অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪ খ্রি.) পঞ্চগীতি কবির একজন স্বনামখ্যাত কবি হিসেবে বাংলা গানের ইতিহাসে অধিষ্ঠিত আছেন। খুব বেশি গান তিনি লেখেননি, কিন্তু যে সব গান প্রকাশিত হয়েছে তা বৈশিষ্ট্য গুণে ভরপুর। সব শ্রেণির শ্রোতাদের মন আকৃষ্ট করেছে তাঁর গান। রবীন্দ্র ¯েœহধন্য অতুল পেশাজীবী হিসেবে ছিলেন ব্যারিস্টার, খুব ব্যস্ত জীবন ছিল তাঁর। তবুও বিভিন্ন পর্যায়ের গীত রচনা করে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং পঞ্চকবিদের একজন হিসেবে নিজেকে আসীন করেছেন। তাঁকে নিয়ে অনেক কাজ হওয়ার কথা, কিন্তু হয়েছে কম। মাত্র দুটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়।
অতুলপ্রসাদ সমগ্র: সুনীলময় ঘোষ, প্রথম প্রকাশ : কলিকাতা পুস্তক মেলা ১৩৯২/১৯৮৬, সাহিত্যম, কলিকাতা এবং অতুলপ্রসাদ সেন: বিশ^জিৎ ঘোষ, প্রথম প্রকাশ, বৈশাখ ১৪০১/মে ১৯৯৪, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
এ দুটি গ্রন্থকে আশ্রয় করেই সংগীত গবেষক শাহীনুর রেজা ‘অতুলপ্রসাদ সেন সংগীত অভিধান’ গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমাদের জানামতে দুই বাংলায় অতুলপ্রসাদকে নিয়ে এমন গ্রন্থ এই প্রথম। লেখক কেবল ১১৪০টি শব্দার্থ-টিকা দিয়েই বইয়ের পাতা পূর্ণ করেননি। পূর্ণ এবং অসমাপ্ত ২২৪টি গানের বর্ণানুক্রমিক তালিকা, ২৩টি গানের উৎস গল্প, বেশ কয়েকটি আলোকচিত্র, একটি হাতের লেখা ও বংশলতিকা এ গ্রন্থের অসামান্য দিক।
লেখকের ‘লেখকের-কথা’ পাঠ করলে যে কোনো পাঠক অতুলপ্রসাদের গানের তাৎপর্যতা অনুধাবন করতে পারবেন। যেমন লেখক লিখেছেন
‘অতুলপ্রসাদ সেনের গানগুলো দেবতা, প্রকৃতি, স্বদেশ, মানব ও বিবিধ পর্যায়ভুক্ত। অপ্রকাশিত বেশ কিছু গানও আছে। কোনো কোনো গানের শিরোনামে রাগ-তালের নামোল্লেখ আছে। ‘দেবতা’ পর্যায়ের গানে কৃষ্ণ, রাধা, লক্ষ্মী, শিব, মহেশ^র, সীতা, কৌশিকী, গিরিরাজ, গোরা, গোকুল, মথুরা, পা-ব, চ-ী, জাহ্নবী, ত্রিনেত্র, নারায়ণ, নিমাই, নিতাই, নটরাজ, মহেশ, রঘুনাথ, রাঘব, শ্রীকান্ত, সীতা, শূলপানী, সাবিত্রী ইত্যাদি হিন্দু-পৌরাণিক শব্দের ছড়াছড়ি। তবে অন্যান্য ধর্মের ছোঁয়া একেবারেই নাই।
গানের কথায় সাংগীতিক শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয় ডমরু, ঢোল, বীণা, বাঁশি, মোহনবীণা, মুরলী, শঙ্খ, শিঙ্গা, ভৈরব, ভূপালী, নটনারায়ণ, পঞ্চম, মল্লার, রামকেলী, ললিত, শ্রীরাগ, মালসী, মেঘ, বসন্ত, কল্যাণী, মালবী, গৌড়, সারঙ্গ, সিন্ধু প্রভৃতি।’
‘অতুলপ্রসাদ সেন সংগীত অভিধান’ গ্রন্থের জন্য প্রবন্ধ সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক-প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. মোরশেদ শফিউল হাসান একটি মূল্যবান ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। যা পাঠ করলে গ্রন্থ ও লেখক দুই সম্পর্কেই খুব উন্নত ধারণা হয়। যেমন
‘শাহীনুর রেজা আমাদের সংগীত জগতের সেই বিরল মানুষের একজন, গান গাওয়া ও শেখানোর অতিরিক্ত যিনি নিরলসভাবে সংগীত নিয়ে লেখালেখি, সংকলন-সম্পাদনা ও গবেষণাধর্মী কাজ করে আসছেন। কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব আগ্রহে ও উদ্যোগে করা এসব কাজ তাঁর পরিশ্রমশীলতা ও নিষ্ঠার পাশাপাশি দায়িত্বশীলতারও পরিচয় দেয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর ‘নজরুলের সংগীত জীবন’ বইটি পড়ে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম।