ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ ডামি

মনির বেলাল

প্রকাশিত: ২১:৪২, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

গল্প ॥ ডামি

ঘরের দরজায় তালা টিপে দিলো মাসুদা

মাসুদার মনে পড়ল, মোবাইলে ম্যাডাম তাকে বলেছিলেন, তোর জন্য একটা গুড নিউজ আছে! সে তাফসীর মাস্টারকে বলল, ‘জি, স্যার, বলেছে... কিন্তু কিছুই খুলে বলেনি, ‘আচ্ছা, কোনো অসুবিধা নেই! আমরা তোমাকে সব খুলে বলব... সবারই নির্বাচন করার অধিকার আছে। সে বিশ^সেরা অলরাউন্টার সাকিব হোক কিংবা গুচ্ছগ্রামের তুমি মাসুদা... কোনো অসুবিধা নেই! কেউ নির্বাচনের ট্রেন মিস করলে, সেটা তাদের ব্যাপার! ওরা ভোট বর্জন করুক, আমরা ভোট অর্জন করব, ইনশাআল্লাহ! ওকে... মাসুদা, তুমি এখন যাও... আমরা আসছি

ঘরের দরজায় তালা টিপে দিলো মাসুদা, কুট করে একটা ধাতব শব্দ হলো। আর তখনি তার মনে পড়ল মুরগির বাচ্চাগুলোর কথা। ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা। বারান্দার এককোণে, পুরনো একটা ওড়না টেনে তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে একটা ঘর... দশটার মধ্যে তিনটা মরে গেছে। এই বাচ্চাগুলো ছাড়া আর কোনো কিছু পুষে না মাসুদা। এসবের ওপর থেকে আসলে তার বিশ^াস উঠে গেছে, পর পর দুটা বুড়ি বকরি মরে গেল। বোধহয় অযতেœই মরে গেছে। সারাদিন সে বাড়িতে থাকে না।

অন্যকে বলে-কয়ে কি সব হয়? নিজের বকরিগুলোর সঙ্গে মাসুদার বকরিটাও দেখভাল করত ফেলানির মা, এজন্য মাসুদা কী দেয়নি তাকেÑ ফলমূল, বিস্কুট, মুড়ি-চানাচুর... রান্না তরকারিও দিয়েছে। কিন্তু না, তবু তার মন পাওয়া যায়নি। তার বকরিটাকে সে দেখেছে সতীনের মেয়ের চোখে... তার প্রমাণ মাসুদা পেয়েছে কয়েকবার। যাই হোক, বকরি আর সে পুষবে না। ২০ টাকা কেজি আউড় আর গমের ভুষির কেজিও ৫৫-৬০।

 জিনিসপত্রের এতো দাম! তাও সবগুলোই তাকে রেখে যেতে হয় অন্য মানুষের হাওলায়! তবে মুরগির এ বাচ্চাগুলোর ঝামেলা কম। সকালে একবার দানা-পানি দিয়ে গেলেই হলো, চলল সারাদিন। তাছাড়া এসব মুরগির বাচ্চা হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছে বলে, নেওয়া। মাথায় করে বেচে বেড়াচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। সবাই নিচ্ছে, তাই সে-ও নিয়েছে। গুচ্ছগ্রামের নতুন-পুরাতন সেড মিলে এখন প্রায় ৩শ-সাড়ে ৩শ পরিবারের বাস। এমন কোনো ঘর বোধহয় পাওয়া যাবে না যে ঘরে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা নেই! বাচ্চাগুলোকে দানা-পানি দিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এলো।
এমনিতে দেরি হয়ে গেছে আজ। তিন বাড়ির ধোয়া-মোছা, কাটা-বাছার সব দায়িত্ব তার কাঁধে। এরইমধ্যে আবার টুকিটাকি বাজার-সওদা তাকেই করতে হয়। আজকেই যেমন তাকে ঘরে পোষা একটা ব্রয়লার আর একপিস ব্রকোলি কিনতে হবেÑ এগুলো প্রথম বাড়ির অর্ডার। এই বাড়ির বাজার-ঘাট সব তাকেই করা লাগে। সাহেব থাকেন না।

এই ম্যাডাম সাহেবের দ্বিতীয় পক্ষ। সাহেব সপ্তাহে একদিন-আধদিনের জন্য আসেন। আবার চলে যান। ছোট্ট একটা মেয়েকে নিয়ে ম্যাডাম এখানে থাকেন। বাজার-সওদার এই কাজগুলো বাড়তি ঝামেলার হলেও, তার কখনো খারাপ লাগেনি।
রাস্তা বড় আর উঁচু হওয়ার কারণে মাসুদাদের ঘরগুলো যেন তলিয়ে গেছে। আগে ওই ঘরগুলো রাস্তার বরাবর ছিল। এখন তাদের ঘরের চৌকিটা আর এ রাস্তার মেঝে এক বরাবর। রাতে ঘুমের ঘোরে কখনো কখনো মনে হয় বাস-ট্রাক-অটোগুলো যেন কান ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। অনেকটা হামাগুড়ি দিয়েই রাস্তার ওপর উঠে দাঁড়াল মাসুদা। তাকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে এলো রফিক। যেন তার অপেক্ষাতেই ছিল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘ক্যা রে, ট্যাকা কবে দিবি?’
রফিকের প্রশ্নেবিরক্ত হলো মাসুদা। মুহূর্ত বিলম্ব না করে মাসুদাওরফিককে ছুঁড়ে দিল সিডর গতির পাল্টাপ্রশ্ন, ‘ক্যা, ট্যাকা এহনো শোধ হয়নি?’
হাসির ঝলক ফুটে উঠলো রফিকের ঠোঁটের কোণে... তাচ্ছিল্যের সেই হাসি যেন শুষে নিল মাসুদার ক্ষোভের সবটুকু ঝাঁজ। কণ্ঠে আরও কয়েক ফোঁটা তাচ্ছিল্যের বিষ মাখিয়ে রফিক বলল, ‘তোর রেট এতো বেশি? বাজার-ঘাট তো করিস, কিন্তু বাজার না জানার মতোন কথা বুলিস ক্যা? হাজি মার্কেটের দোতলায় কমলার কেজি ৩০০ ট্যাকা রে...! হাতে নিলেই কোয়াগুলো খসে এসে হাতে পড়ে।

কী অদ্ভুত মিষ্টি সেই কমলা! তাহালে, তার চাইতেও বেশি দামে ক্যান মানুষ তেঁতুল খাইতে যাবে? আপনেই বুলেন...? যাক অত ঝামেলার দরকার নাই... আপনার বিপদের সময় আমি আপনাকে ট্যাকা ধার দিয়েছি। ভুল করেছি। আপনে ৯শ ট্যাকা, না... ১ হাজার ট্যাকাই কাটি রাখি, বাকি ট্যাকা আপনে ফেরত দেন। কবে দেবেন, বলেন?

আমার মোবাইল খোলা আছে... এই কথা বলে পথ ছেড়ে দাঁড়াল রফিক। মাসুদাও আর কোনো কথা বলল না। একটা অটোরিকশার মধ্যে উঠে বসল। অটোরিকশার গতিতে বাতাসের ঢেউ উঠেছে। নভেম্বর মাস। গরমের ভাবটা আর নেই! তবু মাথা থেকে ওড়নার ঘোমটাটা ফেলে দিল মাসুদা। 
মাসুদার মনে পড়ছে, পাড়ার উঠতি বয়সী এমন কোনো ছেলে ছিল না যে তাকে পছন্দ করেনি। কাঁচা বয়সের কথা বাদ, এই গত পরশু রাতেও... এই রফিক নিজেই তাকে নায়িকা বুবলির সঙ্গে তুলনা করছিল। আর সেই সময় শহর থেকে সিটি গোল্ডের চুড়ি বা লাল রঙের লিপস্টিক এনে কতজন তাকে সাজাতে চেয়েছে। কিন্তু মরতে সে সাজাতে চেয়েছিল গহরকে... এখন সে ভুবননগরের সেডে থাকে।

