ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম অস্তিত্ব সংকটে

জাহিদ হাসান মাহমুদ মিম্পা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:২১, ১০ মার্চ ২০২৩

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম অস্তিত্ব সংকটে

কেটে ফেলা হচ্ছে ফজলি আমের বাগান

আন্দোলন করে ফজলি আমের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমজনতা। কিন্তু সেই ফজলিই এখন অস্তিত্ব সংকটে। জিআই স্বীকৃত এই আমের গাছের জাত বদল করে অন্য আমচাষ বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমচাষিদের মাঝে সচেতনতা গড়ে না উঠলে ফজলি অলাভজনক অন্যান্য জাতের মতো হারিয়ে যাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তিন কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ফজলি জাতের আম। প্রথমত নতুন করে আর ফজলির বাগান গড়ে উঠছে না। দ্বিতীয়ত, পুরনো বিশাল বিশাল গাছের উৎপাদনক্ষমতা কমে গেছে। তৃতীয়ত সমতুল্য জাত আ¤্রপালির সঙ্গে বাজারমূল্যের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে ফজলি আম। শিবগঞ্জ উপজেলার সুজা আলী বলেন, আগের জনপ্রিয় ফজলি জাতটি প্রথম বাণিজ্যিক ধাক্কা খায় কয়েক বছর আগে। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে কেবল আ¤্রপালি জাতের সম্প্রসারণ শুরু হয়। আ¤্রপালি আম পাকে ফজলির সময়ই। আকার ও স্বাদে আকর্ষণীয় হওয়ায় আমপ্রেমীরা ফজলির বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেন আ¤্রপালিকে। এতেই কমে যায় ফজলি আমের কদর। চাষিরা বলছেন, কদর কমায় ফজলি আমের দামও কমেছে। মাত্র তিন বছর আগে যে ফজলি আম বিক্রি হয়েছে ৪-৫ হাজার টাকা মণ দরে। গত দুই বছর থেকে বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার টাকা মণ দরে। এতে লোকসানে পড়তে হচ্ছে চাষিদের। তাই ফজলি আমের গাছ কেটে কাটিমন জাতের আম বাগান তৈরি করছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছর ফজলি আমের চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমিতে। গাছের সংখ্যা ৫ লাখ ৯১ হাজার। গত কয়েক বছরে ফজলি জাতের কী পরিমাণ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে তার পরিসংখ্যান নেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে। তবে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বড় বড় গাছ কেটে ফেলার ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি আম গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে শিবগঞ্জ উপজেলায়। এই উপজেলাতেই ফজলির বাগান বেশি। সম্প্রতি শিবগঞ্জের শেখটোলা গ্রামে সাড়ে ১৬ বিঘা আয়তনের একটি ফজলি বাগান কেটে ফেলতে দেখা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, এই বাগানের একেকটি গাছের বয়স দেড়শ’ বছরের কম নয়। ধাইনগর, শাহবাজপুর, হাজারবিঘী, তেলকুপি এলাকাতেও বাগানের বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বাগান মালিকরা বলছেন ৪-৫ বছর আগে থেকে বাগান কাটা শুরু হলেও গত দুই বছরে দেদার কাটা হচ্ছে গাছ।
আমচাষিরা বলছেন, বড় গাছগুলো থেকে আগের মতো আর আম পাওয়া যাচ্ছে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনক্ষমতা হারিয়েছে গাছগুলো। উৎপাদন কমে যাওয়ায় হতাশা থেকেই কেটে ফেলা হচ্ছে বাগান। শিবগঞ্জের শেখটোলা গ্রামের আব্দুল জলিল ও সমশের আলী বলেন, ফজলি গাছে আমের উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়াও বড় গাছ হওয়ায় পরিচর্যা করতে সমস্যা হচ্ছে বাগানীদের। তাই জেলার আম বাণিজ্যের জন্য অশনিসংকেত হলেও চাষিরা সাময়িক লাভের কথা চিন্তা করে উজাড় করছেন বাগান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার বলেন, চাষিরা এখন আল্ট্রা হাইডেনসিটি (অতি ঘন) বাগানের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি গত এক দশকে ছোট গাছের জাতগুলোর সম্প্রসারণ হয়েছে জেলায়। চাষিরা যখন কোনো নতুন প্রযুক্তি পান তখন পুরনো প্রযুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন এটাই বাস্তবতা।
তার ভাষ্য, কৃষি বিভাগ চাষিদের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, যাতে তারা বড় গাছগুলো দেদার না কাটেন। জেলা আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, আমের নতুন নতুন জাত পুরনো জাতের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। তবে বড় বাগান কেটে ফেলে নতুন জাত সম্প্রসারণ করা ঠিক হবে না। চাষিরা এখন আগাম ও নাবী জাতের আমচাষে ঝুঁকছেন। আমের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচিত জুন মাসে যেসব আম পাঁকে সেগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন চাষিরা। অতিরিক্ত লাভের আশায় এটা করেছেন তারা। কিন্তু এটা মোটেও উচিত নয়। ফজলি জাতের আমও গাছ ছোট রেখে চাষ করা সম্ভব।

×