আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে খ্যাত গাজীপুরের পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীসহ ৪৪ জন মনোনয়নপত্র জমা দিলেও ৪১ জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়। গত নির্বাচনে সবকটি আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এবারের নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে আওয়ামী লীগ একটি আসনে পরিবর্তন এনেছে। পাঁচটি আসনের মধ্যে তিনজন নারী প্রার্থীকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে। তবে সবক’টি আসনেই মনোনয়নবঞ্চিত একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
ফলে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের (নৌকা প্রতীক) প্রার্থীদের সঙ্গে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। হবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আর এ নিয়ে পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনে বিপাকে পড়তে হচ্ছে সচেতন ভোটারদের। এসব বিষয় নিয়ে সর্বত্র চলছে নানা আলোচনা। তাই নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ঘর গোছাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ফলে পুরো জেলাজুড়ে নির্বাচনী আমেজের সৃষ্টি হয়েছে।
পাঁচটি সংসদীয় আসনের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা ভোটারদের সমর্থন আদায়ে বিভিন্ন মহলে ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ইতোমধ্যেই জনসাধারণের মাঝে শুরু হয়েছে গত নির্বাচনে জয়ী হওয়া এমপিদের সাড়ে চার বছরের নানা কার্যক্রমের চুলচেরা বিশ্লেষণ। ফলে নির্বাচনী উত্তাপ ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
গাজীপুর-১ (কালিয়াকৈর ও সিটির ১ হতে ১৮ নং ওয়ার্ড) ॥ এটি জাতীয় সংসদের ১৯৪ নম্বর আসন। এ আসনে গত নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক। বর্তমানে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেল। নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী থাকলেও এ দুজনের মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে স্থানীয়দের অভিমত।
মোজাম্মেল হকের সমর্থকদের দাবি, পর পর দুবার নির্বাচিত হওয়ার পর এক যুগের বেশি সময় ধরে অসমাপ্ত থাকা সেতু ও বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক সড়ক নির্মাণ করেছেন তিনি। তার আমলেই এ আসনে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়ন কর্মকা-ে এলাকায় তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তা ছাড়া স্থানীয়দের সুখে দুঃখে সবসময় তাদের পাশে ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের এ সিনিয়র সদস্য। ফলে নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করবেন বলে তার সমর্থকরা দাবি করছেন।
আর স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম রাসেলের সমর্থকদের দাবি, এলাকায় রাসেলের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। ২০০৮ সালে এ আসনে মোজাম্মেল হক নির্বাচিত হওয়ার পর তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। অবহেলা ও নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন দলের নেতাকর্মীসহ এলাকাবাসী। ফলে তার বিরুদ্ধে সর্বত্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাসেলের জয়লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ আসনের বৈধ প্রার্থীরা হলেন- আওয়ামী লীগের আ ক ম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম রাসেল, আল আমিন (জাতীয় পার্টি), ফজলুর রহমান (ইসলামী ঐক্যজোট), তৃণমূল বিএনপির চৌধুরী ইরাদ আহমদ সিদ্দিকী, আব্দুল জব্বার সরকার (তৃণমূল বিএনপি), সফিকুল ইসলাম (তরিকত ফেডারেশন) ও মানিক সরকার (জাকের পার্টি )।
গাজীপুর-২ (সিটির ১৯ হতে ৩৮ নং ও ৪৩ হতে ৫৭ নং ওয়ার্ড এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকা) ॥ এটি জাতীয় সংসদের ১৯৫ নম্বর আসন। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের নির্বাচনী আসন এটি। নানা কারণে আসনটি গুরুত্বপূর্র্ণ। জেলা শহর ও টঙ্গীসহ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (গাসিক) অধিকাংশ এলাকা নিয়ে এ সংসদীয় আসন গঠিত। সদ্য অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের পর বিভিন্ন দুর্বল দিক চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ঘর গোছাতে ব্যস্ত। এ জন্য প্রতিদিনই সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানা কৌশলে সভা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন।
জনপ্রিয় সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার ২০০৪ সালের ৭ মে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তার বড় ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল এ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন জাহিদ আহসান রাসেল। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
তার বিরুদ্ধে লড়তে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন। ত্যাগী এই নেতাকে ইতোমধ্যেই সাবেক সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সমর্থন জানিয়েছেন বলে দাবি করছেন কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিনের সমর্থকরা। ফলে এ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সঙ্গে এ স্বতন্ত্র প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সাইফুল ইসলাম। উভয় প্রার্থীই বিজয়ের বিষয়ে আশাবাদী।