ওই সেডে সে নতুন একটা ঘর পেয়েছে। মুজিববর্ষের পাকাঘর। একখানা পাকা ঘরের সাধ ছিল মাসুদারও, কিন্তু তাকে থাকতে হচ্ছে টিনের চাল, টিনের বেড়ার সেই ঘরেই। গহরের পাকা ঘরে এখন অন্য একজন উঠেছে। সেখানে মাসুদার কোনো অধিকার নেই। গহর ইয়াবা খায়। চুরি করে। হাটের ইজারাদারের হয়ে ভাড়া খাটে। আর কোনোভাবেই ট্যাবলেটের (ইয়াবা) টাকা জোগাড় না হলে, সে বাসগাড়িতে ভিক্ষাও করে। বাবা-মায়ের অসুস্থতার একটা গল্প ফাঁদে এবং সেই গল্প শুনিয়ে সে মানুষের কাছে সাহায্য চায়... একবার জেলেও গিয়েছিল।

কতজনের হাতে-পায়ে ধরে, ধারকর্জ করে মাসুদা নিজেই তাকে ছাড়িয়েছিল। তখনি তাকে হাত পাততে হয়েছিল এই রফিকের কাছেও। রফিককে একদম পছন্দ করে না মাসুদা। সে আসলে ট্রাকের হেলপার, ইয়াবার কারবারও করে মাঝে মাঝে... এখন হরতাল-অবরোধ চলছে। এ কারণে রফিক সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকে। হরতাল-অবরোধ নিয়ে মাসুদার এমনিতে কোনো মাথাব্যথা নেই! কারণ বাস-ট্রাক না চললেও অটোরিকশা-ভ্যানগাড়িগুলো চলছে নির্বিঘেœ... সে অটোরিকশার যাত্রী।

তবে এসব ছুটে গেলে তার একটু ভালো হয়। রফিক আগের মতো আবারও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়...! সে যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে। তার সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে গহর। মাসুদার বাবা-মা আছে, আবার নেই! ক্যাপ্টেন মনসুর পার্কের পাশে কালো পলিথিনে মোড়ানো এক ঝুপড়িতে তারা থাকে। দুখ-ধান্দা করে খায়। এই গুচ্ছগ্রামেও তাদের নামে একটা ঘর আছে। কিন্তু তারা বলে, ‘এখানে আসলে তারা খাবে কী?

ওখানেই তারা ভালো আছে। ওখানে অনেকে তাদের চেনে...। অটো এগিয়ে চলেছে... সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাসুদার ভাবনাও বিস্তৃত হচ্ছে শাখা-প্রশাখায়, পত্রপল্লবে। এরইমধ্যে তার হাতের মোবাইলটি বেজে উঠলো, ‘কই রে... মাসুদা! তাড়াতাড়ি আয়... কোথায় তুই? তোর জন্য একটা গুড নিউজ আছে। তাড়াতাড়ি আয়...!’
মাসুদা নিজের অবস্থান জানিয়ে ফোনটা রেখে দিল। গুড নিউজটা কী তা সে জানে না। হয়তো সাহেব এসেছে আর তার জন্য একটা কম্বল এনেছেÑ সামনে শীত। না, অন্যকিছু কে জানে? তবে তার ম্যাডামের ‘এই ভরসা’ মুছে দিল তার বুকের ভেতরে জমা যতগ্লানি... এখনকার বাতাসটুকু যেন জমজমের পানি। শ্রদ্ধায় সে নিজের মাথার ওপর ওড়নার ঘোমটাটা টেনে নিল। 
অটোরিকশা থেকে নেমে, কাপড়পট্টির ভেতর দিয়ে গেলে মুরগিহাটা কাছে। মনে মনে সে ভীষণ তাড়াহুড়ো করছে, সত্যি। কিন্তু সে ওই পথে গেল না। কাপড়পট্টির একজন দোকানদার তার কাছে কিছু টাকা পাবে। মুরব্বি মানুষ। টাকা তিনি চান না। তবে দেখা হলেই তিনি মাসুদাকে সালাম এবং বিনীতিস্বরে জিজ্ঞেস করেন, ‘মা, কেমন আছো?’ এমন আচরণ হয়তো তিনি আরও অনেকের সঙ্গেই করেন।

