ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

ব্যবহৃত ফোন কেনার আগে যা অবশ্যই জানা দরকার

রাশেদুল ইসলাম সম্রাট, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১০:৪২, ২০ জুন ২০২৫

ব্যবহৃত ফোন কেনার আগে যা অবশ্যই জানা দরকার

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান বাজারে নতুন স্মার্টফোনের দাম অনেকেরই নাগালের বাইরে। বিশেষ করে ফ্ল্যাগশিপ বা উচ্চমানের ফিচারসমৃদ্ধ ফোনের ক্ষেত্রে দাম যেন আকাশচুম্বী। তাই অনেকেই বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছেন ব্যবহৃত স্মার্টফোন, যেগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম এবং ফিচারও সন্তোষজনক। তবে ব্যবহৃত ফোন কেনার কিছু সুবিধা থাকলেও অসতর্কতার কারণে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। তাই পুরোনো ফোন কেনার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক মাথায় রাখা জরুরি।

কোথা থেকে ফোন কেনা হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ
অনেকেই সরাসরি বর্তমান মালিকের কাছ থেকে ব্যবহৃত ফোন কিনে থাকেন। এর সুবিধা হলো—রিফারবিশড (refurbished) বা কারিগরি সংস্কার করা ফোনের আশঙ্কা কম থাকে। তবে ফোনটি যদি আগে মেরামত করা হয়ে থাকে, তাহলে তা চোখে পড়ার মতো কোনো দাগ বা চিহ্ন রেখে যেতে পারে। ফেসবুক মার্কেটপ্লেস, বিক্রয় ডটকম বা অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রচুর ব্যবহৃত ফোন পাওয়া যায় যেখানে দরদাম করার সুযোগও থাকে। তবে অপরিচিত কারও সঙ্গে সরাসরি লেনদেন সবসময়ই কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে পুরো টাকা একবারেই পরিশোধ করতে হয়, যার ফলে প্রতারণার আশঙ্কা থেকে যায়।

বিভিন্ন মোবাইল মার্কেটেও এখন ব্যবহৃত ফোনের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে সাধারণত বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ফোন বিক্রি করা হয়। ক্রেতারা চাইলে এখানে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কিস্তিতেও ফোন কিনতে পারেন। তবে এই ফোনগুলোর বড় একটি অংশই রিফারবিশড হয়ে থাকে। বাইরের দিক দেখে ফোনটি একদম নতুন মনে হলেও ভেতরের যন্ত্রাংশে পরিবর্তন থাকতে পারে, যা সাধারণ ক্রেতার পক্ষে বোঝা কঠিন।
বিশেষ করে অ্যাপল আইফোনের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। কারণ, আইফোনের নতুন ও পুরোনো সব মডেলই ব্যবহৃত ফোনের বাজারে বেশ জনপ্রিয়। ফলে এগুলোতেই বেশি রিফারবিশিং করা হয়। একাধিক ফোনের যন্ত্রাংশ একত্র করে একটিকে সচল করে তোলা হয়। এমনকি উন্নত দেশগুলোতে এমন যন্ত্রপাতি রয়েছে, যার মাধ্যমে ফোন মেরামতের কোনো চিহ্ন না রেখেই তা পুনঃবিক্রির উপযোগী করা সম্ভব হয়।

কোন মডেল কিনবেন আর কোনটা নয়
ব্যবহৃত আইফোন কেনার আগে অবশ্যই জানতে হবে, কোন মডেলটি বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য এবং কোনগুলো এখন পুরনো। সাধারণভাবে পাঁচ বছরের বেশি পুরনো মডেল না কেনাই ভালো। যেমন, আইফোন ১১ সিরিজ বা তার আগের মডেলগুলো নতুন iOS আপডেট পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে কিছুদিন পর অনেক দরকারি অ্যাপ ইনস্টল বা আপডেট করা যাবে না, যা ফোনটিকে কার্যত অকেজো করে তুলতে পারে।

ব্যবহৃত আইফোনের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং সহজ উপায় হলো—কম্পিউটারে 3uTools নামক একটি ফ্রি সফটওয়্যার ব্যবহার করা। এই সফটওয়্যারটি iPhone-এর ব্যাটারির স্বাস্থ্য, রিফারবিশ বা রিপেয়ার ইতিহাস, হার্ডওয়্যার কম্পোনেন্টের অরিজিনালিটি, সিরিয়াল নম্বর, স্টোরেজ, iOS সংস্করণসহ আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিস্তারিতভাবে প্রদর্শন করে, যা একটি সচেতন ক্রয় সিদ্ধান্তে সাহায্য করে।