এ আসনে বৈধ প্রার্থীরা হলেন- আওয়ামী লীগের জাহিদ আহসান রাসেল, কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন (স্বতন্ত্র), সাইফুল ইসলাম (স্বতন্ত্র), জয়নাল আবেদীন (জাতীয় পার্টি), রিনা রহমান (জাকের পার্টি), কাজী হাসিবুর রহমান রাব্বী (ন্যাশনাল পিপলস পার্টি), সৈয়দ আবু দাউদ মছনবী হায়দার (তরিকত ফেডারেশন), এসএম জাহাঙ্গীর আলম (বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি), আমির হোসাইন (ইসলামী ফ্রন্ট), রেহানা আক্তার রিনা (বাংলাদেশ কংগ্রেস)
গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর এবং সদরের মির্জাপুর, ভাওয়ালগড় ও পিরুজালী ইউনিয়ন) ॥ এটি জাতীয় সংসদের ১৯৬ নম্বর আসন। আগে আসনটি শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিল। সীমানা পুনর্গঠনে বাদ পড়ে কালিয়াকৈর উপজেলা। সংসদীয় এ আসনে শ্রীপুরের সঙ্গে যুক্ত হয় গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর, ভাওয়াল গড় ও পিরুজালী ইউনিয়ন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১০টি সংসদ নির্বাচনে ছয়টিতেই জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। বাকি দুইবার বিএনপি, দুইবার জাতীয় পার্টি (জাপা) জয়লাভ করেছে। আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়নে চমক দেখিয়ে পরিবর্তন এনেছে।
এবার সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক রুমানা আলী টুসিকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে। তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত রহমত আলীর মেয়ে। রহমত আলী এ আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দলের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভিপি মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজ। তবে সবুজ এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী থাকলেও এ দুজনের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা।
এ আসনে বৈধ প্রার্থীরা হলেন আওয়ামী লীগের অধ্যাপিকা রুমানা আলী টুসি, ইকবাল হোসেন সবুজ (বর্তমান এমপি), আব্দুর রহমান (কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ), জহিরুল হক ম-ল বাচ্চু (জাসদ-ইনু), আলাউদ্দিন (জাকের পার্টি), জয়নাল আবেদীন (তরিকত ফেডারেশন), এফএম সাইফুল ইসলাম (জাপা), একে এম সাখাওয়াত হোসেন খান (স্বতন্ত্র)।
গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) ॥ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের জন্মভূমি এটি। এটি জাতীয় সংসদের ১৯৭ নম্বর আসন। ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ।
১৯৮৬ সালেও জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট। এর মধ্যে ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাজ উদ্দীন আহমদের ছেলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তানজীম আহমেদ সোহেল তাজ নির্বাচিত হন। সোহেল তাজের পদত্যাগের পর তারই বোন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সিমিন হোসেন রিমি ২০১২ সালের উপনির্বাচনে নির্বাচিত হন। এরপর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে সিমিন হোসেন রিমি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী তিনি। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি এ আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিশালী প্রার্থী না থাকায় তার জয়লাভের সম্ভাবনা রয়েছে বলে স্থানীয় ভোটারদের অভিমত।
এ আসনের বৈধ প্রার্থীরা হলেন আওয়ামী লীগের সিমিন হোসেন রিমি, জুয়েল কবির (জাকের পার্টি), সামসুল হক (স্বতন্ত্র), সামসুদ্দিন খান (জাপা), মাসুদ চৌধুরী (বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি), সারোয়ার-ই কায়নাত (বিএনএফ) ও আব্দুর রউফ খান (বাংলাদেশ কংগ্রেস পার্টি)।
গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ, সিটির ৩৯ হতে ৪২ নং ওয়ার্ড এবং সদরের বাড়িয়া ইউনিয়ন) ॥ জাতীয় সংসদের ১৯৮ নম্বর আসন এটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ ময়েজ উদ্দিন আহমেদের জন্মস্থান এটি। তার মেয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। চুমকি মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী তিনি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক এমপি আখতারউজ্জামান।
হেভিওয়েট এই প্রার্থী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ডাকসুর সাবেক ভিপি। ’৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি এ আসনে জয়ী হয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে দুই হেভিওয়েট প্রার্থী চুমকি ও আখতারউজ্জামানের মধ্যে মূল লড়াই হবে বলে স্থানীয়দের অভিমত। এ আসনের বৈধ প্রার্থীরা হলেনÑ আওয়ামী লীগের মেহের আফরোজ চুমকি, আখতারউজ্জামান (স্বতন্ত্র), এমএম নিয়াজ উদ্দিন (জাপা), তৃতীয় লিঙ্গের উর্মি (বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি), সোহেল মিয়া (গণফোরাম), আল আমিন দেওয়ান (ইসলামিক ফ্রন্ট), মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম আকন্দ (জাসদ), এএনএম মনিরুজ্জামান (জাকের পার্টি)।