তবে এতে মাসুদা খুব লজ্জা পায়। সে খুব চেষ্টা করছে, যেন দ্রুত তার ওই টাকাগুলো শোধ দেওয়া যায়। কিন্তু গহরের কিস্তির ঋণ-ই তাকে কোনো দিকে পা ফেলতে দিচ্ছে না। উপায় নেই! ঋণগুলো তার নামে তোলা...! সময়মতো কিস্তির টাকা না দিতে পারলে কেন্দ্রপ্রধান সাবিয়া তার কলিজা ছিঁড়ে খাবে। তার মুখের ভাষা হিজড়াদের চাইতেও খারাপ।
মুরগিহাটাতে এখন তেমন ভিড় নেই। হাটের দিন ছাড়া এখানে আসলে তেমন ভিড় থাকেও না। মুরগিহাটার মধ্যে ঢুকতেই মুরগিওয়ালারা একে একে সবাই  হৈচৈ করে উঠলো, ‘আপা, কী লাগবে? আসেন। আপা, আপনি বোনির কাস্টমার... আপা। কেউ কেউ তাকে ম্যাডামও ডাকছে। এসব ডাক শুনে মাসুদা প্রথম প্রথম গলে যেত একেবারে। এখন সে অনেকটাই শক্ত হয়েছে। সামলে কথা বলে। দরদাম করে।

ঘরে পোষা ব্রয়লারগুলোকে দেখলেই চেনা যায়। ফার্মের মুরগির মতো অতোটা নাদুস-নুদুস হয় না। পোক্ত শরীর, সাইজেও বড় আর পরিচ্ছন্ন। তাদেরকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে মাসুদার দুচোখ। অবশ্য তাদেরকে আলাদা করে খুঁজে না বেড়ালেও চলে। কারণ মুরগি বিক্রেতারাই তাদেরকে আলাদা খাঁচায় রাখেÑ আলাদা দাম হাঁকে। মাসুদা যে মুরগিটা পছন্দ করল তার ওজন ৪ কেজি ৭শ, মোরগ।

তিনজনে ধরে মুরগিটার গলায় ছুরি চালিয়ে দিল, দ্বিধাহীন। দোয়া-কালেমা কিছুই পড়ল না, বিষয়টা খারাপ লাগল মাসুদারÑ তবে সে কিছুই বলল না। পাশ থেকে দাড়িওয়ালা একজন মুরব্বি খেঁকিয়ে উঠল, ‘আল্লা-রসুলের নামও নিলা না তোমরা, গলায় ছুরি চালাইয়া দিলা। তোমাদের ঘর তো পুবমুখোÑ তা তো আর ঘুরাইতে পারবা না। তবে মুখে আল্লা-খোদার নাম নিতে পারতে... মুসলমানের ছেলে বাহ তোমরা!’

এ প্রশ্নটা মাসুদারও কিন্তু সে প্রশ্নটা করতে পারেনি। তার হয়ে এই মুরব্বি প্রশ্নটা করেছে। মনে মনে সে এই মুরব্বি চাচাকে সালাম জানাল এবং ভাবল, এইবার বিক্রেতারা নিশ্চয় নিজেদের দোষ স্বীকার করবে এবং নতশিরে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু না, তারা জবাব দিল উচ্চকণ্ঠে, ‘চাচা, শোনেন তাহালে, দোয়া-কালেমা, পশু যবহের আড়াই পোচ... এগুলো আমরাও জানি। কিছু মনে করবেন না। মাঝে মাঝে আমরা বিপদে পড়ি, এই দিন পনের আগে- আপনার মতোনই শার্ট-সুট পরা একজনের মুরগি কালেমা পড়ে জবাই করাতে তিনি মুরগিটা নেননি।

