর ভরাট বন্ধে আপনারা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়টি উপজেলা ভূমি অফিসের দায়িত্ব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা মুক্তা গোস্বামী বলেন, আমরা পুকুরের তালিকা করিনি। কতটি পুকুর ব্যবহার উপযোগী তাও আমার জানা নেই। বর্তমানে শহরের ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরগুলো পুনরুদ্ধার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কেউ যদি অভিযোগ করে তা খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া অন্যান্য পুকুর কতটি রয়েছে তা আমার জানা নেই। তিনি আরো জানান, আমরা গত ফেব্রুয়ারি মাসে শহরের কাজীপাড়া মহল্লার তিনটি পরিত্যক্ত পুকুর পরিষ্কার করেছি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত মো. ইশতিয়াক ভূঁইয়াকে একাধিকবার মুঠো ফোনে এবং ক্ষুদে বার্তায় যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার প্রশাসক শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর বা মজা পুকুর রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব নয়। আমাদের কাছে অভিযোগ আসলে তা খতিয়ে দেখা হবে বলে তিনি জানান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এতগুলো পুকুর রয়েছে তা আমার জানা নেই। বর্তমানে মজা পুকুরগুলোতে পলি জমে, কচুরিপানা এবং পলিথিন জমে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যদি কেউ ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর শ্রেণি পরিবর্তন করে ভরাট করে তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। ব্যক্তি মালিকানাধীন/সামষ্টিগত মালিকানাধীন কিংবা সরকারি পুকুর বা জলাশয় ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী ভরাট করা যাবেনা। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন অব্যবহৃত পুকুরগুলো পরিষ্কার বা রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের না।

আলীম

×