
ছবি: সংগৃহীত
- বছরে প্রায় অর্ধকোটি টাকা মূসক ও আয়কর ফাঁকি
- বহুপূর্ব থেকে জানলেও পদক্ষেপ নেয়নি জেলা রাজস্ব বিভাগ
- “সরকারি কর্মকর্তারা আসে, তাদের অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয় আমাদের করতে হয়; এই টাকা কি বাড়ি থেকে নিয়ে আসবো?” - ইসলাম উদ্দিন, বাগান মালিক
- “অপরাধ হচ্ছে জেনেও পদক্ষেপ না নিলে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা”- ব্যরিস্টার বদরুজ্জামানা মুন্সি, দ্বিতীয় সচিব, এনবিআর
দেশের অন্যতম পর্যটন জেলা সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড় শুধু দেশেই নয়, বিদেশিদের কাছেও এক আকষর্ণীয় পর্যটন কেন্দ্র। টাঙ্গুয়ার হাওড়কে কেন্দ্র করে জেলার তাহিরপুর উপজেলা পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিতি পেলেও বারিক্কা টিলা, নীলাদ্রী লেকের মতো আরো অনেক পর্যটন স্পট ধীরে ধীরে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এসব পর্যটন স্পটের বেশিরভাগই প্রাকৃতিকভাবে তৈরী হলেও কিছু আছে মানুষের হাতে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা। তেমনই একটি পর্যটন কেন্দ্র ‘আলহাজ্ব জয়নাল আবেদিন শিমুল বাগান’। পর্যটন মৌসুমসহ বছর জুড়ে বাগানটি পরিদর্শনে আসে হাজার হাজার পর্যটক। এই পর্যটকদের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় লাখ টাকা আয় করলেও সরকারের পাওনা বাবদ রাজস্ব নিয়মানুসারে প্রদান করছেন না বাগান কর্তৃপক্ষ। পুরো বছরের জন্য নামকাওয়াস্তে রাজস্ব প্রদান করলেও এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেয়নি জেলা কাস্টমস এক্সাইস ও ভ্যাট কমিশনারেট অফিস। বরং ‘শুধু করা বাড়িয়ে দিতে হবে’, মৌখিকভাবে এমন নির্দেশনাই দেয়া হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে পর্যটন কেন্দ্রটির সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের সোহালা গ্রামে অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ এই শিমুল বাগানটিতে প্রতিদিনই কয়েক হাজার দর্শনার্থী ঘুরতে আসছেন।
মূসক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ মূসক ফাঁকি দিচ্ছে বাগান কর্তৃপক্ষ। মূসক আইন অনুসারে শিমুল বাগানটি অ্যামিউজমেন্ট বা বিনোদন পার্ক ও থিম পার্ক এবং পর্যটন স্পট ও স্থাপনা হিসেবে চিহ্নিত হলেও জেলা কাস্টমস অফিস থেকে একে দেশজ পণ্য ও সেবা খাত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। মূসক আইন অনুসারে, এই ধরণের পার্ক বা বিনোদনের স্থানকে অর্থনৈতিক কোড এস-০৬৪.১০ এবং এস-০৬৪.২০ হিসেবে ১৫ শতাংশ মূসক আরোপের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বাগান মালিক ইসলাম উদ্দিনের দেয়া তথ্যমতে, পর্যটন মৌসুমে অর্থাৎ ফুল ফোটার সময় (জানুয়ারি-মার্চ) প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার এবং বর্ষাকালে (মে-আগস্ট) প্রতিদিন দেড় থেকে ২ হাজার লোক প্রতিদিন এখানে আসে। এছাড়া মন্দার মৌসুমেও (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) এই সংখ্যাটি সাধারণত ৫’শ এর কম হয় না। অর্থাৎ মৌসুমভেদে প্রতিদিনই এই বাগান থেকে পর্যটকদের প্রবেশ ফি বাবদ সর্বনিম্ন ২৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। অপরদিকে বাগানের ভেতরে ক্যাফে ও রেস্টুরেন্স, ঘোড়া রাইড ও পার্কিং ফি বাবদ বছরে আয় হয় প্রায় ১০ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ এর ২(৬) ধারা অনুসারে বাগান কর্তৃপক্ষকে ৫০ টাকা মূল্যের প্রতিটি টিকেটের বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে মূসক প্রদান বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিনোদন কেন্দ্রটিতে মন্দা সময়ে প্রতিদিন সর্বনিম্ন ৫’শত দর্শনার্থীর প্রবেশ ফি বাবদ মাসে সর্বনিম্ন মূসকের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার টাকা