তার মুখেও দাড়ি ছিল। তাহালে, আমরা কিভাবে জানব যে... তিনি রামভক্ত হিন্দু। আমি, আমার মালিক সবাই বললাম, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথাই শুনলেন না। ওই মুরগিটা তিনি নিলেনই না। শেষ পর্যন্ত, তাকে অন্য মুরগি দিতে হয়েছিল।
ওই মুরব্বি চাচার মনে আর ক্ষোভ থাকল কিনা মাসুদা জানে না। তবে সে ওই মুরগি বিক্রেতাকে ক্ষমা করে দিল। কারণ তারা অসহায়! তারা কোনদিকে যাবে?
প্লেন টিনেরচুঙ্গার মধ্যে পড়ে আছে তার মুরগিটা। এখনো পা দুটা নাড়াচ্ছে। বাড়িতে ছেড়ে পোষা মুরগি তো, তাই জান বের হতে সময় লাগছে। এ চুঙ্গা তিনটা পুবের খাঁচা ঘেঁষে বসানো। কিন্তু এ চুঙ্গা আর খাঁচার ব্যবধান জীবন এবং মরণের... বিক্রেতা যাকে খুশি তুলে নিচ্ছে আর গলা কেটে রাখছে চুঙ্গার ভেতর।

অথচ ওদিকে লেশমাত্র ভ্রƒক্ষেপ নেই খাঁচার ভেতরের কারও। তারা নিশ্চিন্তে গ্রহণ করছে দানা-পানি। গলা ছেড়ে হাঁকও দিচ্ছে কেউ কেউ। হঠাৎ গলাকাটা মুরগির ওই পা দুটা দেখে আঁতকে উঠলো মাসুদা। ওই পা দুটার মধ্যে সে খুঁজে পেল স্বয়ং তার অসহায় পা দুখানা। গহর, রফিক... ওরা যেন তখন হয়ে উঠে জন্তু-জানোয়ার। মাসুদার কষ্টে তাদের হিং¯্রতা যেন আরও বাড়ে। তখন দম খুঁজে পায় না মাসুদা। যেমন সে দম পায় না নিজের জন্য বাজারে এসেও। কারেন্ট-কেরাসিন সবকিছুর দাম হোলা ব্যাঙের মতোন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রতিদিন।

যেন বর্ষার নতুন পানি পেয়েছে ওরা... জোগাড় করে নিচ্ছে সারা বছরের আহার। আলুর কেজি ৭০ টাকা। পোকায় খাওয়া বেগুনও ৫০ টাকার নিচে নাই। ধান উঠছে, টিভিতে চলছে নবান্ন উৎসবের অনুষ্ঠান... এদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চালের দাম। মুরগিওয়ালা বলল, ‘আপা, আপনার দামই রাখছি, আপনি বোনির কাস্টমার... ১১শ ৭৫ টাকা হয়, আপনি ১১শ ৭০ টাকা দেন।’
মাসুদা তার হাতে টাকাগুলো বুঝিয়ে দিলে সে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কাপড়ের ব্যাগের মধ্যে রাখল। মাসুদা হাঁটতে লাগল। ভাগ্যিস, তার এই মালিক ফার্মের মুরগির চামড়া-ভুনা খায় না। মুরগির চামড়া পরিষ্কার করা কঠিন ও সময়ের কাজ। মুরগির চামড়া, নাড়ি-ভুঁড়ি আর পা দুটা... ওরা রেখে দিয়েছে। কিছুদিন আগেও এগুলো মাগুর এবং পাঙ্গাস মাছের খাবার ছিল। এখন মানুষ কিনে খায়।
মুরগি, মাছ এবং কসাইপট্টি লাগালাগি। মাছপট্টির ওপারে মাসুদার গন্তব্য। হাটবারে মাছপট্টিতে গিজগিজ করে মানুষ। এপার থেকে ওপারে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। গতকাল হাটবার ছিল। আজ এ পট্টি একেবারে ফাঁকা। তবু মাসুদার এপথটুকু পার হতেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হাটের দিনের যত উচ্ছিষ্ট সব এনে বোঝাই করা হয় পুবের দিকের এই গর্তে। শতবর্ষী পুকুরটার আর এটুকুই জিন্দা আছে।