ব্যবহৃত ফোন কেনার সময় যে বিষয়গুলোতে খেয়াল রাখবেন
১. ফোনের বৈধতা

ফোনটি বৈধ কিনা, তা যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় চুরি হওয়া ফোন কম দামে বিক্রি করা হয়। এরকম ফোন কিনলে ভবিষ্যতে আইনি সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ফোনের আইএমইআই নম্বর ডায়াল করে *#06# চেপে পাওয়া যায়। এরপর বিটিআরসি’র অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে যাচাই করে ফোনটির বৈধতা নিশ্চিত হওয়া যায়। বিক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্র ও পুরোনো ক্রয়ের রসিদ সংগ্রহ করলে নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত হয়।

২. বাহ্যিক অবস্থা
ফোনটি হাতে নিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করুন। ভিডিও কল বা ছবির ভিত্তিতে ফোন কেনা ঝুঁকিপূর্ণ। ফোনে বেশি দাগ, ফাটা ব্যাক কভার, বা ক্যামেরা লেন্সে ময়লা থাকলে ফোনটি এড়িয়ে চলাই ভালো। এছাড়া, চার্জিং পোর্টে জং আছে কি না, বোতামগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে কি না তা পরীক্ষা করুন।

৩. ডিসপ্লে পরীক্ষা
ফোনের ডিসপ্লে ঠিক আছে কি না তা যাচাই করা আবশ্যক। ডিসপ্লে বদলানো ব্যয়বহুল এবং কিছু মডেলের আসল ডিসপ্লে পাওয়াও কঠিন। আইফোনের ক্ষেত্রে ট্রু টোন ফিচার ঠিক আছে কি না তা দেখে ডিসপ্লের অবস্থা বোঝা যায়। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ক্ষেত্রে ডেড পিক্সেল, স্ক্রিন বার্ন বা টাচ ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, তা পরীক্ষা করুন।

৪. ব্যাটারির স্বাস্থ্য
ব্যাটারির সক্ষমতা ব্যবহৃত ফোনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আইফোনে Settings > Battery > Battery Health & Charging অপশনে গিয়ে ব্যাটারির সর্বোচ্চ সক্ষমতা দেখা যায়। ৮৫% এর নিচে হলে সেই ফোন না কেনাই ভালো। তবে মনে রাখবেন, ব্যাটারির হেলথ টেম্পার বা কারচুপি করাও সম্ভব। অনেক পুরনো ফোনে যদি ব্যাটারির স্বাস্থ্য ৯০% বা তার বেশি দেখায়, তা সন্দেহজনক।

৫. হার্ডওয়্যার পরীক্ষা
স্পিকার, মাইক্রোফোন, ক্যামেরা, হেডফোন জ্যাক (যদি থাকে) – সবকিছু ঠিকঠাক কাজ করছে কি না তা যাচাই করুন। ছবি তুলে, ভিডিও করে এবং কল করে এসব যাচাই করা যেতে পারে।

৬. ফোনের সেন্সর
ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেস আনলক, জাইরোস্কোপ, অ্যাক্সিলোমিটার, প্রক্সিমিটি সেন্সর—এসব কাজ করছে কি না তা নিশ্চিত হোন। ‘Sensor Box’ বা ‘CPU-Z’ অ্যাপের মাধ্যমে এসব সেন্সর টেস্ট করা যায়।

৭. নেটওয়ার্ক ও কল কোয়ালিটি
সিমকার্ড ব্যবহার করে সরাসরি কল করে দেখে নিন ফোনটি ভালোভাবে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে কি না। কল ড্রপ হচ্ছে কি না বা শব্দের গুণগত মান কেমন তা যাচাই করুন।

ব্যবহৃত স্মার্টফোন কেনা মানে শুধু সাশ্রয় নয়—বরং একটি হিসেবি ঝুঁকির অংশ। কম দামে ভালো ফিচার পাওয়ার লোভে পড়ে যদি যাচাই-বাছাই না করে ফোন কেনা হয়, তবে ভবিষ্যতে তা হতে পারে এক বড় ভুল সিদ্ধান্ত। তাই প্রযুক্তিতে সত্যিকারের স্মার্ট হতে হলে, ক্রয় সিদ্ধান্তেও থাকতে হবে সতর্কতা ও সচেতনতা। ধৈর্য ধরে প্রতিটি দিক যাচাই করেই নিতে হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত—তবেই সাশ্রয়ী দামে স্মার্ট চয়েস সম্ভব।

মুমু ২

×