ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মজুরির হার ও জীবনজীবিকা

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ০১:১২, ৫ মে ২০২৪

মজুরির হার ও জীবনজীবিকা

বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বীকৃতির মাস

মহান মে মাস। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বীকৃতির মাস। শ্রমিকদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতিবছর ১ মে সারা বিশ্বে দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালন করা হয়। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য-‘শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ।’
মহান মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব শ্রমজীবী মানুষকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিল্প ও শ্রমবান্ধব বর্তমান সরকার শ্রমিকের সার্বিক কল্যাণ সাধন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নত কর্মপরিবেশ, শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের  পেশাগত নিরাপত্তা, সুস্থতাসহ সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রম আইন যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। আমরা রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করেছি এবং সহযোগিতা অব্যাহত  রেখেছি। সব সেক্টরে শ্রমিকদের বেতনভাতা বাড়ানো হয়েছে। 
মূল্যস্ফীতির হার ও জীবনের গল্প :
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, গত মার্চে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। আগের বছরের একই মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল আরও বেশি, ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর ১২ মাস ধরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়েনি শ্রমজীবীদের মজুরি। বিষয়টি বিবিএসের তথ্যেও উঠে এসেছে। গত মার্চে সাধারণ মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসেবে মূল্যস্ফীতির তুলনায় তা কম ছিল ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায়ই সার্বিক মূল্যস্ফীতিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের শ্রমজীবীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম খাদ্য গ্রহণ এবং চাহিদা ছেঁটে জীবনযাপনের ব্যয় সংকুলান করছেন।

জীবিকা নির্বাহ কঠিন হওয়ায় অনেকে আবার শহর ছাড়ারও চিন্তা করছেন। তাদেরই একজন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ইউনুস আলী। আগে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে অন্যের কৃষিজমিতে কাজ করতেন। সেই আয় দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হওয়ায় পাড়ি জমান ঢাকায়। কারওয়ান বাজারে এখন কুলির কাজ করছেন। থাকেন একটি মেসে। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে নিজের খাবার খরচ ও মেস ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে তেমন টাকা পাঠাতে পারছেন না বলে জানান। তাই আবার গ্রামে পরিবারের কাছেই ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছেন ইউসুফ। 
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকৃত আয় না বাড়ায় শ্রমিকদের ভোগ কমছে। দীর্ঘমেয়াদে জীবনযাত্রার মান কমে গিয়ে তারা চরম দারিদ্র্যসীমায় নেমে যেতে পারেন। আর ভোগ কমলে বিনিয়োগও কমবে। ফলে কমে আসতে পারে প্রবৃদ্ধিও। টিকতে না পেরে ২০২৩ সালে প্রতি হাজারে প্রায় ১৪ জন শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান। পাঁচ বছর আগে এ হার ছিল একজনেরও কম। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে ১৩ দশমিক ৮ জন। আগের বছর এ হার ছিল ১০ দশমিক ৯ জন। ২০২১ সালে প্রতি হাজারে ৫ দশমিক ৯ জন শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি দেন। ২০২০ সালে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৪ জনে। ২০১৯ সালে প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছেন একজনেরও কম বা দশমিক ৭ জন। অর্থাৎ আগের চেয়ে বেশি মানুষ এখন শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন।
তীব্র তাপপ্রবাহের প্রভাব জীবনমানে :
চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ঠিকমতো বাইরে কাজ করতে পারছেন না শ্রমিকরা। এতে তাদের আয় কমে গেছে। সংসার চালাতে অনেককে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। বরগুনা থেকে ঢাকায় এসেছেন নজরুল ইসলাম। জীবিকা নির্বাহ করছেন রিকশা চালিয়ে। এফডিসি মোড়ে তার সঙ্গে কথা হলে জানান, রোদের প্রখরতায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। কিছু সময় পরপর পানি বা শরবত পান করতে হচ্ছে, তাতে বাড়তি ব্যয়ও গুনতে হচ্ছে। অথচ সে অনুযায়ী আয় নেই তার।

নিম্ন আয়ের মানুষকে মজুরির একটি বড় অংশই ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতেই। অথচ মূল্যস্ফীতির তুলনায় তাদের আয় বৃদ্ধির হার সেভাবে বাড়েনি। আর খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রংপুর থেকে ঢাকায় এসে রিকশাভ্যান চালান আলম মিয়া। তিনি জানান, আগে গাড়ির জমা হিসেবে দিনপ্রতি মালিককে দিতে হতো ১৫০ টাকা করে। এখন সেটি বাড়িয়ে দিতে হয় ২০০ টাকা। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাম বেড়ে গেছে।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে কম মজুরি বাড়ছে শিল্প খাতের শ্রমিকদের। গত মার্চে এ খাতের মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণ মজুরির তুলনায় তাদের মজুরি বৃদ্ধির হার আরও কম। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এর বক্তব্য, ‘প্রকৃত আয় না বাড়ায় শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বাড়ছে না। ফলে তাদের জীবনমান কমছে। দীর্ঘমেয়াদে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। আর ভোগ কমায় বিনিয়োগ কম হবে। এতে প্রবৃদ্ধিও কমে আসবে। এটার প্রভাব থাকবে খানা ও জাতীয় পর্যায়েও। সামাজিক অসন্তোষ ও বিচ্ছিন্নতাবোধও বাড়তে পারে এ কারণে।’ 
কৃষি শ্রমিক ও মে দিবস :
কৃষিতে শ্রম দিয়ে যারা জীবিকা অর্জন করে তাদের কৃষি শ্রমিক বলা হয়। নানা কারণে কৃষিতে শ্রমশক্তি ক্রমহ্রাসমান। ২০০০ সালে দেশের মোট শ্রমশক্তির মধ্যে ৬০ শতাংশ ছিল কৃষি শ্রমিক। সেটি কমে বর্তমানে ৩৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ২০ শতাংশে ঠেকতে পারে। মূলত কৃষি শ্রম খাতে অবহেলার কারণে দেশে কৃষি শ্রমিকের হার দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।

কৃষি খাতে ভর্তুকি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রণোদনা, কৃষি ঋণ, বিনামূল্যে এবং ভর্তুকি মূল্যে উচ্চফলনশীল বীজ সরবরাহ, সারসহ কৃষি উপকরণে উন্নয়ন সহায়তা প্রদান ইত্যাদির প্রচলন থাকলেও কৃষক যখন মাঠে কাজ করবেন তখন তার স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা তথা মানসিক প্রশান্তির জন্য কোনো অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। প্রখর রোধে তারা কাজ করলেও বিশ্রাম নেওয়ার কোনো জায়গা নেই। কৃষককে মাঠে-ঘাটের নোংরা কাদামাটির ওপর বসেই খাবার খেতে হয়। কাছাকাছি কোনো নিরাপদ পানির উৎস না থাকায় অনিরাপদ পানি খেতে হয়। 
প্রতি বছর মে দিবস এলেই শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে নানা রকম সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। সংবাদপত্রে বের করা হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সম্প্রচার করা হয় আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ও টক শো। মে দিবস আসে আবার চলেও যায়। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক শ্রেণি তথা কৃষি শ্রমিকদের কথা থাকে উপেক্ষিত।

অথচ কৃষিভিত্তিক আমাদের এ দেশ বাংলাদেশ। মোট জনশক্তির প্রায় ৫০ ভাগ এখনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির সর্বাধিক এ খাতটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা দেখা যায় না। উপরন্তু কৃষি শ্রমিকদের নেই কোনো সংগঠন, সমিতি বা কারখানার শ্রমিকদের মতো ট্রেড ইউনিয়ন। আর তাই তাদের মৌলিক মানবিক ও সামাজিক অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং নানা সমস্যা থেকে যায় অতল অন্ধকারে। তাই তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এজন্য আমরা লক্ষ্য করি ধান কাটার মৌসুমে পর্যাপ্ত কৃষি শ্রমিক পাওযা যায় না।
সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে সজাগ রয়েছে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণে শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে গড়বে দেশ। মে দিবস বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। দেশে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অন্য পেশাজীবীদের বেতনভাতা বাড়লেও অনেকেই রয়েছেন পিছিয়ে। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের বেতন অনিয়মিত। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। জয় হোক মেহনতি মানুষের।

×