ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কাবুলিওয়ালা ॥ পিতৃ স্নেহের করুণ রসে সিক্ত

মামুন মিসবাহ

প্রকাশিত: ২২:০৯, ২ মে ২০২৪

কাবুলিওয়ালা ॥ পিতৃ স্নেহের করুণ রসে সিক্ত

কাবুলিওয়ালা

‘কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা।
 তোমার ও ঝুলির ভিতর কী।’
কাবুলিওয়ালা গল্পটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনবদ্য একটি সৃষ্টি। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হওয়া এই ছোট গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলে ধরেছেন সে সময়ের কিছু বাস্তব চিত্র। পরিবেশ, সময়, অনুভূতি; ভালোবাসা, মায়া-টান সবকিছু মিলিয়ে ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটি একটি চমৎকার চিত্রায়ন। যে গল্পের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে ভিন্ন এক স্বাদ। কিছু ভিন্ন অভিজ্ঞতা। 

॥ এক ॥
পাঠকনন্দিত এই গল্পের প্রধান চরিত্রের একজন হলেন কাবুলিওয়ালা। সময় চলে গিয়েছে। যুগ পালটেছে। এসেছে নতুন যুগ। গল্পগুলো নতুন পরিবেশে নতুন সময়ের কথায় জেগেছে। জেগেছে নতুন লেখকদের হাত ধরে নতুন আঙ্গিকে। তবে পাঠকের হৃদয়ে এখনো সেই কাবুলিওয়ালার বাস।
গল্পের বর্ণনায় কাবুলিওয়ালা, ‘ময়লা ঢিলা কাপড় পরা, পাগড়ি মাথায়, ঝুলি ঘাড়ে, হাতে গোটা দুই-চার আঙুরের বাক্স, এক লম্বা কাবুলিওয়ালা মৃদুমন্দ গমনে পথ দিয়া যাইতেছিল’ গল্পের অন্য স্থানে, ‘অন্ধকারে ঘরের কোণে সেই ঢিলেঢালা-জামা-পায়জামা পরা সেই ঝোলাঝুলিওয়ালা লম্বা লোকটাকে দেখিলে বাস্তবিক হঠাৎ মনের ভিতরে একটা আশঙ্কা উপস্থিত হয়।’
কখনো কখনো লেখক তার পরিচয় দিতে গিয়ে তাকে ‘কাবুলদেশের’ বলে পরিচয় করান। এসব কিছুর দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়, কাবুলিওয়ালা ছিলেন কাবুলের। কাবুল মূলত আফগানিস্তানের একটি শহরের নাম। সেই শহরকে কেন্দ্র করে তার নাম হয় কাবুলিওয়ালা। মূলত তার নাম ছিল রহমত। যাকে গল্পে বারবার বলা হয়েছে ‘কাবুলিওয়ালা রহমত’। সে-সময় ভারত উপমহাদেশ ছিল সুযোগ ও সীমাহীন ধন-সম্পদে ভরপুর।

পার্শ্ববর্তী দেশগুলোসহ বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ভারত উপমহাদেশে আসত নিজের ভাগ্য বদলানোর আশায়। রহমত তাদেরই একজন ছিলেন। আফগানিস্তানের কাবুল শহর থেকে এসে কলকাতায় পাড়ি জমান। তিনি ছিলেন মূলত একজন ফলবিক্রেতা। গাঁও-গেরামে ঘুরে ঘুরে ফল বিক্রি করতেন।

॥ দুই ॥
এই গল্পের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র মিনি। যে খুব সুন্দর করে কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা বলে ডাকত রহমতকে। মিনি গল্পে লেখকচরিত্রের পাঁচ বছরের মেয়ে। তার সম্পর্কে লেখকের বর্ণনা, ‘আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোট মেয়ে এক দ- কথা না কহিয়া থকিতে পারে না। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসর কাল ব্যয় করিয়াছিল, তাহার পর হইতে যতক্ষণ জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করে না।

তাহার মা অনেক সময় ধমক দিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দেয়, কিন্তু আমি তাহা পারি না। মিনি চুপ করিয়া থাকিলে এমনি অস্বাভাবিক দেখিতে হয় যে, সে আমার বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। এ জন্য আমার সঙ্গে তাহার কথোপকথনটা কিছু উৎসাহের সহিত চলে।’

