ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান

জনতার সংগ্রাম চলবেই ও সিকান্দার আবু জাফর

তাপস মজুমদার

প্রকাশিত: ০০:৫৯, ২৯ মার্চ ২০২৪

জনতার সংগ্রাম চলবেই ও সিকান্দার আবু জাফর

আবু জাফর

১৯৬৫ খিস্টাব্দে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। সাধারণ মানুষ মনে করেছিলেন আইয়ুব খান পরাজিত হবেন। কিন্তু দেখা গেল ফাতেমা জিন্নাহ পরাজিত হয়েছেন। সাধারণ মানুষ হতাশ হলেন

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলো মুক্তিকামী বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছিলো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেসব গানের মধ্যে অন্যতম গান ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই,/ আমাদের সংগ্রাম চলবেই।/ হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে/ বাঁচবার অধিকার কাড়তে/ দাস্যের নির্মোক ছাড়তে/ অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ/ চলবেই চলবেই,/ আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’ এটি সিকান্দার আবু জাফরের একটি কবিতা। পরবর্তীতে কবিতাটি গণসঙ্গীতে পরিণত হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের মুক্তিকামী বাঙালি যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলো একটি স্বাধীন ভূখ- আর লাল-সবুজের পতাকার জন্য। সেই সময় এদেশের সূর্যসন্তানদের উজ্জীবিত করতে, অনুপ্রাণিত করতে কলম ধরেছিলেন এদেশের দেশপ্রেমিক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও লেখক। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গীতিকার সিকান্দার আবু জাফর।

বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদ ও দেশিয় সংস্কৃতি চর্চার যে ধারা প্রবাহিত হয় তাঁর একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। কৃষক পরিবারের সন্তান সিকান্দার আবু জাফর একাধারে কবি, গীতিকার, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং পত্রিকার সম্পাদক।

সর্বক্ষেত্রেই তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে সাহিত্যিক হিসেবে তিনি যতটা প্রসিদ্ধ ছিলেন তার অধিক একজন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’-এর প্রবন্ধ, নিবন্ধ এবং সম্পাদকীয় ছিলো আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্দীপনামূলক। তাঁর সমস্ত রচনাতে রয়েছে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তি আর মানবতার জয়গান। সাম্প্রদায়িকতা, দুর্ভিক্ষ, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। দেশ ও সর্বসাধারণের অধিকার কল্যাণের ক্ষেত্রে তিনি একজন প্রথম সারির কলম যোদ্ধা।

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত কলকাতার ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মধ্যে দিয়ে সাংবাদিক জীবন শুরু করেছিলেন। দেশ বিভাগের পর ফিরে আসেন ঢাকাতে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিন বছর পর ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রগতিশীল সাহিত্য, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’ প্রতিষ্ঠা করেন।

এই পত্রিকাতে সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত নামকরা কবি, সাহিত্যিক, লেখকেরা লিখতেন। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৬৪ বঙ্গাব্দের (১৯৫৭ খ্রি.) ভাদ্র মাসে। প্রথম সংখ্যাটিতে লিখেছিলেন-শামসুর রাহমান, আবুল হোসেন, শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ, এ.কে নাজমুল করিম, কাজী দীন মুহম্মদ, আনিসুজ্জামান, কামরুল হাসান, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, কাজী মোতাহার হোসেন, আব্দুল গণি হাজারী ও চাকলাদার মাহবুব আলম।

এমনিভাবে প্রথিতযশা লেখক ও সমৃদ্ধশালী লেখার সমন্বয়ে প্রকাশিত হতো প্রতিটি সংখ্যা। পত্রিকাটির প্রচ্ছদশিল্পীরা ছিলেন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, রশীদ চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী, মুকতাদির ও নিতুন কু-ু। ‘সমকাল’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই ‘সমকাল’ পত্রিকাটিকে তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণের মুখপাত্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রগতিশীল মুক্ত সাহিত্য ধারার বিকাশ, আন্দোলন ও নতুন নতুন লেখক সৃষ্টিতে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন তিনি। তাঁর হাতে অনেক তরুণ তৈরি হয়েছেন প্রগতিশীল চিন্তার লেখক, কবি কিংবা সাহিত্যিক হিসেবে। তাঁর নিজের লেখা কবিতাও প্রকাশিত হতো ‘সমকাল’ পত্রিকাতে। বিপ্লবকামী কবি সিকান্দার আবু জাফরের রচিত গান, কবিতাগুলো শুধু বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে নয় বাঙালির সবধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ছিলো প্রাসঙ্গিক।