মাছের পানি, গরু-খাসির রক্ত এবং মানুষের প্র¯্রাব থেকে তীব্র গন্ধ ছুটেছে এখন। রোদে দুর্গন্ধের তীব্রতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এসব কিছু উপেক্ষা করে কুকুরটা হঠাৎ তেড়ে যাচ্ছে কাকগুলোকে... তখন কাকের দল একটু উড়ে আবারও নেমে আসছে নিচে। মাটি এবং উচ্ছিষ্টের কাছাকাছি। ওদেরকে দেখে মাসুদা ভাবলো, ভাগ্যিস সে কাক বা কুকুর হয়ে জন্মায়নি। এ জন্য সে মনে মনে খোদার শোকর করল।

গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠছে। নাকের ওড়নার আঁচল নাক চেপে লম্বা লম্বা কদমে সে হাঁটতে লাগল। এই রাস্তাটুকু পার হতে পারলেই এখন বাঁচে। অথচ এরইমধ্যে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে তিনজন। এ বাতাসের ¯্রােতকি তবে তাদের কাছে গিয়ে বাঁক নিয়েছে অন্যদিকে? না, তারাও ওই কুকুর আর ওই কাকগুলোর মতোন..., এ কথা ভেবেই মনে মনে মাসুদা বলে উঠলো, ‘তওবা, তওবা... মানুষকে ভাগাড়ের কাক-কুকুরের সঙ্গে তুলনা করা চলে? ছি ছি...!’ এজন্য খোদার দরবারে সে মাফও চাইলো, তৎক্ষণাৎ।

তিনজনের একজন আবার সিগারেটের সঙ্গে সঙ্গে পানও চিবাচ্ছে। এদের মধ্যে একজনকে সে চেনেÑ তাফসীর মাস্টার, ভোকেশনালের শিক্ষক। তিনি রাজনীতিও করেন। রাজনীতি এবং ব্যবসা তিনি পৈত্রিকসূত্রে পেয়েছেন। মাসুদা, তাদের বাড়িতেও কাজ করেছে। দুবার মিলে অন্তত ১৫ মাস। মাসুদা তাকে সালাম দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় তাফসীর মাস্টার নিজেই এগিয়ে এলেন মাসুদার দিকে... বললেন, ‘তোমার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছি।’
তাফসীর মাস্টার সাধারণত মাসুদাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেন। আজকে হঠাৎ ‘তুমি’ বলছেন... হয়তো লোকজনের সামনে, তাই এমন ভাবলো মাসুদা। তাফসীর মাস্টার বলতে লাগলেন, ‘ভাই, এ মেয়েটার কথাই আমি আপনাকে বলেছিলাম। লম্বা-চওড়া আছে। গলার স্বরও ভরাট। সাহসী মেয়ে... কথা বলতে পারে। যেহেতু সে এলিট ফ্যামিলিগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করছে... তাই উঁচু-নিচু সব পর্যায়ের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারবে। আর ও লেখাপড়াও জানে, স্যার। ম্যাট্রিক দেননি!’
মাসুদা কিছুই বুঝতে পারছে না। মাস্টারের সঙ্গের দুজন তার কয়েকটি ছবি তুলল। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদা। কী হচ্ছে এসব? তাফসীর মাস্টার সম্পর্কেও মাসুদার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। তখন ভোর থেকে রাত অবধি তার বাড়িতেই কাজ করত মাসুদা। এ কারণেই তাফসীর মাস্টার সুযোগ পেয়েছে বেশি। তার ‘দুনিয়া-খাব’ ভাব, কিন্তু আগুন-ই জ্বলে না। আর কখনো কখনো জ্বললেওÑ দপ্ করে উঠেই ফুরত! নিজের গরজেই হোক বা মাস্টারের... তখন মাসুদাও তাকে সহায়তা করতে চেয়েছে। কত কৌশল করেছে... কিন্তু না! গহর বা রফিকের মতো নন তিনি।
তাফসীর মাস্টার বললেন, ‘এবার তুমি আমাদের এমপি ক্যান্ডিডেট। অনেক ভেবে, আমরা তোমাকে সিলেক্ট করেছি। তুমি ডামি ক্যান্ডিডেট... তোমার কোনো কাজ নেই! আবার আছেও... সব তোমাকে বুঝিয়ে বলব পরে। তোমার ম্যাডাম... তোমার ব্যাপারেই টিভিতে কথা বলছে। সকালে তোমার ম্যাডাম ফোনে তোমাকে কোনোকিছু বলেনি...?

