ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

ইসরাইল-ইরানের যুদ্ধ ॥ বিকল্প বাজার খুঁজে বের করার তাগিদ

অর্থনীতির স্বার্থে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৩৬, ১৯ জুন ২০২৫

অর্থনীতির স্বার্থে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি

অর্থনীতির স্বার্থে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা

ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি মারাত্মক ঝুঁকি বলে মনে করেন ব্যবসায়ী নেতা ও শিল্পোদ্যোক্তা সাকিফ শামীম। সম্প্রতি তিনি এফবিসিসিআই নির্বাচন ও ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, এটি কেবল কয়েকটা নির্দিষ্ট খাতকে নয়, বরং পুরো অর্থনীতিকে টালমাটাল করে দিতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের উচিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বিকল্প বাজার ও উৎস খুঁজে বের করা এবং প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। ব্যবসায়ীদেরও উচিত নিজেদের সাপ্লাই চেইনকে আরও শক্তিশালী করা এবং বৈশ্বিক অস্থিরতার জন্য প্রস্তুত থাকা। মানবজাতির জন্য এমন একটি যুদ্ধের পরিস্থিতি এড়ানোই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। কারণ এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।

ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ শামীম বলেন, এই যুদ্ধের ফলে সারাবিশ্বে জ্বালানির সঙ্কট তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইরানের নিয়ন্ত্রণে থাকা হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্বের জ্বালানি তেলের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এতে করে দাম বাড়বে জ্বালানির। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সারাবিশ্বের উৎপাদন ও মূল্যের ওপর। বাংলাদেশও বৈশ্বিক এই সংকট থেকে মুক্ত নয়। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হলে গম, চিনি, ভোজ্যতেল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে।

বাংলাদেশ এসব পণ্যের একটি বড় অংশ আমদানি করে। তাই আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়লে দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়কে অসহনীয় করে তুলবে। আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে  সহ-সভাপতি পদে প্রার্থী হচ্ছেন জানিয়ে সাকিফ শামীম বলেন, ব্যবসায়ীদের কল্যাণে তিনি সামর্থ্য অনুযায়ী সবকিছু করবেন। ছোট বড় সবার সঙ্গে তিনি কাজ করবেন। এজন্য এফবিসিসিআইয়ের জিবি মেম্বারদের ভোট প্রত্যাশা করছেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন,  ইজরায়েল এবং ইরানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ভূ-রাজনৈতিক এই সংঘাত বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে- কারণ এটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই সংঘাতের সরাসরি প্রভাব না থাকলেও, এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক তরঙ্গ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বয়ে আনবে বলে তিনি জানান। এছাড়াও অন্যান্য প্রভাবগুলো হচ্ছ- ১. তেলের দাম বৃদ্ধি এবং তার প্রভাব মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের জ্বালানি তেলের অন্যতম প্রধান উৎস।

ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে তেলের সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং বিশ্ববাজারে তেলের দাম হু হু করে বাড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতি তেলের আমদানির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়বে, যা প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে এবং ব্যবসা পরিচালনার খরচ আকাশচুম্বী হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় লোডশেডিং বৃদ্ধি পেতে পারে, যা শিল্প উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করবে। এছাড়া এই যুদ্ধের ফলে পণ্য জাহাজীকরণ ও সরবরাহ চেইন ব্যাহত, রেমিটেন্স প্রবাহে আঘাত, বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা, শেয়ারবাজারের অস্থিরতা ও পণ্যের চাহিদা  ও ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। 
২. জাহাজীকরণ ও সরবরাহ চেইন ব্যাহত ঃ মধ্যপ্রাচ্যের জলপথ, বিশেষ করে হরমুজ প্রণালী (Strait of Hormyu), বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের প্রায় ২০-৩০% তেল এই প্রণালী দিয়েই পরিবাহিত হয়। যদি এই অঞ্চল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, তাহলে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। জাহাজীকরণের সময় বাড়বে, বিমার খরচ বাড়বে এবং অনেক রুট পরিবর্তন করতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত, যেমন তৈরি পোশাক শিল্পে কাঁচামাল আমদানি এবং পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হবে।
৩. রেমিটেন্স প্রবাহে আঘাত ঃ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। যদি এই অঞ্চলে যুদ্ধ বা অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে কর্মসংস্থান কমে যাবে, শ্রমিকদের আয় কমে যাবে এবং অনেকে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবেন। এর ফলে বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহে ব্যাপক ধস নামবে, যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং ডলার সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

×