ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জীবনের গল্প

প্রত্যয় জসীম

প্রকাশিত: ২২:১১, ২ মে ২০২৪

জীবনের গল্প

ভেগাসের রঙ্গশালায়

‘ভদ্র মহিলা আমার চোখের দিকে তাকালেন, বেশ শক্ত করে উচ্চারণ করলেন, ইউ পিপল আর কাওয়ার্ড। দোজ হু কিল্ড দেয়ার ফাদার দে ডোন্ট লাভ দেয়ার কান্ট্রি এট অল। আই মাস্ট সে। আমি আর যেন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তিনি আবার আরেক রকম জুয়ার মেশিনে সুইচ টিপলেন। আর আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।’
(ভেগাসের রঙ্গশালায় বিদেশিনীর সঙ্গে পৃ. ১০৫)
আলোচ্য গল্পের নায়িকা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এসে এক বাঙালি যুবকের প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েন। পঁচাত্তরের নির্মম নিষ্ঠুর ট্র্যাজেডি মেনে নিতে পারেনি এ গল্পের নায়িকা। বঙ্গবন্ধুকে পরিবার পরিজনসহ হত্যাকা-ের পর ব্যথিত মর্মাহত হয়ে তিনি নিজ দেশ, মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনেও তাদের ইশারা ছিল এবং পঁচাত্তর পরবর্তী বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করার যে সর্বগ্রাসী ও বিনাশী তৎপরতা ছিল এসব অপচেষ্টাকে পরাভূত করে বঙ্গবন্ধু আজ হিরন্ময় চেতনায় উদ্ভাসিত। এ গল্পের লেখক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর সে দিকেই তাঁর চেতনাকে প্রসারিত করেছেন। লেখকের সমাজবীক্ষা বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গীকৃত। 
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের গল্পের বিষয় বহুমাত্রিক। তাঁর ভাষা ও গল্প বলার ধরন প্রথাগত নয়। সহজ সরল বাচনভঙ্গি তবে শিল্পরূপ আছে অনন্য ও ভিন্নমাত্রায়। নিজস্ব নির্মাণশৈলী তাঁর গল্পকে সমকালীন গল্পাকারদের চেয়ে আলাদা করেছে এ কথা বলা যায়। 
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তাঁর সাহিত্য চর্চার বিষয়ে জ্ঞাত ছিলাম না। তিনি এ বছর কথাসাহিত্য শাখায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। খবরটা আমি ভারতের মুম্বাইতে অবস্থানকালে অনলাইন নিউজ পড়ে জানতে পারি। মুম্বাই টাটা হাসপাতালে কর্কট রোগের চিকিৎসা শেষে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দেশে আসি। 
বইমেলায় নিজের বই প্রকাশ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি। মেলায় আড্ডা অনিয়মিত। একদিন কথা প্রকাশ থেকে সংগ্রহ করলাম ‘ভেগাসের রঙ্গশালায় বিদেশিনীর সঙ্গে’। বইয়ের বড় নাম দেখে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কথা মনে হলো। না মার্কেজের সঙ্গে মিল নেই। ছোট ছোট বাক্য। সহজ সরল বয়ানভঙ্গি। কত কত হাহাকার। ছোট ছোট দুঃখ। কত কত ভালোবাসা, নির্মমতা নিষ্ঠুরতা জুয়াখেলা। জীবনটাতে জুয়াই।

রঙ্গশালায় ভরা এ জীবন কত বিবর্ণ-বিমর্ষ আর দুঃখ ভারানত। ‘মেলবোর্ণ ও নৃতত্ত্বের গল্প’ আমাদের সামনে সেই বাস্তবতাই যেন হাজির করে। অসাধারণ ও অসামান্য এ গল্পের সমাজ বাস্তবতা। পৃথিবীর সব আলো ঝলমল শহরের পর্দার আড়ালে এমন সব অন্ধকারের গল্পই তো লুকিয়ে আছে। কথাশিল্পী নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের গল্পে সেই জীবন অন্বেষার ¯্রােত বহমান। সমকালীন বাংলা গল্পে এমন চিত্র আমার দৃষ্টিতে খুবই নগণ্য।

আলোচ্য গল্পের বইতে আটত্রিশটি গল্প স্থান পেয়েছে। ছোট্ট একটা গল্প- চাল ও কাঁকর- আলোচ্য গল্পে শাশুড়ি নববধূকে অবসর দেখতে চান না। তাই চালের সঙ্গে কাঁকর মিশিয়ে বললেন, চালের কাঁকর বেছে রান্না করবে।’ ইতোমধ্যে শাশুড়ি পান চিবুতে গেলেন। অতি অল্পসময় পরই বউ এসে বলে, আম্মা হয়ে গেছে।  
শাশুড়ির চোখতো কপালে, কেমনে?
বউ বলে, ‘আমি চাল বেছেছি, কাঁকর বাছিনি।’ 
(ভেগাসের রঙ্গশালায় বিদেশিনীর সঙ্গে পৃষ্ঠা: ৯৫)
আমাদের সমাজ রাষ্ট্রে দুর্বৃত্ত আর নষ্ট কাঁকরেরা যুথবদ্ধ হয়ে আছে। ভালোদের কোনো সম্মিলিত হওয়ার জায়গা নেই। চালের মতো ভালোদের বেছে আলাদা করতে হবে। লেখক এ গল্পে সেই সমাজবীক্ষাই আমাদের সামনে প্রতীকী অর্থে তুলে ধরেছেন। লেখকের যদি সমাজের সর্বজনীন কল্যাণ চিন্তা না থাকে তাহলে লিখে লাভ কী।

নান্দনিকতা ও শিল্পের দোহাই দিয়ে যাঁরা সাহিত্যকে জীবনবিমুখ করেছেন, তাঁদের সাহিত্য আমাকে প্রণোদিত করে না। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের গল্প পড়ে আমার মনে হয়েছে জীবনমুখী সাহিত্যের ঝলমলে রোদ মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়নি। অভিনন্দন। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর আপনাকে। আপনি আপনার মতো করে লিখে যান। এই প্রার্থনা আজ।

×