ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তনে সব দল একমত

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০০:০৮, ২০ জুন ২০২৫

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তনে সব দল একমত

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করতে সংবিধান সংশোধন

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করতে সংবিধান সংশোধনে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ। তবে নতুন নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি বলে জানান তিনি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শেষে সমাপনী ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

এ সময় কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানের ৪৮(১) অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন চান সবাই। তবে নতুন প্রক্রিয়ার প্রায় পুরোটাই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই আগে আইনসভা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৫০০ ভোটের ইলেক্টোরাল কলেজ হবে নাকি জেলা পরিষদ-সিটি করপোরেশন যোগ হবে এর অনেক কিছুই নির্ভর করছে আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হবে কি না তার ওপর। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত মীমাংসায় আসতে চাইলে আগে আইনসভার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ প্রসঙ্গেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি উল্লেখ করে কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী পরপর দুই মেয়াদে হলে আর হওয়া যাবে না কিংবা পরে এক বা দুই মেয়াদ বাদ দিয়ে হওয়া যাবে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

তবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। আগামী রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনা শুরু হবে। এরমধ্যে এ কয়দিনের আলোচ্য বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা তাদের নীতিনির্ধারক কমিটির সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পাবে বলে জানান তিনি। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না, সেসব বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে- জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না তা স্বচ্ছতার সঙ্গে উল্লেখ করা হবে।

বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন প্রত্যাশা করাও ঠিক হবে না। কিন্তু কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হওয়ার সদিচ্ছা রয়েছে।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে একমত হলেও পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে একমত নয় বিএনপি। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত ইলেক্টোরাল কলেজ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করে এক্ষেত্রে বিদ্যমান গোপন ভোট পদ্ধতি চায় দলটি। পিআর পদ্ধতি বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে বোধহয় এখন আমাদের কনসিডার (বিবেচনা) করা ঠিক হবে না।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের টানা তৃতীয় দিনের আলোচনা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমাদের দলের পক্ষ থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণা এজন্য দিয়েছিলাম যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন খাতে যাদের অবদান আছে, যাদের চিন্তাধারা ও অবদান জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে, আমরা তাদের প্রতিনিধিত্ব আকারে এখানে (দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদে) যুক্ত করার বিবেচনা করেছিলাম।

তিনি বলেন, আমরা উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রে সরাসরি ভোটের কথা বলিনি। আমরা মনে করি পিআর পদ্ধতিটা এখানে সঠিক হবে না। সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বর্তমানে সংসদ সদস্যদের পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বিএনপিও বিদ্যমান পদ্ধতিতে সংসদ সদস্যদের গোপন ভোট পদ্ধতির পক্ষে। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইলেক্টোরাল পদ্ধতির বিষয়ের রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। এর মধ্যে উচ্চকক্ষ ও নি¤œকক্ষের সদস্যদের গোপন ব্যালটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার পক্ষে বেশি মতামত এসেছে। এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়নি।

তবে সবগুলো রাজনৈতিক দল গোপন ভোটের পক্ষে একমত হলে এতে একমত বিএনপি। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নেওয়া প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলই গোপন ব্যালটের নির্বাচনের প্রস্তাবে একমত বলে সংলাপের পর ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন তিনি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ইলেক্টোরাল ভোটের ভোটার ইউপি মেম্বার পর্যন্ত (৭০ হাজার) বর্ধিত করার বিষয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে।

একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার বিষয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। যদিও এতে দ্বিমত রয়েছে বিএনপির। দলটি বলছে, একজন ব্যক্তি টানা দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গ্যাপ দিয়ে পরেরবার আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে।
তৃতীয় দিনের প্রথম পর্বের বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আবু তাহের সাংবাদিকদের জানান, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তারা বর্তমান সংসদ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটের পরিবর্তে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত প্রায় ৭০ হাজার সদস্যের এক্সটেন্ডেড ইলেক্টোরাল কলেজের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে দলটি জোর দিয়েছে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সরকারের অধীনে নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে হবে।

আবু তাহের বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে মূলত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা নীতিগতভাবে একটি এক্সটেন্ডেড ইলেক্টোরাল কলেজের পক্ষে, যেখানে পার্লামেন্টের সদস্য (যদি আপার হাউজ হয় তবে উভয় কক্ষের) এবং জেলা পরিষদ, মিউনিসিপ্যালিটি, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বার পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার জনপ্রতিনিধি থাকবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা বলেছি যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সরকারের অধীনে হতে হবে, যেমনটি পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়। 
কারণ, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে যারা নির্বাচিত হবেন তারা তো প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হবেন না। এ বর্ধিত নির্বাচকম-লীর সদস্য সংখ্যার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী নমনীয়তা প্রকাশ করেছে। আবু তাহের জানান, বিভিন্ন পক্ষ জেলা পরিষদ, উপইউনিয়ন পর্যন্ত অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সকলে মিলে যে পর্যন্ত ঐকমত্য হতে পারি, সেখানে জামায়াত ইসলামী তার মতকে সংশোধন করতে পারে।

বৈঠকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রায় সবাই একমত হয়েছেন বলে জানান আবু তাহের- তা হলো গোপন ব্যালটে নির্বাচন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তার শুরু থেকেই সকল অভ্যন্তরীণ নির্বাচন গোপন ব্যালটে করে থাকে। তাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ নিয়ম কার্যকর হলে তা ভোটের জন্য ভালো। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়েও প্রস্তাব দিয়েছে, যা এখনো আলোচনার এজেন্ডায় আসেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আজকের আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে।

×