
বাংলা সাহিত্যে হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩) এক প্রবাদপ্রতিম নাম, যিনি কেবল একজন কবি নন, বরং একাধারে প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সম্পাদক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তিনি প্রধানত কবি এবং এই পরিচয়েই তিনি সর্বাধিক আলোচিত ও স্মরণীয়। বিশেষত পঞ্চাশের দশকে যখন বাংলা কবিতা ভাষা আন্দোলনের অভিঘাতে এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করে, তখন হাসান হাফিজুর রহমানের আগমন ঘটে এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর নিয়ে—যা ছিল দ্রোহে দীপ্ত ও স্বদেশভক্তিতে নিমগ্ন।
হাসান হাফিজুর রহমান একজন
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমালোচক। ১৯৩২ সালের ১৪ জুন জামালপুর শহরে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। পৈতৃক নিবাস জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে বিএ এবং ১৯৫৫ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
ভাষা আন্দোলন ও কবির হৃদয়বেদনা
পঞ্চাশের দশকের কবিতায় ভাষা আন্দোলনের অভিঘাত ছিল ব্যাপক। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিতে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারটি পাকিস্তানি শাসকরা ভেঙে ফেললে, সে ঘটনার অভিঘাত কবির অন্তরকে রক্তাক্ত করে তোলে। এই হৃদয়বেদনা থেকেই তিনি সম্পাদনা করেন ঐতিহাসিক সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, যা কেবল সাহিত্যনির্মাণ নয়, বরং এক জাতীয় আত্মপ্রকাশের দলিল। এই সংকলন বাংলা ভাষার আন্দোলনকে সাহিত্যের ভাষায় রূপ দিয়েছে এবং কবিকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
দেশপ্রেমের অনন্য উচ্চারণ
হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় দেশপ্রেম একটি কন্দরের মতো ছায়াপাত করে। তিনি লিখেছেন:
“আমার হৃদপিণ্ডের মতো/আমার অজানা সামুতন্ত্রীর মতো/সর্বক্ষণ সত্য আমার দেশ/আমার দেহের আনন্দ-কান্নায় তোমাতেই আমি সমর্পিত।”
এখানে কবি কেবল দেশকে ভালোবাসেননি, বরং দেশই তাঁর অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ‘স্বদেশ’ তাঁর কাছে কেবল ভৌগোলিক পরিচয় নয়, বরং চেতনার স্পন্দন, হৃদয়ের আরাধ্য, আত্মার আত্মীয়।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ব্যক্তিগত শোক
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতায় এসেছে এক করুণ অথচ দীপ্তিময় অভিঘাত হয়ে। যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর দুই সহোদরকে হত্যা করে। এই ব্যক্তিগত শোক তাঁকে কাঁদায় না, বরং রূপ দেয় এক শিল্পসত্তায়, দ্রোহের ভাষ্যে:
“একজন নয়, তোমার দুই দুটি সহোদরের রক্তে/ওরা মাটি ভিজিয়ে দিল/তবু তোমার শোক নেই কেন?/...আমি পারি না কাঁদতে/শুধু শিল্পীভূ হই শেষ আঘাতের অমোঘতায়।”
এই উচ্চারণে একদিকে রয়েছে নিঃসীম শোক, অন্যদিকে রয়েছে বিপ্লবী কণ্ঠ যে কণ্ঠ কাঁদে না, বরং শিল্পে পরিণত হয়।
সাহিত্যচর্চায় রাজনৈতিক বোধ
তিনি ছিলেন সময়ের সচেতন সাক্ষী। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকের সকল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, দমনপীড়ন, গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। তার কবিতায় ঘন ঘন উঠে এসেছে বরকত, রফিক, সালাম, জব্বারের নাম, এসেছে জাতীয় শোক ও জাগরণের মিশ্র প্রতিচ্ছবি:
“এই এক সারি নাম বর্ষার ফলার মতো / এখন হৃদয়কে হানে।”
এসব উচ্চারণে তিনি কেবল একজন কবি নন, বরং জাতির ইতিহাসের দায়ভার বহনকারী কণ্ঠ হিসেবে আবির্ভূত হন।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ও বৈশিষ্ট্য
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:
বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩)
আর্ত শব্দাবলি (১৯৬৮)
অন্তিম শরের মতো (১৯৬৮)
যখন উদ্যত সঙ্গীন (১৯৭২)
শোকার্ত তরবারী (১৯৮১)
প্রতিবিম্ব (১৯৭৬)
ভবিতব্যের বাণিজ্য তরী (১৯৮৩)
বিশেষত ‘আর্ত শব্দাবলি’ এবং ‘অন্তিম শরের মতো’- এই দুটি কাব্যগ্রন্থে মুক্তি সংগ্রামে জাতির মানসপ্রবণতা প্রধান হয়ে উঠেছে। এসব কবিতায় কবি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, গণচেতনা ও প্রতিরোধের ভাষা নির্মাণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাঙালি জাতি সব প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে যেতে পারে।
রোমান্টিকতা ও দ্রোহের সমন্বয়
তাঁর কবিতায় শুধু রাজনৈতিক চেতনা নয়, রয়েছে রোমান্টিক অনুভবও। সমাজচেতনার পাশাপাশি প্রেম, প্রকৃতি ও মানবিক বোধও তাঁর কবিতায় জারিত হয়েছে। কিন্তু এই রোমান্টিকতা কখনো দুর্বল নয়; বরং দ্রোহের সঙ্গে এর এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটে। তিনি ছিলেন প্রেমিক ও দ্রোহীর এক অদ্ভুত সহাবস্থানে অবস্থানকারী কবি।
বাংলাদেশ : শোক, সংগ্রাম ও স্বপ্নের প্রতীক
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সূর্যোদয়ে হাসান হাফিজুর রহমান নিজেকে প্রতিটি বীর শহীদ মা-বোন-যোদ্ধার সঙ্গে একাত্ম করে ফেলেন। তাঁর কবিতায় স্বাধীন দেশের স্বপ্ন যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি শোক ও বেদনার রক্তমাখা ইতিহাসও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সন্তানহারা মা যখন পতাকায় চোখ মুছে, তখন সেই দৃশ্য কবিকে স্পর্শ করে- কবিতা হয়ে ওঠে ইতিহাসের দলিল।
হাসান হাফিজুর রহমান বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন নতুন ভাষা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি কেবল কবি নন, এক জনপদের যন্ত্রণার মুখপাত্র। তাঁর কবিতা শুধু শিল্পের নন্দনতত্ত্ব নয়, বরং সময়ের শ্রুতি ও সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি আমাদের কণ্ঠস্বর, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের দেশপ্রেম। স্বদেশকে ভালোবেসে কবিতা রচনার অনন্য নিদর্শন তিনি যিনি ছিলেন নিঃশর্তভাবে বাংলাদেশের কবি।
প্যানেল