ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

আষাঢ় এসেছে বৃষ্টির গন্ধে, মানুষের হৃদয়ে

বর্ষার আষাঢ়: জল, গান, স্মৃতি আর জীবনের ছায়া

রিজওয়ান করিম, সিনিয়র ফটোসাংবাদিক, লেখক

প্রকাশিত: ১৮:১৫, ১৯ জুন ২০২৫

বর্ষার আষাঢ়: জল, গান, স্মৃতি আর জীবনের ছায়া

আষাঢ়ের আকাশ আবারও ডেকে এনেছে স্মৃতির ছায়া, ঝোড়ো হাওয়ার সাথে মেঘ জমেছে হৃদয়েও। প্রকৃতিও যেন অপেক্ষায়, এক অবিরাম বর্ষণের! - রিজওয়ান করিম

আষাঢ়ের সবে শুরু। এরই মধ্যে রিমঝিম বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে চারদিক। আকাশ যেন দিনভর মেঘে ঢাকা; দূরে কাছের গাছের ফাঁকে কেবল দেখা যায় ছুটে চলা দিগ্ভ্রান্ত মেঘ। কখনো বা ঘন গর্জনে কেঁপে ওঠে প্রকৃতি, সৃষ্টি হয় এক দারুণ অনুভূতির। যেন প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনেও জেগে উঠছে এক অনন্ত শিহরণ।

আষাঢ়—বর্ষার প্রথম মাস। সদ্য বিদায়ী জ্যৈষ্ঠের রুক্ষতা ধুয়ে-মুছে আনে বারিধারা। সাধারণত মাসের শুরুতে বর্ষার এত সক্রিয়তা দেখা যায় না। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। শুরু থেকেই বৃষ্টিতে সিক্ত শহর-গ্রাম, মাঠ-ঘাট, মনের অলিন্দ।

আষাঢ় মানেই কবিগুরুর কণ্ঠে ঝরে পড়া শব্দ—
“নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে...
বাদলের ধারা ঝরে ঝরো ঝরো, আউশের ক্ষেত জলে ভরো ভরো...”
সেই চিরচেনা দৃশ্য যেন আজও অক্ষয়।

পহেলা আষাঢ়ে নগরজীবনে বর্ষা-বন্দনার কোনো উৎসব ছিল না, ছিল না ছাতা হাতে মানুষের আনাগোনা—তবে প্রকৃতি ঠিক জানিয়েছে, আষাঢ় এসেছে। তিন দিন ধরে থেমে থেমেই হচ্ছে বৃষ্টি। মুষলধারে বর্ষণে অনেকটাই শীতল হয়েছে প্রকৃতি, খাল-বিল ভরেছে জলে, মাঠে জমেছে কাদা। সেই কাদামাটির গন্ধেই ফিরে আসে শৈশবের স্মৃতি।

বর্ষা শুধু প্রকৃতিকে নয়, আমাদের জীবনচক্রকেও বদলে দেয়। উর্বর হয় মাটি, বেড়ে ওঠে ফসল, ফুল ফোটে বেলী-বকুল-জুঁই-গন্ধরাজেরা। ধরা দেয় বর্ষার সেই চিরচেনা প্রতীক—বাদল দিনের প্রথম কদমফুল। পাখির ডানায় জমে ওঠে জল, ময়ূর পেখম মেলে নাচে। এভাবেই প্রকৃতির প্রথম প্রেমিক আষাঢ় জাগিয়ে তোলে রং ও গন্ধের এক নতুন ঋতুবোধ।

শহরের কেউ কেউ এখনও টিনের চালের নিচে বৃষ্টি শোনেন, আর কেউ কংক্রিটের ছাদে দাঁড়িয়ে অনুভব করেন সেই চিরচেনা ছন্দ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেউ ভিজে যান নীরবে, কেউ আবার হারমোনিয়াম তুলে নেন কোলে—ঘরের কোণে বসেই গেয়ে ওঠেন:

“মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে
আজ ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে...”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে বর্ষার বন্দনা। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামভরা থাকে বৃষ্টিতে সিক্ত দুপুর, খিচুড়ির থালা আর ইলিশের ছবি দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতায় ইলিশের সঙ্গে বর্ষার যে আবেগ, সেটিও যেন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। উচ্চমূল্যে বাজারে রুপালি স্বপ্নটি আজ অনেকের নাগালের বাইরে। তাই খিচুড়ির পাশে দুই বেগুনভাজা, এক পোড়া মরিচেই বর্ষার ভোজ অনেকের কাছে তৃপ্তিকর।

বর্ষাকাল, বিশেষত আষাঢ়, বাংলাদেশের কৃষির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিতে ভরে ওঠে মাঠ-ঘাট, নদী-নালা। মাছের ছলাৎছল শব্দে প্রাণ পায় গ্রামীণ জনপদ।

তবে বৃষ্টি যেমন শান্তির, তেমনি কষ্টেরও বাহক—জলাবদ্ধতা, সড়ক ভাঙন, রোগব্যাধি।
তবুও আষাঢ় আমাদের হৃদয়ে এক আশাবাদী উপস্থিতি। সে আসে মেঘ হয়ে, গান হয়ে, স্মৃতি হয়ে, অথবা একটা ভেজা গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুর মতো নীরবে।

শিহাব

×