মাসুদার মনে পড়ল, মোবাইলে ম্যাডাম তাকে বলেছিলেন, তোর জন্য একটা গুড নিউজ আছে! সে তাফসীর মাস্টারকে বলল, ‘জি, স্যার, বলেছে... কিন্তু কিছুই খুলে বলেনি, ‘আচ্ছা, কোনো অসুবিধা নেই! আমরা তোমাকে সব খুলে বলব... সবারএ নির্বাচন করার অধিকার আছে। সে বিশ^সেরা অলরাউন্টার সাকিব হোক কিংবা গুচ্ছগ্রামের তুমি মাসুদা... কোনো অসুবিধা নেই! কেউ নির্বাচনের ট্রেন মিস করলে, সেটা তাদের ব্যাপার! ওরা ভোট বর্জন করুক, আমরা ভোট অর্জন করব, ইনশাআল্লাহ! ওকে... মাসুদা, তুমি এখন যাও... আমরা আসছি। চিন্তার কিছু নেই। তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ, পোস্টার-ব্যানার, ফেস্টুন, মিডিয়া কভারেজ... সব দায়িত্ব আমাদের... তুমি শুধু দাঁড়ায়ে থাকবা আর তোমাকে দেখে কেন্দ্রে ভোটার আসবে। এবার এটাই আমাদের কাজ, এটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। বিনিময়ে তুমি পাবে বিপুল সম্মান আর আপাতত নগদ দুই লাখ টাকা।
তাফসীর মাস্টারকে তার বিশ^াস নেই! শরীর ভেঙে যেতেই সে কুত্তার মতো ব্যবহার করে। সমস্ত দোষ সে মাসুদাকে দেয়। তবে ওই দুলাখ টাকা তাকে দেয়া হবে... এই কথাটি শুনে চিকচিক করে উঠলো তার দুচোখ। যেন কারেন্ট খেলে যাচ্ছে তার সমস্ত শরীরে। মাসুদার এখনকার অনুভূতিটুকু কেবলি অনুভব করাই সম্ভব! ব্যাখ্যার সাধ্য কোনো সাধকের নেই! এখন সে কী বলবে? কী করবে... পা ধরে সালাম করবে? না, অন্যকিছু... কিছুই সে বুঝতে পারছে না। তবু সে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, ‘ডামি ক্যান্ডিডেট’ মানে কী?’
তাফসীর মাস্টার ছাড়া, বাকি দুইজনের মধ্য থেকে একজন জবাব দিল, ‘গুড, সাহসী মেয়ে। ‘ডামি ক্যান্ডিডেট’- এর মানে অনেক... সহজ কথায়, ‘খোজা পুরুষ’ অর্থাৎ যে পুরুষের পুরুষাঙ্গে প্র¯্রাব করা ছাড়া আর কোনো কাজ চলে না। 
এ কথা শুনে আড়চোখে তাফসীর মাস্টারের দিকে তাকালো মাসুদা। আর তার চোখে চোখ পড়তেই বে-মুখ হলেন মাস্টার।

×