ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

সরকারের সঙ্গে তিনদিনের বৈঠকে এনসিসি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ

বেশিরভাগ দল সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের পক্ষে

আবদুর রহিম

প্রকাশিত: ২৩:০২, ১৯ জুন ২০২৫

বেশিরভাগ দল সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের পক্ষে

ড.দিলারা চৌধুরী, এম হুমায়ুন কবির

মোহামদ রাকিব। ঢাকা কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে একাধিকবার আহত হয়েছেন। বিপ্লব পরবর্তী কোনো প্রতিদান না নিয়েই পড়ার টেবিলে ফিরে গেছেন। দেশের সাম্প্রতিক যে কোনো ইস্যুতে জুলাইয়ের এই যোদ্ধা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মতামত জানাচ্ছেন আবার কখনও গণমাধ্যমের মুখোমুখি হচ্ছেন। গতকাল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের।

বলছেন, বিগত ১৮ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। দুই হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন। ৩১ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। সম্প্রতি ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে এনসিসি গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছে তা দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রত্যাশা। হাসিনা সরকার বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধবংস করে ফেলেছে। তা থেকে উত্তরণের জন্য  জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা আবশ্যক। 
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গত তিনদিন সরকারের আলোচনা হয়েছে। সেখানে উপস্থিতির ৯০ শতাংশের বেশি দল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনে একমত হয়েছে। তবে দেশের দু’একটি রাজনৈতিক দল পাওয়ার ফাংশনের প্রশ্ন তুলে বিপরীত মতামত দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে ৯ সদস্যের একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের সুপারিশ রয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের। 
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি’ গঠনের এ সুপারিশ করেছে কমিশন। এনসিসিতে থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নি¤œকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নি¤œকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে উভয়কক্ষের কোনো একজন সংসদ সদস্য।
এ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সম্মতি রয়েছে। ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে দেখা গেছে, তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণমূলক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। এ বিষয়ে অধিকাংশ দলই একমত হয়েছে, যদিও কয়েকটি দল ভিন্নমত পোষণ করেছে।’

আমাদের এখানে নির্বাচিত পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে থাকে। ঐকমত্য কমিশন রেফার করেছে যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ইলেক্ট্রোরাল কলেজ পদ্ধতিতে হবে। যেখানে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ মেম্বার পর্যন্ত ৭০ হাজার ইলেক্ট্রোরাল মেম্বার হবেন। তাদের মাধ্যমে সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় কাউন্সিল গঠনের সুপারিশের বিষয়টি যেহেতু এখনও চলমান তাই এখনই আমি এ বিষয়ে  সরাসরি আমার মত প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এ বিষয়টা নিয়ে আমাদের এখনও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে।  মানুষ আসলে কি চাচ্ছে সেটা  বোঝার চেষ্টা করছি। তবে পজিটিভ বিষয় বেশি দেখছি। সেই জায়গা থেকে বলব, সাংবিধানিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেগুলোকে স্বতন্ত্র নিয়ে আসা আবশ্যক। স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে হস্তক্ষেপ মুক্ত করা অনেক বেশি জরুরি।
আর বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, কোন দল কি বলছে আমি আসলে ওদিকে দৃষ্টি দিচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছে অবশ্যই সাংবিধানিক কাউন্সিল থাকা আবশ্যক। সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যখনি যে সরকার ক্ষমতায় আসে তাদের হস্তক্ষেপে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে করে যোগ্য ব্যক্তিরা এই সমস্ত পদে আসে না। যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয় না। আমরা অতীতে দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কারা বসবে তাদের ঠিক করে দেওয়া হতো। 
এতে করে ওই ব্যক্তি শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর মনোতুষ্ট করতে সব সময় নিয়োজিত থাকত। বাংলাদেশে জুলাইয়ে এত ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে জীবন দেওয়ার পর এখন অবশ্যই স্বচ্ছ-গ্রহণযোগ্য যোগ্য ব্যক্তিদের সাংবিধানিক পদগুলোতে আসা প্রয়োজন।  যাতে তারা জনগণের স্বার্থ, স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করতে পারে। তার জন্য এনসিসি গঠন এখন সবার প্রত্যাশা 
এ নিয়ে সরকারের দরবারে গত কয়েকদিন ধরে চলছে পক্ষ-বিপক্ষে মতামত। নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান সংগঠক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। আমরা বলতে চাই, যাঁরা এনসিসি গঠনের বিপক্ষে, তাঁরা মূলত ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় থেকে যেতে চান।’

‘আমরা জানতে চাই, আপনারা কি আগের ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় থেকে যেতে চান? মানবাধিকার কমিশন থাকার পরও বিগত ১৬ বছরে তারা কোনো কথা বলেনি। দুদক ও নির্বাচন কমিশন তাদের কার্যক্রমে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। কারণ, তারা একটি দল ও ব্যক্তির আজ্ঞাবহে পরিণত হয়েছিল।’ শেখ হাসিনার আমলে আইন ও প্রতিষ্ঠান সংস্কারে যেসব দল দাবি তুলেছিল, তারা এখন বিরোধিতা করছে। কী কারণে বিরোধিতা করছে, তা জানি না। যারা বিরোধিতা করেছে তারা যেন বিকল্প প্রস্তাব দেয়।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কলেজ গঠনে আমাদের সম্মতি রয়েছে। অতীতে নির্বাহী বিভাগের নামে মূলত শেখ হাসিনার একক পছন্দেই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে ফ্যাসিবাদী আমলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিকে পর্যন্ত বলতে শোনা গেছে যে তিনি ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’।

তেমনিভাবে দলান্ধ-অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়ার কারণে পিএসসির প্রশ্নপত্র ব্যাপকহারে ফাঁস হয়েছে, যা নজিরবিহীন। প্রশ্ন হলো, আমরা কি আগের অবস্থা বহাল রাখব, নাকি সংস্কার করব? সহ্স্র প্রাণ ও রক্তসাগর পেরিয়ে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে তাকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে হলে অবশ্যই সংস্কার অপরিহার্য এবং সে কারণেই এনসিসি গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি আবশ্যক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এনসিসিকে সাংবিধানিকভাবে অনেক অনেক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর জবাবদিহিতা নেই। যদি কর্তৃত্ব থাকে, ক্ষমতা থাকে কিন্তু জবাবদিহিতা থাকে না, সেই রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমরা গণতান্ত্রিক পার্টি হিসেবে সমর্থন জানাতে পারি না।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াত এনসিসি গঠনের পক্ষে। এর মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।

×