মিনি বেশি কথা বলে, তা শুধু নয়। তার অবাক করা কিছু প্রশ্নও রয়েছে। রয়েছে পাকা পাকা কথার ঝুড়ি। যা শুনলে মুখজুড়ে পেয়ে বসে একচিলতে হাসি। যেমন - ‘বাবা, রামদয়াল দারোয়ান কাককে কৌয়া বলছিল, সে কিচ্ছু জানে না। না?’
গল্পে লেখকচরিত্র সেই উত্তর দেওয়ার আগেই তার অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা, ‘দেখো বাবা, ভোলা বলছিল আকাশে হাতি শুঁড় দিয়ে জল ফেলে, তাই বৃষ্টি হয়। মা গো, ভোলা এত মিছেমিছি বকতে পারে! কেবলই বকে, দিনরাত বকে।’
কিছুমাত্র অপেক্ষা না করেই, আবার, ‘বাবা, মা তোমার কে হয়।’
এসব শুনলে যে কেউ ফিক করে হেসে ফেলবে। মিনির এই চরিত্রটা সত্যি একটু অন্যরকম। ভালো লাগার। গল্পের শুরু থেকে শেষাবধি আলাদা একটা টান সৃষ্টি করে। 

॥ তিন ॥
একদিন ওই যে মিনি আগডুম-বাগডুম খেলা রেখে জানালার পাশে গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো, কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা। সেই থেকেই শুরু হলো তাদের সম্পর্ক। প্রথম থেকেই মিনির চোখ ছিল তার ঝুলির দিকে! সে সময় রহমত ঝুলি থেকে কিসমিস বের করে দিলে, সে নেয়নি। প্রথম পরিচয়টা এমনভাবে হলেও পরবর্তীতে কেমন করে যেন তাদের সম্পর্কটা গভীর হলো! লেখক সেটা বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ একদিন তা চোখে পড়েছিল। তাদের সম্পর্কে বলতে, কাবুলিওয়ালা তার কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনত। বাবার পর রহমতই ছিল তার দ্বিতীয় বন্ধু।

রহমত যখনই তার সঙ্গে দেখা করতে আসত, কিছু না কিছু নিয়ে আসত। তাদের মাঝে অনেক আলাপ হতো। মিনি দুষ্টুমিও করত। এ সম্পর্কে লেখক চরিত্রের বর্ণনা, ‘দেখিলাম, এই দুটি বন্ধুর মধ্যে গুটিকতক বাঁধা কথা এবং ঠাট্টা প্রচলিত আছে যথাÑ রহমতকে দেখিবামাত্র আমার কন্যা হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিত, ‘কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা, তোমার ও ঝুলির ভিতর কী।’ রহমত একটা অনাবশ্যক চন্দ্রবিন্দু যোগ করিয়া হাসিতে হাসিতে উত্তর করিত, হাঁতি।’
‘উহাদের মধ্যে আরো-একটা কথা প্রচলিত ছিল। রহমত মিনিকে বলিত, ‘খোঁখী, তোমি সসুরবাড়ি কখুনু যাবে না!’
‘সে উল্টিয়া জিজ্ঞাসা করিত, তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে? রহমত কাল্পনিক শ্বশুরের প্রতি প্রকা- মোটা মুষ্টি আস্ফালন করিয়া বলিত, ‘হামি সসুরকে মারবে।’
এভাবেই জমে উঠেছিল মিনি ও রহমতের খুনসুটি। দিন যতই যাচ্ছিল তাদের সম্পর্ক ততই মজবুত হচ্ছিল। প্রতিদিন একবার করে হলেও দেখা দিয়ে যেত রহমত। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও মিনিকে দেখা দিত রহমত। সকালে না হলে, সন্ধ্যায়। মিনি রহমতকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠত, কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা! এমনই ছিল তাদের সম্পর্ক। মিনির মা এতে সন্দেহ করলেও লেখক তা মাথায় নেয়নি। একবার দুইবার ভয় হলেও তাদের খুনসুটির চিত্র দেখে লেখকচরিত্র সব ভুলে যেতেন।
॥ চার ॥
রহমত ও মিনির গল্পটা সুন্দরভাবে এগিয়ে গেলেও কিছুটা অনাকাক্সিক্ষতভাবেই তা থেমে যায়। পাওনা টাকা অস্বীকার করায় ছুরিকাঘাতে একজনকে হত্যার চেষ্টা করায় রহমতের বেশ কয়েক বছর জেল হয়। কিন্তু, জেলে থেকেও সে মিনির কথা ঠিকই স্মরণ করত। এদিকে মিনির বয়স বৃদ্ধিতে ধীরে ধীরে সে কাবুলিওয়ালার কথা ভুলে বসে। ভুলে বসে তার বাবাও। জেল থেকে বের হয়ে কাবুলিওয়ালা মিনিদের বাড়িতেই প্রথম যায়। সেদিন ছিল মিনির বিবাহ। লেখক প্রথম তাকে দেখে চিনতেই পারেননি।

