ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মানবতার আরেক দৃষ্টান্ত মোহাম্মদ সাধু

প্রকাশিত: ০৪:১২, ৬ মে ২০১৭

মানবতার আরেক দৃষ্টান্ত মোহাম্মদ সাধু

গাছ-গাছালির সবুজ ছায়াঘেরা নয়াচালা গ্রাম। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপারের কড্ডা গোল চত্বর থেকে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার জামতৈল রেলস্টেশন যাওয়ার পথে প্রধান সড়কের পাশেই নয়াচালা গ্রাম। এ গ্রামে অসাম্প্রদায়িক মানবতার চর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। নাম দেয়া হয়েছে লালন একাডেমি। দোচালা টিনের ঘরে মাটির মেঝেতে প্রতি বৃহস্পতিবার একাডেমিতে আসর বসে। আসরে আধ্যাত্মিক জগত নিয়ে আলোচনা হয়। আসর বন্দনায় বাংলার সাঁইজি লালনের গানে গানে ভক্তবৃন্দ মুগ্ধ হয়ে ওঠে। আসরে উপস্থিত ভক্তবৃন্দ বৃহস্পতিবারকে ‘গুরু বার’ বলে আখ্যা দিয়েছে। ইসলামী সরা শরীয়তে এক মুসলমানকে অপর মুসলমান ভাইকে সালাম দেবে এটাই বিধান। মানবতা চর্চা কেন্দ্রের ভক্তরা সে হোক হিন্দু অথবা মুসলমান এক ভক্ত অপর ভক্তকে ‘জয় গুরু’ বলে সম্বোধন করে। ঠাকুর অনুকূল বলেছিলেন ‘তুষ ঝেড়ে চাল নিতে’। কোনটা যে চাল আর কোনটা যে তুষ সেটাই তো আমরা বুঝতে পারছি না। কার কথা বিশ্বাস করব? কোনটা সত্য? কোনটা অর্ধসত্য? আর কোনটা ডাহা মিথ্যা? এই বিতর্কে যাওয়ার আগে লালন সাঁইজি বলেছেন- বিধি বৈমুখ হলো তাতে ছিল সংসার যাতনা, আশা পূর্ণ হলো না আমার মনের বাসনা।’ কী এই সংসার যাতনা? কেন সংসার ত্যাগ করে তারা মানবতার চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে। তারা সাঁইজির প্রতিটি কথাকে ‘কালাম’ আখ্যায়িত করে থাকে। নয়াচালা গ্রামের দুরু ম-লের আট সন্তানের মধ্যে মোহাম্মাদ আলী একমাত্র ছেলে সন্তান। প্রথম জীবনে মোহাম্মাদ আলী ইসলামী সরা শরীয়তের বিধিবিধান কড়াকড়ি মেনে চলেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজাসহ ধর্মীয় অনুশাসন পালন করেছেন। কিন্তু তাঁর ভেতরে এক সময় গুরু গোঁসাইয়ের ভাব উদয় হয়। তিনি ধীরে ধীরে সংসার ত্যাগী হতে থাকেন। এক সময় লালন সাঁইজির আস্তানায় যাতায়াত শুরু করেন। লালনের ধ্যান-ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি গুরু রাজ্জাকের শিষ্যত্ব লাভ করেন। তিরিশ বছর আগে প্রথমে নিজের বাড়িতে আসর বন্দনা করেন। সে সময় তাঁকে লোকে পাগল বলেছে। ধর্মহীন মানুষ হিসেবে তাকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয়েছে। মোহাম্মদ আলী করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে স্থান ত্যাগ করেছেন। তবে তিনি কারও প্রতি বিরূপ আচরণ করেননি। একেবারে আটপৌরে জীবনযাপন, কারও সাতে-পাঁচে নেই, জানা মতে তার কোন শত্রুও নেই। সেই মোহাম্মাদ আলী এখন সাধু নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। মোহাম্মদ সাধুর বাড়িতে চলছে মানবতার চর্চা। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প উপড়ে ফেলে মানবতার চর্চায় মোহাম্মদ সাধু তিরিশ বছর ধরে কাজ করছেন। মাত্র দুই বছর হলো গড়ে তুলেছেন মানবতা চর্চার একাডেমি। নাম দিয়েছেন লালন একাডেমি। মোহাম্মাদ সাধু নিজেই এই একাডেমি পরিচালনা করেন। অথচ তার নিজের কোন একাডেমিক শিক্ষা নেই। তার একাডেমিতে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই শ’রও বেশি। সর্বক্ষণিক দেখা মেলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত দুই শিষ্যের। একজন নাজমুল তুহিন। তিনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে লেখাপড়া করেছেন। অন্যজন মুক্তা। তিনি শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে ফ্যাশান এ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ফ্যাশান ডিজাইনের ওপর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। এই দুই তরুণ শিষ্য সর্বদা আগলে রেখেছেন সাধু বাবাকে। তারা দু’জনই সাধু বাবাকে ‘বাজান’ বলে সম্বোধন করেন। - বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে
×