
গ্রামবাংলার গৃহস্থ নারীদের সঙ্গে গৃহপালিত মুরগীর যে সখ্যতা, তা কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়, বরং এটি এক আন্তরিক সম্পর্ক, এক গভীর মানবিকতার বন্ধন। শহরের পোলট্রি ফার্মগুলোতে যেখানে মুরগী কেবলই লাভ-লোকসানের হিসাব, সেখানে গ্রামের কৃষাণি মুরগীকে দেখেন সন্তানসদৃশ স্নেহে।
ফার্মের খাঁচায় বন্দী মুরগী যখন নাদুস-নুদুস হয়ে ওঠে, তখন তার প্রতিটি গ্রাম ওজনের হিসাব চলে মুনাফার খাতায়। প্রতিদিনের ডিম, বাজারের দাম, খাবারের খরচ সব কিছুই পুঁজির সমীকরণে বাঁধা। অথচ গ্রামে, উঠানে, ঘরে, ডাঙ্গায় অবাধ বিচরণ করে বেড়ানো দেশি মুরগীর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন সংসারের প্রাণ।
ঠাকুরগাঁও সদরের রুহিয়া বারঘরীয়া গ্রামের রুনা আক্তার (২৫) একটি ছোট্ট সংসার সামলান। স্বামী শাহাজাহান সিরাজ, তিন মেয়ে নিয়ে তার জীবন। কিন্তু রুনার সংসারে আরও সদস্য আছে— কয়েক জোড়া ছাগল, গরু, হাঁস আর দশ-বারোটি দেশি মুরগী।
সবচেয়ে প্রিয় তার সেই গলাছিলা মুরগীটি, যাকে তারা স্থানীয় ভাষায় বলে “গলা কাটা”। গত তিন বছরে এই মুরগীটি অসংখ্য বাচ্চা ফুটিয়েছে। এখনো ডিম তা’য়ে রয়েছে দশটি ডিম। দশটি ছানা যাদের একেকটি যেন রুনার নিজের সন্তান।
গলাছিলা বা গলা কাটা মুরগীর ঘাড়ে নেই পালক। লালচে ঘাড় আর শকুন সদৃশ চেহারার কারণে অনেকে ভীত হলেও গৃহস্থ নারীদের কাছে এই জাতই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। কারণ বাচ্চা পালনে এদের সতর্কতা ও সাহস অপরিসীম।
বেজি, সাপ, চিল কিংবা কাক যে-ই হোক না কেন, বাচ্চাদের উপর হুমকি এলে গলাছিলা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঠোকরায়, তাড়ায়, ডানা মেলে ছানাদের আড়াল করে। বিপদের সঙ্কেত পেলে সে ‘কুট কুট’ আওয়াজ করে, আর তার ডাকে ছানারা ছুটে আসে ডানার নিচে আশ্রয়ে।
রুনা বলেন, “মুরগীর বাচ্চালা না খাইলে কইলজাখান ছ্যাঁৎ করে উঠে। মোর পেটের ছুয়ার মত উমাকও দেখু।” মা মুরগীর ছানারা শুধু উঠানের সাথী নয়, ঘরের শিশুর সাথেও খেলে বেড়ায়। হাসিনার সন্তান আর মুরগীর ছানারা একসাথেই বেড়ে ওঠে।
স্বামী শাহাজাহান সিরাজের কথায়, “এই গলাছিলা মুরগী কাক দেখলে এমন করে, মনে হয় দুনিয়া উল্টায় দিবে।” তিনিও মুরগীর ডাক, হাঁটাচলা, এমনকি ডিম পাড়ার সংকেত পর্যন্ত বুঝতে পারেন। তাঁর কাছে মুরগী যেন আরেকজন নীরব, সজীব আত্মীয়।
পোলট্রি ফার্মের মুরগী বড় হলেও তার মাংস-ডিমে যেন প্রাণ নেই। অনেকের মতে, ফার্মের মুরগীর মধ্যে ওষুধের গন্ধ থাকে। তাই দেশি মুরগীর ছোট ডিম হলেও তার স্বাদ, ঘ্রাণ এবং পুষ্টিগুণে বাজারে চাহিদা বেশি। ফলে দামও বেশি।
গৃহস্থ নারীরা মুরগীর হাঁক, খোঁজাখুঁজি, ডিম পাড়া, তা বসা—সবকিছুই বুঝতে পারেন। কোন মুরগী এক নাগাড়ে বিশটা ডিম দেয়, আবার কোনটি বারটা দিয়ে থেমে যায়। তাদের হিসাব থাকে গৃহিণীদের মাথায়। ডিমে তা বসার সময় তারা বিশেষভাবে মুরগীর যত্ন নেন।
‘উম’ ভাঙানোর জন্য অনেকে সুপারি খোল পরিয়ে দেন মুরগীর গলায়, কেউ আবার ঝুলিয়ে রাখেন, বা পুকুরে চুবিয়ে দেন যাতে সে বিরক্ত হয়ে ডিমে ‘তা’ না দেয় আর।
রুহিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আব্দুল মান্নান ও স্থানীয় কৃষকদের মতে, এখন পর্যন্ত প্রায় ২২ প্রজাতির দেশি মুরগীর নাম জানা গেছে লেংড়া, ময়ূরী, সিংহ, কোকিলা, ঝুঁটি, মোয়াল্লা (গলাছিলা), ইয়াছিন, বাইন্যা, হেজা, সোনাপায়া, হিলি, ঘোড়া, ধুন্দা প্রভৃতি। এদের রঙ, গঠন, আচরণ একেক রকম। কেউ সুন্দর, কেউ সাহসী, কেউ আবার নিঃশব্দ।
একবিংশ শতাব্দীর পুঁজিনির্ভর বিশ্বে যেখানে প্রাণ জড় বস্তুতে রূপ নিচ্ছে, সেখানে গ্রামবাংলার গৃহবঁধূদের হাতে দেশি মুরগী এখনো একটি জীবন্ত সম্পর্ক। শুধু অর্থ নয়, এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি মমতা, যত্ন এবং ভালোবাসা।
আর এই ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠেছে গলাছিলা মুরগী।
মিমিয়া