তিনি বাঙালির জাতিসত্তার সকল মুক্তি সংগ্রামেই দেশের সর্বশ্রেণির মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন। একজন সাহসী ও দেশপ্রেমিক কলম যোদ্ধা হিসেবে সময়ের প্রয়োজনে তিনি ছিলেন সোচ্চার। যে কারণেই তিনি রচনা করতে পেরেছিলেন-‘বাংলা ছাড়ো’-এর মতো কবিতা। ৭ মার্চ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতাটি। কবিতাটিতে সবুজ-শ্যামল আমাদের প্রিয় বাংলাকে দখল করতে চাওয়া পাকিস্তানী দানবদের প্রতি গণহুঙ্কারের প্রতিধ্বনি তুলেছিলেন।

যেখানে তিনি বলেছেন-‘রক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে-যাওয়া আমার বছরগুলো/ আজকে যখন হাতের মুঠোয়/ কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী ছুরি,/ কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে/ কেউটে সাপের ঝাঁপি!/ আমার হাতেই নিলাম আমার/ নির্ভরতার চাবি,/ তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া/ তুমি বাংলা ছাড়ো।’
১৯৬৫ খিস্টাব্দে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। সাধারণ মানুষ মনে করেছিলো আইয়ুব খান পরাজিত হবেন। কিন্তু দেখা গেল ফাতেমা জিন্নাহ পরাজিত হয়েছেন। সাধারণ মানুষ হতাশ হলেন। তারপর ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় সিকান্দার আবু জাফর-এর ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ কবিতাটি ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হলো।

এই কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান কামাল লোহানী। কবিতাটি নিয়ে তিনি ছুটে যান গণসঙ্গীত শিল্পী ও সুরকার শেখ লুৎফর রহমানের নিকট তাঁর পুরানো ঢাকার পাতলা খান লেনের বাড়িতে। কবিতাটি দেখে প্রথমে শেখ লুৎফর রহমান খুবভাবে রেগে গেলেন। তিনি বললেন-‘এত খটমট শব্দে তৈরি কবিতা দিয়ে কি গান হয়?’—ডিকশনারি নিয়ে আয় তারপর সুর করবো।’

তখন কামাল লোহানী কবিতাটি পুরো আবৃত্তি করে শোনালেন। শেখ লুৎফর রহমান শুনলেন এবং গম্ভীর হয়ে গেলেন। হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন, ধীরে ধীরে কবিতাটিতে সুরারোপ করলেন। ঠিক হলো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের বার্ষিক সম্মেলনে গানটি গাওয়া হবে। কবিতার ¯্রষ্টা সিকান্দার আবু জাফরকে নিমন্ত্রণ জানালো হলো। নির্দিষ্ট দিনে গানটি পরিবেশিত হলো। পরদিন ফোনে কবির কাছে জানতে চাওয়া হলো।

সিকান্দার আবু জাফর বললেন-‘গানটি তার একেবারেই ভালো লাগেনি। এটা কে সুর করেছে?’ এমন উদ্দীপনামূলক সুর কেন তাঁর ভালো লাগলো না তা বুঝতে পারলেন না কামাল লোহানী। তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঠিক তার পরদিন সিকান্দার আবু জাফর শেখ লুৎফর রহমানকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে অসাধারণ সুরের জন্য অনেক প্রশংসা করলেন। অবাক হলেন কামাল লোহানী। 
সিকান্দার আবু জাফরের লেখাতে যুগ যন্ত্রণা বলিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে। একজন সত্যিকার দেশ প্রেমিক হিসেবে তিনি ছিলেন আস্থা ও বিশ^াসের প্রতীক। তাঁর রচিত নাটক সিরাজদৌল্লা, মহাকবি আলাওল যেমন নাটক অথবা যাত্রাপ্রেমিক মানুষের কাছে সমাদৃত, তেমনিভাবে সমাদৃত তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মাটি আর অশ্রু’ ‘পুরবী’ ‘নতুন সকাল’, কিশোর উপন্যাস ‘জয়ের পথে’, গল্পগ্রন্থ ‘মতি আর অশ্রু’, অনুবাদ ‘রুবাইয়ৎ ওমর খৈয়াম’ প্রভৃতি। তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রকৃতি ও মানুষ। সিকান্দার আবু জাফর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট ঢাকার পি.জি হাসপাতালে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, জামিরা কলেজ

×