অপরদিকে পর্যটন মৌসুমে সর্বনিম্ন ১৫’শ টিকেটের বিপরীতে মাসে প্রায় ৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা পরিশোধ করার বিধান রয়েছে। অর্থাৎ মন্দা মৌসুমের ৪ মাসে এই মূসক ৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা এবং পর্যটন মৌসুমের ৮ মাসে এই মূসক ২৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকাসহ মোট সর্বনিম্ন ৩১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা প্রদান করার কথা। অথচ প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের ৪ঠা সেপ্টেম্বর দেশজ পণ্য ও সেবা খাতের আওতায় মাত্র ৩০ হাজার টাকা মূসক প্রদান করছে। এক্ষেত্রে বছরে ৩১ লাখ টাকারও বেশি ফাঁকি দিয়েছে। গত ১০ বছরের হিসাবে এই ফাঁকির পরিমাণ ৩ কোটির অধিক। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে বড় অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে শিমুল বাগান কর্তৃপক্ষ।
বাগান মালিক ইসলাম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশাল এই শিমুল বাগানটি পরিচালনার জন্য ২০ জন কর্মচারী নিয়মিত কাজ করছেন। এদের বেতন বাবদ বছরে ১০-১২ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়। অপরদিকে বাগান উন্নয়নে বছরে সর্বোচ্চ ৭-৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়। সব মিলিয়ে বছরে বাগান পরিচালন ও উন্নয়নে ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা।
স্থানীয় সূত্রের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, প্রবেশমূল্য ছাড়াও বাগান কর্তৃপক্ষের আয়ের অন্য উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক্যাফে ও রেস্টুরেন্ট ভাড়া বাবদ বার্ষিক ৪ লাখ টাকা, পর্যটকদের বিনোদনে ব্যবহৃত ঘোড়া রাইড থেকে বার্ষিক সাড়ে ৩ লাখ টাকা এবং গাড়ি পার্কিংয়ের ভাড়াসহ সর্বমোট ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছরে বাগান কর্তৃপক্ষের আয়ের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার এবং অন্যান্য ১০ লাখসহ মোট ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাগান উন্নয়ন ও কর্মচারীদের বেতন বাবদ বছরে ২০ লাখ টাকা ব্যয় হলেও বাগানের আয় হিসেবে রয়ে যায় ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আয়করের বর্তমান নিয়মানুসারে এই আয়ের উপর বিভিন্ন স্লাবে বাগান মালিকের আয়কর প্রদান করতে হয় ৩২ লাখ টাকারও বেশি।
কেননা, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আয়কর বিধান অনুসারে প্রথম ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর শূন্য, পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২০ শতাংশ, অবশিষ্ট মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ কর প্রদান করতে হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটিকে মূসক ও আয়কর বাবদ বছরে রাজস্ব প্রদান করতে হবে ৬৩ লাখ টাকা। কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ আইন অনুসারে সরকারি কোষাগারে এই রাজস্ব প্রদান করছে না বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র।
রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে সুনামগঞ্জ কাস্টমস এক্সসাইস ও ভ্যাট কমিশনারেট এর সহকারি কমিশনার রাসেল আহমেদ এর কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের ভ্যাট কম দেয়ার বিষয়টি আমাদের জানা আছে। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে তারা ভ্যাট প্রদান করে। কয়েকদিন আগে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম এবং তাদেরকে ভ্যাট প্রদানের কথা বলেছি। তিনি বলেন, গতবছরের চেয়ে তারা টিকেটের মূল্য কিছুটা বাড়িয়েছে, সেটার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরাও ভ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়েছি। এবার তারা ৬০ হাজার টাকা জমা দিয়েছে। ডকুমেন্টসের পরিবর্তে সামঞ্জস্য রেখে ভ্যাট আদায় কেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন- তারা কোন হিসাব রাখে না। কি পরিমাণ টিকেট বিক্রি করে, তার কোন তথ্য নেই। আমরাও এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। অবশ্য তারা ইচ্ছে করেই কোন ধরণের ডকুমেন্টস রাখে না। ফলে আমরা যখন ভ্যাট অফিস থেকে অভিযান পরিচালনা করি, কোন তথ্য বা ডকুমেন্টস না থাকায় আমরা সঠিকভাবে রাজস্ব আদায় করতে পারি না। এক্ষেত্রে আমরা দেখি, গতবছর তিনি কি পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করেছেন তার আলোকে একটা ধার্য করা হয়। তাই আমরা এবার বলেছি, গত বছর যা দিয়েছেন এবার তার দ্বিগুন অর্থাৎ ৬০ হাজার টাকা দিতে হবে। তো সে অনুসারেই তারা টাকা টাকা প্রদান করেছেন।
ডকুমেন্টস না থাকায় কখনো জরিমানা করা হয়েছে কিনা, এমনটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তাদেরকে কোন জরিমানা করা হয়নি। তবে এবার আমরা স্থানীয় সোর্সের মাধ্যমে টিকেট বিক্রির তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি। সে অনুযায়ী আমাদের অফিস থেকে তাদেরকে চিঠি দেয়া হবে।
অপরদিকে বাগান কর্তৃপক্ষের আয়কর প্রদানের বিষয়ে জানতে জেলা কর অফিসের সহকারী কর কমিশনার রাকিবুল ইসলাম খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি। তবে নাম প্রকাশ না করে অফিসের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বাগানটি এখন একক মালিকানায় না থাকায় আয়কর তথ্য পাওয়াটা দুষ্কর। মূল মালিক জয়নাল আবেদিনের মৃত্যুর পর এখন তার সন্তানরা এই বাগানটির দেখভাল করছেন। ফলে বাগান থেকে প্রাপ্ত আয় অনুসারে তারা আয়কর দিচ্ছেন কিনা, সেটি কাগজপত্র না দেখে এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না। কাগজ দেখে হয়তো বলা যাবে, তারা আয়কর তথ্যে কোন মিথ্যা তথ্য দিয়েছে কিনা? যেহেতু এখন ঈদের ছুটি চলছে, তাই অফিস খোলার পরই বিষয়টি বলা যাবে।
রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে জনকণ্ঠ থেকে অভিযুক্ত বাগান কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. ইসলাম উদ্দীনের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, তারা তো এসব বলবেই। এই যে কিছুদিন আগে আন্দোলন গেলো তখন সবকিছু বন্ধ ছিল। এর মধ্যেও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ছিল। এর আগে করোনা ছিল। সে সময়ও তো অনেক খরচ করতে হয়েছে। তাছাড়া সরকারি পর্যায়ে যারা আসে যেমন- সচিব, জেলা প্রশাসক; তাদের থেকে তো আমরা টাকা নেই না। সরকারি বিভিন্ন প্রোগ্রামে এক-দেড়শ মানুষ আসে, তাদের খাবার-দাবারসহ যাবতীয় সবকিছু আমাদের অ্যারেঞ্জ করে দিতে হয়। এর জন্য যে অর্থ, সেটা কি আমরা নিজের ঘর থেকে নিয়ে আসবো? এটা তো তারাও জানে। আমরা তো এসব বলি না।
তবে সুনামগঞ্জ সার্কেল অফিসের এমন উদাসীনতার বিষয়ে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ের দ্বিতীয় সচিব (আইন ও বিধি) ব্যরিস্টার বদরুজ্জামান মুন্সি’র কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, কেউ যদি বিক্রয়ের ডকুমেন্টস না রাখে তাহলে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব অফিসের কর্মকর্তারা সেল ভেরিফিকেশন করতে স্পটে গিয়ে যাচাই করতে পারে। এক্ষেত্রে সেলের পিকটাইম এবং অফ পিকটাইম দুই সময়ের এভারেজ করে সেল কাউন্ট করতে হবে। এটা মূলত ফাঁকি বের করার একটি পদ্ধতি। কিন্তু কোন কর্মকর্তা যদি নিজের অদক্ষতার জন্য এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেন, তাহলে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে তাকে অন্য অগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বদলি করা যায়। তবে ওই কর্মকর্তা যদি জেনেবুঝে অর্থাৎ ইনটেনশনালি কোন ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে।
আবীর