
৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ নাগরিকই ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন
গত এক বছরে যেসব নাগরিক সরকারি সেবা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ নাগরিকই ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং নারী ২২ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে নাগরিকদের সর্বাধিক ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হওয়া প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিআরটিএ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে করে এমন তথ্য প্রকাশ করেছে।
ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সময়ে দেশব্যাপী সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) পরিচালনা করে। ৬৪ জেলার ১ হাজার ৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট থেকে ৪৫ হাহার ৮৮৮টি থানার ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী মোট ৮৪ হাজার ৮০৭ জন নারী-পুরুষ উত্তরদাতার সাক্ষাৎকার নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্য বিষয়ক এসডিজি ১৬ এর ছয়টি সূচকের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়েছে।
জরিপের প্রশ্নপত্র জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত আন্তর্জাতিক মান ও পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। বিবিএস জানায়, সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে নাগরিকদের সর্বাধিক ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হওয়া প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিআরটিএ। সেখানে সেবা নিতে গিয়ে ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ, পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ মানুষ সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
গত দুই বছরে ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো বিবাদ বা বিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের মধ্যে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ নাগরিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। এর মধ্যে ৪১ দশমিক ৩৪ শতাংশ আনুষ্ঠানিক (আদালত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবং ৬৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক (কমিউনিটি নেতা, আইনজীবী ইত্যাদি) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা পেয়েছেন।
জরিপে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, গত ১ বছরে দেশের ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ জনগণ কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারীদের মধ্যে এই হার কিছুটা বেশি, যা ১৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, যেখানে পুরুষদের মধ্যে তা ১৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলে বৈষম্যের হার ২২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলের (১৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ) তুলনায় বেশি। এ ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং লিঙ্গভেদে বৈষম্য অথবা হয়রানির হার সর্বাধিক।
নিজের পরিবারের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, গণপরিবহন বা উন্মুক্ত স্থানে ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং কর্মস্থলে ২৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ বৈষম্য বা হয়রানির ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে মাত্র ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ ভুক্তভোগী এসব ঘটনার বিষয়ে রিপোর্ট করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্ধ্যার পর নিজ এলাকার আশপাশে একা চলাফেরা করতে নিরাপদ বোধ করেন ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক। বিবিএস জরিপে বলা হয়, নিরাপত্তা বিষয়ে জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় যে ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ এলাকার আশপাশে একা চলাফেরা করতে নিরাপদ বোধ করেন।
তবে পুরুষদের (৮৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ) তুলনায় নারীরা (৮০ দশমিক ৬৭ শতাংশ) কম নিরাপদ বোধ করেন। শহরাঞ্চলের নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ (৮৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ) গ্রামীণ এলাকার নাগরিকদের তুলনায় কিছুটা কম (৮৫ দশমিক ৩০ শতাংশ) পরিলক্ষিত হয়।
অপর দিকে সন্ধ্যার পর নিজ বাড়িতে নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধের হার ৯২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৯১ দশমিক ৮২ শতাংশ ও ৯৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। রাজনৈতিক প্রভাব বিষয়ের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন যে তারা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের কর্মকা- সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতে পারেন।
এ ক্ষেত্রে শহর (২৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ) ও গ্রাম (২৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ) এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য না থাকলেও, লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য রয়েছে যা পুরুষের ক্ষেত্রে ৩১ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং নারীর ক্ষেত্রে ২৩ দশমিক ০২ শতাংশ। অনুরূপভাবে ২১ দশমিক ৯৯ শতাংশ নাগরিক মনে করেন যে তারা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন মর্মে মত প্রকাশ করেন। এ হার নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ ও ২৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ৪৭ দশমিক ১২ শতাংশ নাগরিক গত ১ বছরের মধ্যে অন্তত ১ বার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা গ্রহণ করেছেন। সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৭২ শতাংশ নাগরিকের মতে ওই স্বাস্থ্যসেবা সহজে প্রাপ্তিযোগ্য এবং স্বাস্থ্যসেবার খরচ সামর্থের মধ্যে ছিল মর্মে ৮৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ নাগরিক মত প্রকাশ করেন।
এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মান, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে আচরণ এবং ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের সময় দেওয়ার বিষয়ে সেবা গ্রহণকারীদের সন্তুষ্টির হার যথাক্রমে ৬৫ দশমিক ০৭ শতাংশ, ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং ৬৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। শিক্ষা ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ৪০ দশমিক ৯৩ শতাংশ নাগরিকের কমপক্ষে একটি শিশু সরকারি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। এর মধ্যে ৯৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহজে প্রবেশযোগ্য (যে কোনো ধরনের যানবাহনে বা পায়ে হেঁটে ৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছানো যায়) ও ৯২ দশমিক ৬৬ শতাংশ নাগরিক রিপোর্ট করেন যে শিক্ষা ব্যয় সামর্থের মধ্যে ছিল, যেখানে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ হার যথাক্রমে ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ ও ৮০ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
অপর দিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান মানসম্মত ছিল মর্মে যথাক্রমে ৬৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ৭১ দশমিক ৮৬ শতাংশ নাগরিক মত প্রকাশ করেন। অন্য সরকারি সেবার (পরিচয়পত্র অথবা নাগরিক নিবন্ধন) ক্ষেত্রে দেখা যায় যে সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৮ দশমিক ১২ শতাংশ সেবার প্রাপ্যতা ও ৮৬ দশমিক ২৮ শতাংশ সেবাপ্রাপ্তি ব্যয় সামর্থের মধ্যে ছিল মর্মে উল্লেখ করেন। অপর দিকে কার্যকর সেবাদান প্রক্রিয়া, সম-আচরণ, সময়মতো সেবাদানে সন্তুষ্টির হার যথাক্রমে ৬২ দশমিক ৬০ শতাংশ, ৫৬ দশমিক ২৬ শতাংশ ও ৫১ দশমিক ২৮ শতাংশ।