চিনতে পারেন তার হাসি দেখে। একপর্যায়ে রহমত মিনিকে দেখতে চায়। তার কাছে যেন মিনি এখনো সেই ছোট্ট খুকি। অথচ এখন সে বিবাহের উপযুক্ত। তা সে কখনোই ভাবেনি। সে ভাবে, তার কথা শুনে মিনি দৌড়ে এসে বলবে, কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা। তোমার ও ঝুলির ভিতর কী? লেখক কাজের বাহানা দিলেও একটা চিরকুটের চিত্র দেখে লেখকমন গলে যায়। 
লেখক বলেন, ‘কহিল, আপনার বহুৎ দয়া, আমার চিরকাল স্মরণ থাকিবে আমাকে পয়সা দিবেন না। বাবু, তোমার যেমন একটি লড়কী আছে, তেমনি দেশে আমারও একটি লড়কী আছে। আমি তাহারই মুখখানি স্মরণ করিয়া তোমার খোঁখীর জন্য কিছু কিছু মেওয়া হাতে লইয়া আসি, আমি তো সওদা করিতে আসি না।’
এই বলিয়া সে আপনার মস্ত ঢিলা জামাটার ভিতর হাত চালাইয়া দিয়া বুকের কাছে কোথা হইতে এক-টুকরা ময়লা কাগজ বাহির করিল। বহু সযতেœ ভাঁজ খুলিয়া দুই হস্তে আমার টেবিলের ওপর মেলিয়া ধরিল। দেখিলাম, কাগজের ওপর একটি ছোটো হাতের ছাপ। ফোটোগ্রাফ নহে, তেলের ছবি নহে, হাতে খানিকটা ভুষা মাখাইয়া কাগজের ওপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে। যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চার করিয়া রাখে।”
রহমত মিনিকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণই হলো তার মেয়ে মিনির বয়সী। তাকে রেখে দূর দেশে পড়ে আছে রহমত। মিনিকে দেখলে কেমন যেন সে তার মেয়েকে দেখতে পায়। এরপর লেখক মিনিকে ডাক দিয়ে নিয়ে আসলেও মিনি কাবুলিওয়ালাকে চিনতে পারেনি। চিনবেই বা কী করে! এখনো কি মিনি সেই ছোট্ট মিনি আছে! আর ছোটবেলার কথা কি আর অত মনে থাকে! 

॥ পাঁচ ॥
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাবুলিওয়ালা চরিত্রটিকে তুলে ধরেছেন ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। কখনো মিনির খুব কাছের বন্ধু হিসেবে। কখনো ভিনদেশীদের ত্যাগের বাস্তবতা হিসেবে। কখনো তুলে ধরেছেন মেয়ের প্রতি বাবার ভালোবাসার অনুপম চিত্র হিসেবে। এই গল্প যেমন একজন কাবুলিওয়ালার চিত্র বলে, ঠিক তেমনই গল্পে জীবন তুলে ধরার ক্ষেত্রে কবিগুরুর মুন্সিয়ানারও কথা বলে। তিনি তার লেখা বিভিন্ন গল্পে সে সময়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। বাস্তবতা পাঠকের সামনে প্রকাশ করেছেন। কাবুলিওয়ালা কিন্তু তার বাইরে নয়। 
দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসত ভারত উপমহাদেশে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। অনেকটা সময় থাকত। নিজের পরিবার-পরিজন ছেড়ে। সময় কাটাতে হতো একেলাই। নিজের পরিবার ছাড়া এভাবে সময় কাটানো কতটা কষ্টকর সেটা শুধু তারাই জানে। সেই বাস্তবতা সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ তার এই গল্পের চিত্র সাজিয়েছেন। কাবুলিওয়ালা সেই গল্পের নায়ক। সেই গল্পের প্রধান চরিত্র। প্রতিটি ভিনদেশী লোকের রূপক চিত্র। প্রতিটি মেয়ের প্রতি বাবার নীরব ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

×